এ পাড়ার একজন অতি বৃদ্ধ ভিক্ষুক মাঝে মাঝে ভিক্ষা করিতে আসিত ,তাহার উপর ললিতার বড় দয়া ছিল, আসলেই তাহাকে একটি করিয়া টাকা দিত। টাকাটি হাতে পাইয়া সে যে সমস্ত অপূর্ব এবং অসম্ভব আশীর্বাদ উচ্চারণ করিতে থাকিত, সেইগুলি শুনিতে সে অতিশয় ভালোবাসিত সে বলিত ললিতা পূর্বজন্মে তাহার আপনার মা ছিল, এবং ইহা সে ললিতাকে দেখিবা মাত্রই কেমন করিয়া চিনিতে পারিয়াছিল। সেই বুড়া ছেলেটি তাহার আজ সকালেই দাঁড়িয়ে আসিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাক দিল, আমার মা জননী কোথায় গো?
সন্তানের আহবানে আজ ললিতা কিছু বিব্রত হইয়া পড়িল । এখন শেখর ঘরে আছে, সে টাকা নিতে যায় কিরূপে ?এদিক সেদিক চাহিয়া মামীর কাছে গেল মামী এই মাত্র ঝির সহিত বকাবকি করিয়া বিরক্ত মুখে রাঁধিতে বসিয়া ছিলেন, তাহাকে কিছু না বলিতে পারিয়া ,সে ফিরে আসিয়া মুখ বারাইয়া দেখিলো ভিক্ষুক দোরগোড়ায় লাঠিটি ঠেস দিয়া রাখিয়া বেশ চাপিয়া বসিয়াছে। ইতিপূর্বে ললিতা কখনো তাহাকে নিরাশ করে নাই আজ শুধু হাতে ফিরাইয়া দিতে তাহার মন সরিল না।
ভিক্ষুক আবার ডাক দিল।
আন্নাকালী ছুটিয়ে আসিয়া সংবাদ দিল, সেজদি, তোমার সেই ছেলে এসেচে। ললিতা বলিলো কালী ,একটা কাজ করনা ভাই। আমার হাতজোড়া তুই একটিবার উঠে গিয়ে শেখর দার কাছে থেকে একটি টাকা নিয়ে আয়।
কালি ছুটিয়া চলিয়া গেল , খানিক পরে তেমনি ছুটি আসিয়া ললিতার হাতে একটা টাকা দিয়ে বলিল এই নাও।
ললিতা জিজ্ঞাসা করিল শেখর দা কি বললে রে ?
কিছু না আমাকে বললে চাপকানের পকেট থেকে টাকা নিতে, আর নিয়ে এলুম ।
আর কিছু বললে না ?
না আর কিছু না বলিয়া খেলা করিতে চলিয়া গেল।
ললিতা ভিক্ষুক বিদায় করিল, কিন্তু অন্য দিনের মতো দাঁড়াইয়া থাকিয়া তাহার বাক্যচ্ছটা শুনিতে পারিল না- ভালই লাগিল না।
এ কয়দিন তাহাদের আড্ডা পূর্ণ তেজে যে চলিতে ছিল। আজ দুপুর বেলা ললিতা গেল না, মাথা ধরিয়াছে বলিয়া শুইয়া রহিলো। আজ সত্য সত্য তাহার ভারী মন খারাপ হইয়া গিয়াছিল। বিকেলবেলা কালিকে কাছে ডাকিয়া বলিল কালী তুই পড়া বলে নিতে শেখোর দার ঘরে আর যাসনে?
কালী মাথা নাড়িয়ে বলিল হ্যাঁ যাই ত?
আমার কথা শেখর দা জিজ্ঞেস করে না?
না হা হা পশু করেছিল তুমি দুপুরবেলা তাস খেলো কিনা? ললিতা উদ্বিগ্ন হইয়া প্রশ্ন করিল তুই কি বললি?
কালি বলিল তুমি দুপুর বেলা চারু দিদিদের বাড়ি তাস খেলতে যাও তাই বললুম ,শেখর দা বললে কে কে খেলে? আমি বল্লুম তুমি আর সইমা ,চারূদি আর তার মামা। আচ্ছা তুমি ভালো খেলো না চারুদিদের মামা ভাল খেলে সেজদী?
সইমা বলে তুমি ভালো খেলো না?
ললিতা সে কথার জবাব না দিয়া হঠাৎ অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিল, তুই এত কথা বলতে গেলি কেন সব কথাই তোর কথা কওয়া চাই ,আর কোনদিন তোকে আমি কিছু দেব না ,বলিয়া রাগ করিয়া চলিয়া গেল।
কালি অবাক হইয়া গেল ।তাহার এই আকস্মিক ভাব পরিবর্তনের হেতু সে কিছুই বুঝিলো না।
মনোরোমার তাস খেলা দুদিন বন্ধ হইয়াছে- ললিতা আসে না। তাহাকে দেখিয়া অবধি গিরীন্দ্র যে আকৃষ্ট হইয়াছিল ,তাহা প্রথম হইতেই মনোরমা সন্দেহ করিয়াছিলেন, তাহার সেই সন্দেহ আজ সুদৃঢ় হইল।
এই দুই দিন গিরিন কি একরকম উৎস ও অন্যমনস্ক হইয়াছিল। অপরাহ্ণে বেড়াইতে যাইতো না ,যখন তখন বাড়ির ভিতরে আসিয়া এ ঘর ও ঘর করি তো ,আজ দুপুর বেলা আসিয়া বলিল দিদি আজও খেলা হবে না?
মনোরমা বলিলেন কি হবে গিরিন, লোক কই? না হয় আয় আমরা তিনজনেই খেলি।
গিরিন নিরুৎসাহ ভাবে বলিল তিন জনে কি খেলা হয় দিদি? ও বাড়ির ললিতাকে একবার ডাকতে পাঠাও না।
সে আসবে না ।
গিরিন বিমর্ষ হইয়া জিজ্ঞাসা করিল কেন, আসবেনা ,ওদের বাড়িতে মানা করে দিয়েছে বোধ হয় না?
মনোরমা ঘাড় নারিয়া বলিলেন ,না ওর মামা-মামী সেরকম মানুষ নয়, সে নিজেই আসে না।
গিরিন হঠাৎ খুশি হইয়া বলিল, তাহলে তুমি নিজে আজ একবার গেলেই আসবেন ,কথাটা বলিয়া ফেলিয়া সে নিজের মনেই ভারী অপ্রতিভ হইয়া গেল।
মনোরমা হাসিয়া ফেলিলেন আচ্ছা ,তাই যাই, বলিয়া চলিয়া গেলেন এবং খানিক পরে ললিতাকে ধরিয়া আনিয়া তাস পাড়িয়া বসলেন।
দুদিন খেলা হয় নাই আজ অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জমিয়ে গেল। ললিতারা জিততেছিল ।
ঘন্টা দুই পড়ে সহসা কালিয়াশিয়া দাঁড়াইয়া বলিল সেজদি শেখর দা ডাকচেন জলদি।
ললিতার মুখ পান্ডুর হইয়া গেল, তাস দেওয়া বন্ধ করিয়া বলিল শেখর দা অফিসে যাননি ?
কি জানি চলে এসেছেন বলিয়া সে ঘাড় নাড়ীয়া প্রস্থান করিল। ললিতা তাস রাখিয়া দিয়া মনোরমার মুখপানে চাহিয়া কুন্ঠিতভাবে বলিল যাই সই -মা।
মনোরোমা তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, সে কিরে ?আর দুহাত দেখে যাই।
ললিতা ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না সই-মা তিনি তাহলে বড় রাগ করবেন ,বলিয়া দ্রুত পদে চলিয়া গেল।
গিরিন প্রশ্ন করিল শেখর দাদা আবার কে দিদি?
মনোরমা বলিলেন ওই যে সম্মুখের ফটোকওয়ালা বড় বাড়িটা।
গিরিন ঘাড় নারিয়া বলিল ও- ওই বাড়ি । নবীন বাবু ওদের আত্মীয় বুঝি?
মনোরমা মেয়ের মুখের পানে চাহিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আত্মীয় কেমন !ললিতাদের ওই ভিটে টুকু পর্যন্ত বুড়ো আত্মসাৎ করবার ফিকিরে আছেন ।
গিরিন আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া রহিল।
মনোরমা তখন গল্প করিতে লাগিলেন, কেমন করিয়া গত বৎসর টাকার অভাবে গুরুচরণ বাবুর মেজ মেয়ের বিবাহ হইতেছিল না, পরে অসম্ভব সুদে নবীন রায় টাকা ধার দিয়া বাড়ি খানি বাধা রাখিয়াছেন ।এ টাকা কোনদিন শোধ হইবে না এবং অবশেষে বাড়িটা নবীনরাই গ্রহণ করিবেন।
মনোরোমা সমস্ত কথা বলিয়া পরিশেষে মন্তব্য প্রকাশ করিলেন, বুড়ার আন্তরিক ইচ্ছা গুরুচরণ বাবুর ভাঙ্গা বাড়িটা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া ওইখানে ছোট ছেলে শেখরের জন্য একটি বড় রকমের বাড়ি তৈরি করেন- দুই ছেলের দুই আলাদা বাড়ি- মতলব মন্দ নয়।
ইতিহাস শুনিয়া গিরিনের ক্লেশবোধ হইতেছিল, জিজ্ঞাসা করিল আচ্ছা দিদি গুরুচরণ বাবুর আরো তো মেয়ে আছে তাদেরই বা বিয়ে কি করে দেবেন?
মনোরমা বলিলেন নিজের তো আছেই, তাছাড়া ললিতা। ওর বাপ-মা নেই সমস্ত ভার ওই গরিবের উপর।
বড় হয়ে উঠেছে এ বছরের মধ্যে বিয়ে না দিলেই নয়, ওদের সমাজে সাহায্য করতে কেউ নেই জাত নিতে সবাই আছে- আমরা বেশ আছি গিরিন।
গিরিন চুপ করিয়া রহিল তিনি বলিতে লাগিলেন ,সেদিন ললিতার কথা নিয়েই ওর মামী আমার কাছে কেঁদে ফেললেন ,কি করে যে কি হবে তার কিছুই স্থির নেই ওর ভাবনা ভেবেই গুরুচরণ বাবুর পেটে অন্য জল যায় না,
মুঙ্গে রে তোদের কোন বন্ধু-বান্ধব এমন নেই যে,, শুধু মেয়ে দেখে বিয়ে করে? এমন মেয়ে কিন্তু পাওয়া শক্ত।
গিরিন বিষন্নভাবে মৃদু হাসিয়া বলিল বন্ধুবান্ধব আর পাব কোথায় দিদি। তবে টাকা দিয়ে আমি সাহায্য করতে পারি। গিরিনের পিতা ডাক্তারি করিয়া অনেক টাকা এবং বিষয় সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছেন সে সমস্ত রই এখন সে মালিক।
মনোরমা বলিলেন টাকা তুই ধার দিবি?
ধার আর কি দেবো দিদি ইচ্ছে হয় উনি শোধ দিবেন, না হয় নাই দিবেন।
মনোরমা বিস্মিত হইলেন বলিলেন ,তোর টাকা দিয়ে লাভ? ওরা আমাদের আত্মীয় নয়, সমাজের লোকও নয়- এমনই কে কাকে টাকা দেয়?
গিরিন তাহার বোনের মুখের পানে চাহিয়া হাসিতে লাগিল। তারপরে কহিল সমাজের লোক নাই হলেন, বাঙালি তো? ওর একান্ত অভাব আর আমার বিস্তর রয়েছে, তুমি একবার বলে দেখো না দিদি, উনি যদি নিতে রাজি হন ,আমি দিতে পারি। ললিতা তাদেরও কেউ নয় আমাদেরও কেউ নয়। তার বিয়ের সমস্ত খরচ না হয় আমিই দেব।
তাহার কথা শুনিয়া মনোরমা বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন না । ইহাতে তাহার নিজের ক্ষতি বৃদ্ধি কিছুই নাই বটে, তথাপি এত টাকা একজন আরেকজনকে দিতেছে দেখিলে অনেক স্ত্রীলোকেই প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করিতে পারে না।
চারু এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতে ছিল সে মহা খুশি হইয়া লাফাইয়া উঠিল বলিল ,তাই দাও মামা ,আমি সই মাকে বলে আসছি ।
তাহার মা ধমক দিয়ে বলিলেন তুই থাম চারু ,ছেলে মানুষ -এসব কথায় থাকিস নে, বলতে হয় আমি বলব।
গিরিন কহিল তাই বল দিদি পরশু রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে গুরুচরণ বাবুর সঙ্গে একটুখানি আলাপ হয়েছিল, কথাবার্তায় মনে হল বেশ সরল লোক তুমি কি বল?
মনোরমা বলিলেন আমিও তাই বলি সবাই তাই বলে ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই বড় সাদাসিধে মানুষ ।সেই জন্যই তো দুঃখ হয় গিরিন অমন লোকটিকে হয়তো বাড়িঘর ছেড়ে নিরস্রয় হতে হবে তার সাক্ষী দেখলিনে গিরিন ,শেখর বাবু ডাকছেন বলতেই ললিতা কি রকম তাড়াতাড়ি উঠে পালালো ,বাড়ি শুদ্ধ লোক ওদের কাছে যেন বিক্রি হয়ে আছে, কিন্তু যত খোশামদ ই করুক না কেন নবীন রায়ের হাতে গিয়ে একবার যখন পড়েছে রেহাই পাবে, এ ভরসা কেউ করে না।
গিরিন জিজ্ঞাসা করল তাহলে বলবে তো দিদি ?
আচ্ছা জিজ্ঞেস করবো । দিয়ে যদি তুই উপকার করতে পারিস ভালোই তো, বলিয়ে একটুখানি হাসিয়া বলিলেন ,আচ্ছা তোরইবা এত চার কেন গিরিন?
চাড় আর কি দিদি দুঃখ - কষ্টে পরস্পরের সাহায্য করতেই হয়। বলিয়া সে ঈষৎ সলজ্জ মুখে প্রস্থান করিল দারের বাহিরে এগিয়ে, আবার ফিরিয়া আসিয়া বসিল ।
তাহার দিদি বলিলেন আবার বসলি যে?
গিরিন হাসিমুখে বলিল অত যে কাঁদুনি গাইলে দিদি হয়তো সব সত্যি নয়।
গিরিন বলিতে লাগিল ওদের ললিতা যেরকম টাকা খরচ করে সে তো দুখির মত মোটেই নয় দিদি। সেদিন আমরা থিয়েটার দেখতে গেলুম ও নিজে গেল না তবুও দশ টাকা ওর বোনকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল । চারু কে জিজ্ঞেস করো না কি রকম খরচ করে মাসে ২০-২৫ টাকার কম ওর নিজের খরচই চলে না যে।
মনোরমা বিশ্বাস করিলেন না।
চারু বলিল সত্যি মা ওসব শেখর বাবুর টাকা। শুধু এখন নয় ছেলেবেলা থেকে ওই শেখর দার আলমারি খুলে টাকা নিয়ে আসে কেউ কিছু বলে না।
মনোরোমা মেয়ের দিকে চাহিয়া স্নিগ্ধ ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন টাকা আনে শেখর বাবু জানেন?
চারু মাথা নাড়িয়া বলিল জানেন। সম্মুখেই চাবি খুলে নিয়ে আসে, গেল মাসে আননাকালীর পুতুলের বিয়েতে অত টাকা কে দিলে? সবই তো সই দিলে।
মনোরমা ভাবিয়া বলিলেন কি জানি। কিন্তু একথাও ঠিক বটে বুড়োর মত ছেলেরা অমন চামার নয়, ওরা সব মায়ের ধাত পেয়েছে তাই দয়াধর্ম আছে ।তাছাড়া ললিতা মেয়েটি নাকি খুব ভালো ছেলেবেলা থেকে কাছাকাছি থাকে, দাদা বলে ডাকে ,তাই ওকে মায়া মমতাও সবাই করে । হা চারু তুই তো যাওয়া আশা করিস ওদের শেখরের এই মাঘ মাসে নাকি বিয়ে হবে? শুনেছি,
বুড়ো অনেক টাকা পাবে, চারু বলিল হ্যাঁ মা ,এই মাঘ মাসেই হবে সব ঠিক হয়ে গেছে।