🕯️ অভিশপ্ত বনপথ

🕯️ অভিশপ্ত বনপথ

(একটি ভয়ংকর হরর গল্প)

অধ্যায় ১: রাতের যাত্রা

ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশা ঢাকা সকালগুলো যেন নিঃশব্দে সময়কে গিলে নিচ্ছে।
মাহিরের অফিসে সাত দিনের জন্য ছুটি পড়েছে।
ঘরে বসে গল্প করতে করতে নাসরিন বলল,
— “মাহির, তোমার তো অফিস কাল থেকে বন্ধ, আমরা না হয় কোথাও ঘুরে আসি?”

মাহির হেসে বলল,
— “ঠিক বলেছো। ছুটিটা যদি নষ্ট করি, সেটা অপচয় হবে। ভাবছিলাম ‘সুন্দরবন’ গেলে কেমন হয়?”
নাসরিনের চোখ চকচক করে উঠল,
— “চলো যাই, অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয়নি।”

সেই রাতেই সিদ্ধান্ত হলো—রাত আটটার দিকে তারা রওনা দেবে।
নাসরিন জামাকাপড় গুছিয়ে রাখল, মাহির নামাজ পড়ে গাড়ি প্রস্তুত করল।
গাড়ি ছিল তার নিজের প্রাইভেট কার, তিন দিন আগেই ধুয়ে চকচকে করে রেখেছিল সে।
রাতের অন্ধকারে হেডলাইটের আলো কেটে তারা বেরিয়ে পড়ল শহর ছেড়ে অচেনা পথে।

রাস্তায় গাড়ি চলছিল নিস্তব্ধ রাতে, দুই পাশে শুধু কুয়াশা আর গাছের ছায়া।
রেডিওয় হালকা গান বাজছিল, মাঝে মাঝে নাসরিনের হাই তোলার শব্দ ভেসে আসছিল।
কিন্তু সময় কখন রাত ১টা ৪৫ মিনিটে পৌঁছেছে, তারা টেরই পায়নি।
হঠাৎ গাড়ির ইঞ্জিনে কাঁপুনি, তারপর নিস্তব্ধতা।

মাহির অবাক হয়ে বলল,
— “পেট্রোল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে!”
নাসরিন চমকে উঠল,
— “এই রাতে? এখন আমরা কী করব? হোটেলে যাওয়া উচিত, তুমি অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চালাচ্ছ।”
মাহির বলল,
— “আগে পেট্রোল পাম্প খুঁজে নিই, তারপর হোটেল। গুগল ম্যাপে দেখি...”

মোবাইলের স্ক্রিনে দেখা গেল, কাছাকাছি একটা পেট্রোল পাম্প আছে—মোটে ১.৪ কিলোমিটার দূরে।
“চলো, ওইটায় যাই,” বলে মাহির গাড়ি ধীরে ধীরে চালাতে লাগল।
রাস্তাটা ছিল একদম ফাঁকা, কুয়াশায় ঢেকে।
গাছগুলো এমনভাবে নুয়ে পড়েছে, যেন অন্ধকারের ভিতর থেকে কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

রেডিওর শব্দ হঠাৎ থেমে গেল।
গাড়ির লাইট টিমটিম করে জ্বলে উঠল আবার নিভে গেল।
নাসরিন কাঁপা গলায় বলল,
— “মাহির... এই রাস্তা ঠিক তো?”
মাহির বলল,
— “হ্যাঁ, ম্যাপে তো এই দিকই দেখাচ্ছে...”

ঠিক তখনই রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধাকে দেখা গেল—সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, হাতে একটা লণ্ঠন।
তিনি ধীরে ধীরে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।
মাহির ব্রেক চাপল, গাড়ি হঠাৎ থেমে গেল।
বৃদ্ধা তাকালেন, তারপর ধীরে ধীরে লণ্ঠনটা মাটিতে রাখলেন...

আর তারপর—
এক ঝলক আলো, হেডলাইট নিভে গেল, আর এক মুহূর্তে চারপাশে কুয়াশা গিলে নিল সব শব্দ।

অধ্যায় ২: কুয়াশার ভেতর লুকানো মুখ

সকাল ৭টা।
রোদ উঠেছে, কিন্তু সুন্দরবনের দিকের সেই নির্জন রাস্তা এখনো কুয়াশায় ঢাকা।
একটি পেট্রোলপাম্পের পাশে দেখা গেল মাহিরের গাড়ি—দরজা খোলা, ভেতরে কেউ নেই।
গাড়ির সিট ভিজে, মেঝেতে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছিটে।

থানার এসআই রশিদ ঘটনাস্থলে এসে বলল,
— “গাড়ি লক নেই, কিন্তু চাবি ইঞ্জিনে আছে... কে যেন হঠাৎ বেরিয়ে গেছে।”
তার সহকারী কনস্টেবল তানভীর বলল,
— “স্যার, লোকালরা বলছে, রাতে নাকি ওই রাস্তায় কেউ এক বৃদ্ধাকে দেখেছে, হাতে লণ্ঠন ছিল।”

রশিদ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
তার চোখ পড়ল গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখা একখানা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোয়।
সেখানে লাল কালি দিয়ে লেখা —
“অভিশপ্ত বনপথে আর ফিরে এসো না…”

দুপুরে গাড়িটা টেনে থানায় আনা হলো।
মোবাইল, ব্যাগ, জামাকাপড়—সবই অক্ষত, শুধু মাহির ও নাসরিনের কোনো খোঁজ নেই।
তদন্ত শুরু হলো, ফোন ট্রেস করা হলো—শেষ লোকেশন “বনপথ ১৭ নম্বর সেতু”।
কিন্তু সেই সেতু বহু বছর আগেই পরিত্যক্ত, কেউ ওদিক দিয়ে যায় না।

রশিদ বলল,
— “চলো, একবার জায়গাটা দেখে আসি।”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে।
সূর্য ডুবতে না ডুবতেই চারপাশে ভয়ঙ্কর নীরবতা নেমে এলো।
দু’জন পুলিশ টর্চ হাতে সেতুর দিকে এগিয়ে গেল।
নিচে ঘোলা জল, ওপর দিয়ে হালকা কুয়াশা ভাসছে।

হঠাৎ কনস্টেবল তানভীর চিৎকার করে উঠল—
— “স্যার! দেখুন! ওটা কী?”
সেতুর মাঝখানে একটা ছেঁড়া ওড়না উড়ছে, রক্তে ভেজা।
আর তার ঠিক পাশে মাটিতে আঁচড়ের দাগ—যেন কেউ টেনে নিয়ে গেছে কাউকে।

রশিদ নিচু হয়ে টর্চ ফেলতেই দেখল, ওড়নার নিচে কিছু লেখা—
রক্তে লেখা অক্ষরগুলো ধীরে ধীরে জ্বলজ্বল করছে...
“নাসরিন এখন আমার।”

রশিদের বুক কেঁপে উঠল।
হঠাৎ বাতাস জোরে বইতে শুরু করল, চারপাশে পাতা উড়ছে, আর নদীর জলে কার যেন কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।
কনস্টেবল পিছিয়ে এল ভয়ে, কিন্তু রশিদ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল—
কারণ, নদীর জলে ভেসে উঠেছে একটা মুখ...
চোখ খোলা, ফ্যাকাসে ঠোঁট...

মাহিরের মুখ।

অধ্যায় ৩: বনপথের অভিশাপ

রাত তখন প্রায় নয়টা।
থানার কক্ষে এসআই রশিদ একা বসে পুরনো ফাইল ঘাটছে।
হঠাৎ সে খুঁজে পেল এক দশ বছর আগের রিপোর্ট—
“সুন্দরবন ১৭ নম্বর সেতুর পাশে এক পরিবারের মৃত্যু।”
তিনজন মারা গিয়েছিল—এক বৃদ্ধা, তার ছেলে, আর পুত্রবধূ।

ফাইলের ছবিটা দেখে রশিদের শরীর কাঁপতে লাগল।
ছবির বৃদ্ধা—ঠিক সেই মুখ, যাকে গতরাতে রাস্তায় দেখা গিয়েছিল।
তার নাম ছিল মালতি বেগম।
লোকেরা বলত, পুত্রবধূর সাথে ঝগড়া করে নাকি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরেছিল সে।
কিন্তু মৃত্যুর আগে অভিশাপ দিয়েছিল—

“যে এই পথে রাতে আসবে, সে আর ফিরে যাবে না... আমি তাদের সঙ্গে নিয়ে যাব।”

রশিদ বুঝল, মাহির ও নাসরিন সেই একই পথে গিয়েছিল—
যেখানে মালতি বেগমের আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায়।

পরদিন সকালে রশিদ ও তার টিম আবার ঘটনাস্থলে গেল।
আকাশ মেঘে ঢাকা, বাতাসে অদ্ভুত ঠান্ডা গন্ধ।
সেতুর পাশে এক জীর্ণ কুঁড়েঘর দেখা গেল—যেন বহুদিন কেউ সেখানে যায়নি।
দরজাটা হালকা খোলা, ভেতর থেকে টিকটিকির ডাকের মতো অদ্ভুত শব্দ আসছে।

রশিদ টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকল।
ভেতরে ধুলোমাখা কিছু পুরনো জিনিস, এক কোণে জ্বলছে আধপোড়া ধূপ।
দেয়ালে টাঙানো এক ফটো—মালতি বেগমের।
আর তার সামনে রাখা মাহিরের ঘড়ি... নাসরিনের চুলের ক্লিপ...

কনস্টেবল চিৎকার করে উঠল,
— “স্যার! এগুলো তো ওদের জিনিস!”

ঠিক তখনই পেছন থেকে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল ধপ করে।
ধূপের ধোঁয়া ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল,
আর ঘরের চারপাশে শোনা গেল নারীকণ্ঠে মৃদু হাসি—
“তোমরাও এসেছো... ভালোই করেছো…”

রশিদ টর্চ ঘুরিয়ে দেখল—ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা কাপড়ে মোড়া ছায়া,
লণ্ঠন হাতে, মুখ ঢাকা...
ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, আর ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ হিম হয়ে গেল।

রশিদ গুলি চালাতে গেল, কিন্তু হাত অবশ হয়ে গেল তার।
ছায়াটা কাছে এসে বলল,
“এই পথে কেউ বাঁচে না, পুলিশ সাহেব…”

এক ঝলক আলো, এক বিকট চিৎকার—
আর তারপর নিস্তব্ধতা।

পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা সেই কুঁড়েঘরের পাশে পেল তিনটি মৃতদেহ—
রশিদ, তানভীর, আর আরেকজন অচেনা যুবক।
পরে জানা গেল, সেই যুবকের মুখ মাহিরের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়,
কিন্তু তার বয়স যেন এক রাতেই কুড়ি বছর বেড়ে গেছে…

পুলিশ ফাইল বন্ধ করে দিল “অমীমাংসিত রহস্য” হিসেবে।
আজও মাঝরাতে যদি কেউ ১৭ নম্বর সেতুর রাস্তা দিয়ে যায়,
তারা নাকি দেখতে পায় এক বৃদ্ধাকে—
হাতে লণ্ঠন, মুখে মৃদু হাসি,
আর পাশে দাঁড়িয়ে এক যুবক ও এক তরুণী—
যেন তারা এখনো সেই পথেই ঘুরে বেড়াচ্ছে…

🕯️ শেষ কথা

অভিশপ্ত বনপথে কেউ আর সাহস করে রাতে যায় না।
কারণ, যারা একবার সেখানে থামে...
তারা আর কোনোদিন ফিরে আসে না।