পোস্টস

চিন্তা

সাইবার বুলিং

৪ জুন ২০২৪

প্রসূন রহমান

স্মার্টফোনের যুগে সবাই যেমন ফটোগ্রাফার তেমনি ফেসবুকের দেয়ালে সবাই এখন লেখক। 
কিন্তু অন্যের লেখা কিংবা ব্যক্তিগত ছবির নীচে কি লেখা যাবে আর কি যাবেনা এই বোধটুকু কোনো পাঠ্যক্রম কিংবা লিপিবদ্ধ নীতিমালা থেকে আসেনা। আসে পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিকতার বোধ ও সাধারণ কান্ডজ্ঞান থেকে। যার সম্মিলিত রূপই হলো ব্যক্তির সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতির চর্চা ক্রমবর্ধমান হারে নিম্নগামী।
ক্রমশ ভাসমান হওয়া আমাদের নানা রঙের ভারসাম্যহীন অসংবেদনশীল আচরণগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। প্রমাণ করে, আমাদের নানা মাধ্যমকে অর্থহীন সস্তা বিনোদনের ভাগাড় হিসেবে তৈরি করতে গিয়ে আমরা মূল্যবোধের মূল্যটা হারিয়ে ফেলেছি। প্রমাণ করে, রাষ্ট্র নিজেই যখন ধর্মীয় পরিচয়কে ধারণ করতে শুরু করে তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে সুপিরিয়রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। উপমহাদেশের পুরোটাই এই অসুখে আক্রান্ত। ১৯৪৭ কখনোই‌ আমাদের পিছু‌ ছাড়েনি। ১৯৭১ কে আমরা সবাই হৃদয়ে ধারণ করতে পারিনি।
একই কারনে হয়তো আমাদের সাংস্কৃতিক পথচলাও ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে। আমাদের গণমাধ্যম আর তার অংশীজনেরাও বেশিরভাগ রুচিহীন প্রযোজনার মাধ্যমে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ কালের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন ও মূল্যবোধহীন প্রযোজনার মূল্যবোধহীন দর্শক ও ভক্তকূলের সমারোহ এখন অভিনয় কর্মীদের ফ্যানপেজ জুড়ে।
অনেকবারই এটি প্রমাণিত ‌হয়েছে, গণমাধ্যমে অনেকবার দেখা মুখ মানেই যেমন জনপ্রিয় মুখ নয়, জনপরিচিত মাত্র। তেমনি ফ্যান-ফলোয়ারের দীর্ঘ তালিকা মানেই গুণমুগ্ধ অনুসারী নয়, কিছু বেকার শিক্ষাবঞ্চিত ও বিনোদনবঞ্চিত কৌতুহলী চোখ মাত্র। যাদের বোধবুদ্ধি যেমন সীমিত তেমনি ভাষার ব্যবহারেও অমার্জিত।
পরিচিত মুখদের ফ্যানপেজে এসে যারা সাইবার বুলিং করছে, তারা শুধু রাস্তার মোড়ে শিষ বাজানো গ্রুপটাই নয়। ভদ্রলোকের বেশ ধরে থাকা অনেক ধর্মোণ্মাদ, এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত,  সংস্কৃতজনও সেখানে আছে। তাদের বেশির ভাগ 'সাইবারবুলিং' এর অর্থটা ভালো করেই জানে। তবে এর অপরাধ কতোটা গুরুতর, এর শাস্তি কি, সেটি হয়তো এখনো ঠিক করে জানেনা। কারন, আমরা সেটি জানাতে পারিনি। যারা সবকিছুতে ধর্মকে টেনে আনছেন, তাদের কাছেও আমরা সম্প্রীতির বাণীটা পৌছাতে পারিনি। যারা অসংস্কৃত আচরণ করছেন তাদের কাছে আমরা সংস্কৃতিবোধ, সহনশীলতা আর মানবতাবোধের বাণীটা পৌছাতে পারিনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের আভিজাত্যবোধ, আমাদের আধুনিকতার ধারনা, আমাদের সাহিত্যরুচি, আমাদের বিনোদনের রুচি, আমাদের কন্টেন্টের বিষয়বস্তু তাদের কাছে সেরকম বক্তব্য নিয়ে পৌছাতে দেয়নি। সুপিরিয়র ভাবনা থেকে আমরা কেবল গালি দিতে শিখেছি। সহমর্মিতা ও পরমতসহিষ্ণুতার বিষয়ে কিছু শেখাতে চাইনি। কমিউনাল হারমোনির মতো বিষয়গুলো আমরা আমাদের কন্টেন্টে নিয়ে আসতে পারিনি। 
তবে কিছু মুখচোরাও আছে এইখানে। অনেককে পাওয়া যায়, মুখে রবিঠাকুরের নাম জপলেও আদতে জাকের নায়েকের অনুসারী। তারা হঠাৎ করেই নিজেদের লেজটা দেখিয়ে দেন। অনেকেই আছেন ছদ্ম নামে, ফেইক প্রোফাইল নিয়ে, যাদের পৃথিবীর কোনো দেশেই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। 
কিন্তু কেউ যখন ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হন, তখন আইনের আশ্রয় নেয়াটাই হয়তো সুনাগরিকের কাজ। কিন্তু ভিউ এর বানিজ্যে অনুসারী কমে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই সেটি করছেননা। সেটিও তার একান্ত ব্যাপার।
তবে সেলিব্রেটিদেরও একটু দায়িত্বপ্রবণ হওয়ার সময় এসেছে বলে মনে হয়। তাদের ফ্যানবেজকে শুধু ভেড়ার পাল মনে করে ভাড়ামোসমৃদ্ধ নব নব নাট্যকলা দেখার খবরটা জানিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লে হবেনা। মাঝে মধ্যে একটু সমাজ সংস্কৃতির বিষয়ে আলোকিত করবার চেষ্টাটাও করে যেতে হবে। ইমেজ নির্ভর যে রুটিরুজির পথ, সে ইমেজ ফটকাবাজির নাট্যকলায় কখনো দৃঢ় হয়ে দাঁড়াতে পারবেনা। অন্যের কাছ থেকে মানবিকতা আশা করবার আগে নিজেদেরকেও মানবিক কাজের সাথে যুক্ত করতে হবে। 'সোশ্যাল কজ'গুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। সব পেশা শুধুমাত্র জীবিকার পথ নিশ্চিত করার নয়। যে পেশায় পরিচিতি ও অনুসারী তৈরি হয়, সে পেশায় অনুসারীর প্রতি দায়িত্ব ও তৈরী হয়। 

জানি, প্রত্যাশার সাথে হতাশার সম্পর্ক অনেক গভীর, তবু আশা রাখতে চাই, নানামুখী অর্থপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আমাদের মানবতাবোধ ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। সাবার নিরপত্তা আইন, কারো মুখ বন্ধ করতে নয়, সকল নেটিজেনের স্বাভাবিক নিরাপত্তা ও অধিকারের সুরক্ষা দিতে ব্যবহৃত হবে। 

*
ভূমিকার বদলে
প্র.র/মে ২০২৪