রিশাদের জীবন — পর্ব ৫: স্বপ্ন ও সংগ্রাম
নীরবতার ভিতরে তুমি
রিশাদ সকালে উঠেই জানালার কাঁচ পাখার পালকের মতো ঝকঝকে ধুলো তুলে নিল। বাইরে আকাশটা ম্লান ছিল—সূর্য নিরবে বিশাল সোনালি ছাতা ছুঁয়ে রেখে গিয়ে ম্লান হয়ে আকাশে লুকোচ্ছিপি খেলছিল। রিশাদের মনে একটা অদ্ভুত ভারী চাপ ছিল—মনের ভেতরের আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তব জীবনের দৌড়াবার গতি যেন একে অপরকে ঠেলে দিচ্ছিল। সে জানত, স্বপ্ন বলা সহজ, আর স্বপ্নকে রোজকার জীবনে ঢোকানো কঠিন; তবু আরেকটি দিনের মতো আজও সে সেই পথ বেছে নিয়েছে, যে পথটি ধুলে ঢাকা, পথে ঝড়ও আসে, তবু তার দিকে ডাকে—শিক্ষা, সংগ্রাম, নিজের কোম্পানি আর অন্যদের জন্য কিছু করে দেখানোর আকাঙ্ক্ষা।
রিশাদ এক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মায়ের বাকি পরিত্যক্ত বাটিতে চা ঢেলে হালকা চুমুক নিল। মা যে প্রতিদিন রান্না করত—তারই সেই গন্ধ আজও ক্যানভাস হয়ে যেন তার মনের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। মা যে প্রতিবার বলত—“তুমি যদি হৃদয় দিয়ে বাঁচো, সব কিছু সহ্য করতে পারবে”—এই কথাগুলো তার ভেতরে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে প্রত্যেক শব্দকে কাগজে নামাতে চাইল—কত আদর ছিল, কত ত্যাগ ছিল, তা কি এখন তার কাজে রূপান্তরিত হবে?
কাজে যাওয়া আর কলেজের ফাঁকে বইয়ের দোকানে রাতগুলো কাটাতে করতে করতে রিশাদের জীবনে সন্নিকটে ছোট ছোট বাধা এসে নাড়াতে লাগল। প্রথম ছিল অর্থের সংকট—একটা জরুরি পরীক্ষার ফি জমা ছিল, মা কাটার-চড়াকলি করে জমিয়েছেন, তবু বারবার কোথাও যেন উপরে চাপ পড়ে। দ্বিতীয় ছিল সময়ের সংকট—কাজ, ক্লাস, পড়াশোনা, আর সন্ধ্যায় নিজের লেখা—এইসবই কোনোমতেই একসাথে মানিয়ে নেয়া যাচ্ছিল না। তৃতীয়, আর সবচেয়ে কষ্টদায়ক, ছিল নিঃশব্দে বয়ে আসা এক ধরনের একাকীত্ব—অনিক চলে যাওয়ার শূন্যতা, আর আরিয়ার বিদায়ের কড়া স্পর্শ—এইসব স্মৃতি মাঝে মাঝে তাকে অচেতন করে দিত।
তবু সে থেমে থাকল না। একটি ছোট্ট লক্ষ্য ঠিক করল—প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দুইটি লেখার খসড়া শেষ করবে, আর মাসে একদিন বাড়ির পাশের কমিউনিটি হলের বাইরে ছোট্ট পাঠশালা চালু করার চেষ্টা করবে—ছোট শিশুদের জন্য, যেখানে তারা বিনামূল্যে পড়াশোনা ও কলার কাজ শিখে। এই ভাবনা আদৌ নতুন ছিল না; শৈশব থেকেই লুকিয়ে থাকা একটা ইচ্ছে—শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে বাঁচাতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আজকের তিনি জানতেন, সেই ইচ্ছা যদি বাস্তবে না নেমে আসে তবে তার জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে।
এক সন্ধ্যায়, ক্লাস শেষে, সে হাঁটছিল শহরের তীর ধরে—পথের ধারে এক বৃদ্ধ চা বিক্রি করছিলেন। রং ছেঁড়া কাপে গরম চা—সেই গন্ধে মরে গেল। বৃদ্ধটির মুখে ছিল অদ্ভুত একনিষ্ঠ দুঃখ আর জীবনের গল্প। রিশাদ কেবল চা কাপে হাত রাখল এবং কথা বলল—“দাদা, স্কুল কেমন চলছে?” বৃদ্ধীর চোখে প্রথমবার ছিল একটা রিমঝিম হাসি—“তুই কি স্কুল খুলবি? ওয়ার সবাই কেমন পরীক্ষায় ভালো করে?”—এই কথাবার্তায় রিশাদের মনে হল, এই ছোটো কথাগুলোই শুরুর কাজ। বাড়িতে ফিরে সে নোটবুক খুলে পরিকল্পনার তালিকা লিখতে বসল—কীভাবে একটি ছাদ-তলার ক্লাস রুমে ছেলেমেয়ে বসিয়ে পড়ানো যাবে, কীভাবে পড়ার উপকরণ জোগাড় করা যাবে, স্থানীয় মানুষদের কিভাবে সামিল করা যাবে। প্রতিটি লাইন যেন তার ভেতরকার কণ্ঠে আশার সুর ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
পরের কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল পরিকল্পনা নিয়ে। সে গ্রামের কিছু পুরনো পরিচিতকে জোগাড় করল, পড়ার টেবিল, খাতা, কলম জোগাড় করা শুরু করল—অনেকে হেসে বলল, “তুমি নির্দিষ্ট কিছু করছ না, সময় নষ্ট করছ।” কেউবা বলল, “শহরে থাকলে নিজে কিছু করা উচিত।” তবু সে শুনল না। একদিন আরেকজন কর্মচারী তার দোকান থেকে কয়েকটি পুরনো বই চুরি করে দিবে বলে সাহায্য করল—ছোট ছোট হাতগুলি আনন্দে মেতে উঠল, চোখে নতুন আশা দেখত। সেই ছোট পুরোনো বইগুলো রিশাদের কাছে মণি হয়ে উঠল—প্রত্যেকটি বই যেন বলত, ‘তুমি সঠিক পথে আছো’।
কর্মজীবনের কড়চা কঠিন ছিল। কাজ শেষে ক্লাস, ক্লাস শেষে রাত জেগে লেখালেখি—এমন দিনে কখনও কখনও মনে হত দেহ ক্ষতি পাচ্ছে। তার ঠোঁট কাটা জ্বালা করলেও সে থেমে থাকল না। এক রাত, সে ক্লাস শেষে একজন মেয়েকে দেখতে পেল—ছোট্ট মেয়ে কাঁপছে হাতে কলম ধরে। সে জানতে পারল, মেয়েটির নাম পারভীন; মা অসুস্থ, বাবা ঢাকায় কাজ করে, আর পড়ার উপকরণ নেই। রিশাদের কপি-ভরাট ভাষায় সোজা করে দিল—“তুমি পড়ো, সব ব্যবস্থা আছে”—এই কথায় মেয়েটির চোখে অশ্রু আর কৃতজ্ঞতা মিশে গেল। সেই রাতে রিশাদ কেঁদে ফেলল না; চোখে অদ্ভুত এক শান্তি ঘনিয়ে এসেছিল—ভালোর অনুভূতি, নিজের কাজের প্রমাণ পেয়েছে সে।
কিন্তু সংগ্রামটা চুপ থাকল না। স্কুল চালু করতে গিয়েই স্থানীয় স্কুলের এক শিক্ষক আগ্রাসী ভাবে বলল—“তুমি কি ছোট ছেলে, এই কাজটা তোমার জন্য নয়। বড় স্কুল আছে, তোমার কিছুই হবে না।” রিশাদ স্তম্ভিত হল, কিন্তু তা থেকে পিছিয়ে থাকল না। তিনি সহজ শব্দে বলে দিল—“আমি ছোট হলেও আমি চেষ্টা করতে চাই।” শিক্ষকের সেই কথা তাকে আঘাত দিল, কিন্তু গভীরভাবে লালিত করল—আর একটু বেশি পরিশ্রমের প্রবলতা তুলল। সে রাতদিন মিলিয়ে মোল্ডিং করল পাঠের কক্ষ, নিজে গিয়ে ঘরে ঘরে বোঝাল মানুষদের—শিক্ষা হল একটা ধারাবাহিক বীজ; একদিন ফল দিয়েই দেবে।
প্রচেষ্টা করেই ফল আসতে শুরু করল। ক্লাসে প্রথম দিনে আসে মাত্র পাঁচটি শিশু; পরের সপ্তাহে দশ, আর মাসের শেষে কক্ষ ভর্তি হয়ে গেল এমনকি কিছু বড় মানের নাগরিকও এসেছিলেন বেসিক কম্পিউটার শেখানোর জন্য। বাড়তি ভালো লাগা তখন আসে যখন পারভীন প্রথমবার পুরো কবিতা মুখস্থ করে উপস্থাপন করে; তার মায়ের চোখে রোদের মতো স্বচ্ছ আনন্দ দেখা যায়—এই দৃশ্য রিশাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অনুপ্রেরণাকে পৃথিবীর আলো বানিয়ে তুলল।
তার লেখালেখিতাও বদলে গেল। আগে যেখানে কষ্ট ও চাহিদার ক্যানভাস ছিল, সেখানে এখন দৃশ্যমান মানুষের কাহিনী যোগ হলো। সে লিখল গ্রামের বয়স্ক নারীর গল্প, কর্মজীবনের স্বল্পতর দিনগুলির কথা, আরিয়ার অদৃশ্য প্রতিফলন—সব মিলিয়ে তার শব্দগুলো মানুষের হৃদয়ে ঢুকতে লাগল। অনলাইনে প্রথম কপি আপলোড করলে দুই-তিনজন পাঠক এসে মন্তব্য করল—“ভালো লেখা”, “অনুপ্রেরণাদায়ক”—এই বেশিই ছিল প্রথম ধাপ; তবু রিশাদ জানত, বড় পরিবর্তন করার জন্য সময় দরকার।
একদিন স্থানীয় বাজারে গিয়ে সে একটা ছোট বিতর্কে পড়ল—কয়েক জন বলল, “তুমি অনেক কষ্ট করো, কিন্তু এ জীবন কি শুধু তুমিই বদলাতে পারবে?” রিশাদ হেসে উত্তর দিল, “একজনি না, দশ জন করলে, শত জন করলে, দেখা যাবে—পরিবর্তন স্বাভাবিক।” সেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে সে ভাবল—কতগুলো মানুষের প্রাণে সে একটি আলোর কিরণ জেগে উঠাতে পেরেছে—এটাই তার প্রকৃত অর্জন।
তবে কষ্টগুলোও থেমে থাকলাম না। এক মাসে তার বাবার পরিচিতি থেকে একটি ছোট ঋণের নোটিশ এল—মালিকের তাগাদা, আর কিছু খরচ এসে পড়ল। সে মার্কেটে কাজ বাড়াতে বাধ্য হল, কিন্তু মানসিকভাবে ক্লান্তি বাড়লও। একদিন রাত জেগে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবল—“এই সংগ্রামগুলো একদিন কি ফল দেবে?” তখনই মায়ের কথাগুলো কানে ভেসে উঠল—“তুমি যদি হৃদয় দিয়ে বাঁচো…”—তারাই যেন ফের ছুটে এলো শক্তি। সে কলম ধরল, একটি নতুন অধ্যায়ের খসড়া শুরু করল—এবার বিষয়টা ছিল কেবল নিজের সংগ্রাম নয়; ক্লাসে যেসব শিশুদের চোখে সে আশার আলো দেখেছে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে লিখল।
সেই খসড়া পরে ও অনলাইনে দিল—একজন পাঠক বিস্ময়ে লিখল, “দীর্ঘ সময় পরে আমি এমন সরল কিন্তু গভীর লেখা পড়েছি।” আরেকজন বলল, “তুমি কি সেই রিশাদ? তোমার ছবি দেখে চিনলাম—তুমি আমাদের পাশের গ্রামের ছেলে।” এসব মন্তব্যে সে থমকে গেল—একটা ক্ষুদ্র কিন্তু নিশ্চিত অনুভব—তার কাজ লোকের কাছে পৌঁছাতে শুরু করেছে।
রিশাদের দিনগুলো এখন আগের মতো একরকম নয়; প্রতিটি সকালে উঠেই তার কাছে সেই পাঁচ-পাঁচটি শিশুর মুখ ভেসে ওঠে, তাদের হাসি, তাদের কৌতুহল, তাদের আগ্রহ—এসব দেখে সে জানে—তিনি যদি নিজে না থামে, কেউ থামাবে না। জীবনের সংগ্রাম, অর্থের অভাব, মানসিক ক্লান্তি—এই সব এখন রিশাদের কাছে এক নতুন শক্তিতে পরিণত হয়েছে—কারণ সে শিখেছে, কষ্টই যদি ঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তা শক্তিরূপে ফিরে আসে।
আর একদিন হঠাৎ করেই একটা বড় দলে তাকে লেখা পড়তে বলা হলো—একজন স্থানীয় এনজিওর প্রতিনিধি তার স্কুলটা দেখে আগ্রহ প্রকাশ করল। সাহায্যের প্রস্তাব এলো—পুরনো টেবিল, বই, কিছু ক্ষুদ্র অর্থ। রিশাদ প্রথমবার চোখে অন্বেষণের চেয়ে কাঁদা আনন্দ পেল—কারণ তার এক দীর্ঘ ক্ষুদ্র স্বপ্ন আসতে শুরু করেছে বাস্তবে।
সেই রাতে সে একা বসে খাতা খুলল, কলম ধরল এবং নতুন শিরোনামে লিখল—“স্বপ্ন যদি সংগ্রামে বদলে যায়, তাহলে সে সত্যিই জীবনকে বদলে দিতে পারে।” সেই কলমের প্রতিটি শব্দে ছিল তার সারা দিনে পাওয়া অবকাশ, তার মায়ের কথা, পারভীনের কৃতজ্ঞ চোখ, আরিয়ার স্মৃতি—এগুলো মিলিয়ে তার জীবনের নতুন পর্বের ভিত্তি স্থাপন করল।
পর্ব ৫ শেষ হলো সেই অদ্ভুত সন্ধ্যায়—একটি ছোট্ট স্কুল, পাঁচটি শিশু, এক দমবন্ধ করা রাতে নতুন অধ্যায় লেখার প্রস্তুতি। রিশাদ জানত, নিরন্তর সংগ্রাম আছে, কিন্তু তার ভেতরকার আলো এখন ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠছে—এটাই প্রকৃত জয়।