গুরু চরণ লোকটি সেই ধাতের মানুষ যার সহিত যে কোন বয়সের লোক অসংকোচে আলাপ করিতে পারে । ২-৪ দিনের আলাপে গিরিনের সহিত তাহার একটা স্থায়ী সখ্যতা জন্মিয়া গিয়াছিল । গুরুচরণের চিত্রের বা মনের কিছু মাত্র দৃঢ়তা ছিল না বলিয়া তর্ক করিতেও যেমন ভালোবাসি যেন,পরাজিত হইলেও তেমনি কিছু মাত্র অসন্তোষ প্রকাশ করিতেন না।
সন্ধ্যার পর চা খাইবার নিমন্ত্রণ তিনি গিরিনকে করিয়া রাখিয়া ছিলেন । অফিস হইতে ফিরিতেই তাহার দিবা অবসান হইয়া যাইত । হাত মুখ ধুইয়া বলিতেন ললিতে চা তৈরি হলো মা? কালী যা ,যা , তোর গিরিনমামাকে এইবার ডেকে আন ।তারপর উভয়ে চা খাওয়া এবং তর্ক চলিতে থাকিত।
ললিতা কোন কোন দিন মামার আড়ালে বসিয়া চুপ করিয়া শুনিত। সেদিন গিরিনের যুক্তি তর্ক শতমুখে উৎসারিত হইতে থাকিত। তর্কটা প্রায়ই আধুনিক সমাজের বিরুদ্ধে হইতো সমাজের হৃদয়ে হীনতা ,অসঙ্গত, উপদ্রব এবং অত্যাচার এর সমস্ত সত্য কথা।
একেতো সমর্থন করিবার বাস্তবিক কিছু নাই ,তাহাতে গুরু চরণের উৎপীরিত অশান্ত হৃদয়ের সহিত গিরিনের কথাগুলা বড়ই খাপ খাইতো , তিনি শেষকালে ঘাড় নারিয়া বলিতেন ঠিক কথা গিরিন। কার ইচ্ছে আর না করে নিজের মেয়েদের যথাসময়ে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে। কিন্তু দেই কি করে সমাজ বলছেন দাও, মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে, কিন্তু দেবার বন্দোবস্ত করে তো দিতে পারেন না।
যা বলেছ গিরিন এই আমাকে দিয়েই দেখো না কেন বাড়ি টুকু পর্যন্ত বন্ধক পড়েছে। দুদিন পরে ছেলেমেয়ের হাত ধরে পথে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, সমাজ তখন তো বলবেন না এসো আমার বাড়িতে আশ্রয় নাও। কি বল হে?
গিরিন হয়তো চুপ করিয়া থাকি তো । গুরু চরণ নিজেই বলিতেন খুব সত্য কথা এমন সমাজ থেকে জাত যাওয়াই মঙ্গল। খাই না খাই শান্তিতে থাকা যায় ।যে সমাজ দুঃখীর দুঃখ বোঝেনা ,বিপদে সাহস দেয় না ,শুধু চোখ রাঙায় আর গলা চেপে ধরে সে সমাজ আমার নয় আমার মত গরিবেরও নয়, এ সমাজ বড়লোকের জন্যে ভালো। তারাই থাক আমাদের কাজ নাই বলিয়া গুরুচরন চুপ করিতেন।
যুক্তিতর্ক গুলি ললিতা শুধুই মন দিয়া শুনিতো না ।রাত্রে বিছানায় শুইয়া যতক্ষণ ঘুম না আসি তো নিজের মনে বিচার করিয়া দেখিতো। প্রতি কথাটি তাহার মনের উপর গভীরভাবে মুদ্রিত হইয়া উঠিতেছিল সে মনে মনে বলিত, যথার্থই গিরিন বাবুর কথাগুলি অতিশয় ন্যায় সঙ্গত।
মামাকে সে অত্যন্ত ভালোবাসি তো। সেই মামার স্বপক্ষে টানিয়া গিরিন যা হয় কিছু বলিত সমস্ত ই তাহার কাছে অভ্রান্ত সত্য বলিয়া মনে হইত।
তাহার মামা বিশেষ করিয়া তাহারি জন্য ব্যাতিব্যস্ত হইয়া উঠিতেছে ।অন্য জল পরিত্যাগ করিতেছে তাহার নিরবিরোধি দুখী মামা তাহাকে আশ্রয় দিয়াই এত ক্লেশ পাইতেছে! কিন্তু কেন? কেন আমার জাত যাবে? আজ আমার বিয়ে দিয়ে কাল যদি বিধবা হয়ে ঘরে ফিরে আসি তাহলে তো জাত যাবে না। অথচ তফাৎ কিসের গিরিনের এই সমস্ত কথার প্রতিধ্বনি সে তাহার ভাবাতুরা হৃদয় হইতে বাহির করিয়া আর একবার তন্নতন্ন করিয়া আলোচনা করিতে ঘুমাইয়া পড়িত।
তাহার মামার হইয়া মামার দুঃখ বুঝিয়া যে কেহ কথা কহি তো তাহাকে শ্রদ্ধা না করিয়া তাহার মতের সহিত মত না মিলাইয়া ললিতার অন্য পথ ছিল না। সে গিরিনকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করিতে লাগিল ক্রমশ:গুরুচরণের মতো সেও সন্ধ্যার চা-পানের সময়টির জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত।
পূর্বে গিরিন ললিতাকে আপনি বলিয়ে ডাকিত গুরুচরণ নিষেধ করিয়া বলিয়াছেন ওকে আবার আপনি কেন গিরিন, তুমি বলে ডেকো। তখন হইতে সে তুমি বলিয়া ডাকিতে শুরু করিয়াছিল।
একদিন গিরিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিল তুমি চা খাও না ললিতা? ললিতা মুখ নিচু করিয়া ঘাড় নাড়িলে, গুরু চরণ বলিয়াছিলেন, ওর শেখর দার বারণ আছে মেয়ে মানুষের চা খাওয়া সে ভালোবাসে না। হেতু শুনিয়া যে গিরিন সুখী হতে পারে নাই ললিতা সেটুকু বুঝিতে পারিয়াছিল।
আজ শনিবার অন্যদিনের অপেক্ষা এই দিনটার সভা ভাঙ্গিতে অধিক বিলম্ব হইল । চা খাওয়া শেষ হইয়া গিয়াছিল গুরুচরণ আজ আলোচনায় তেমন উৎসাহের সহিত যোগ দিতে পাড়িতেছিলেন না ,মাঝে মাঝে কি একরকম অন্যমনস্ক হইয়া পড়িতেছিলেন।
গিরিন সহজেই তার লক্ষ্য করিয়া, প্রশ্ন করিল আজ আপনার দেহটা বোধ করি তেমন ভালো নাই?
গুরুচরণ হুকাটা মুখ হইতে সরাইয়া লইয়া বলিলেন কেন ? দেহ তো বেশ ভালোই আছে ।
গিরিন সংকোচের সহিত বলিল তাহলে অফিসে কি কিছু-
না তাও তো কিছু নয়, বলিয়া গুরু চরণ একটু বিস্ময়ের সহিত গিরিনের মুখের দিকে চাহিলেন তাহার ভেতরের উদ্বেগ যে বাহিরে প্রকাশ পাইতেছিল তাহা এই নিতান্ত সরল প্রকৃতির মানুষটি বুঝিতেই পারেন নাই।
ললিতা পূর্বে একেবারেই চুপ করিয়া থাকিত,কিন্তু আজকাল দু একটা কথায় মাঝে মাঝে যোগ দিতেছিল, সে বলিল হা মামা আজ তোমার হয়তো মন ভালো নেই।
গুরুচরণ হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, ও সেই কথা! হ্যাঁ মা ঠিক ধরেছিস বটে, আজ আমার সত্যিই মন ভালো নেই ললিতা ও গিরিন উভয়েই তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল।
ললিতা ও গিরিন উভয়ই তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল।
গুরুচরণ বলিলেন নবীন দা সমস্ত জেনেশুনে গোটা কত শক্ত কথা পথে দাঁড়িয়ে শুনিয়ে দিলেন , আর তারাই বা দোষ কি ছ মাস হয়ে গেল একটা পয়সা সুদ দিতে পারলুম না তা আসল তো দূরে থাক।
ব্যাপারটা ললিতা বুঝিয়াই চাপা দিয়ে ফেলিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। তাহার কাণ্ডজ্ঞানহীন মামা পাছে ঘরের লজ্জাকর কথাগুলো পরের কাছে ব্যক্ত করিয়া ফেলে, এই ভয়ে সে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল তুমি ভেবো না মামা সে-সব পরে হবে।
কিন্তু গুরু চরণ সেদিকে দিয়াও গেলেন না। বরং বিষন্ন ভাবে হাসিয়া বলিলেন পরে আর কি হবে মা। তা নয় গিরিন আমার এই মা টি চায় তার বুড়ো ছেলেটি যেন কিছু ভাবনাচিন্তা না করে, কিন্তু বাইরের লোকে যে তোর দুখী মামার দুঃখটা চেয়ে দেখতেই চায় না ললিতে।
গিরিন জিজ্ঞাসা করিল নবীন বাবু আজ কি বললেন ?গিরিন যে সমস্ত কথাই জানে ললিতা তাহা জানি তো না,
তাই তাহার প্রশ্নটাকে অসঙ্গত কৌতুহল মনে করিয়া অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল ।গুরুচরণ খুলিয়া বলিলেন নবীন রায়ের স্ত্রী বহুদিন হইতে অ আজির্ণ রোগে ভুগিতেছিলেন ব্যবস্থা করিয়াছেন।
অর্থের প্রয়োজন অতএব এই সময়ে গুরুচরণের সমস্ত সুদ এবং আসল দিতে হইবে।
গিরিন কোনকাল স্থির থাকিয়া মৃদু কন্ঠে বলিল একটা কথা আপনাকে বলি বলি করেও বলতে পারিনি, যদি কিছু না মনে করেন আজ তাহলে বলি।
গুরু চরণ হাসিয়া উঠিলেন বলিলেন আমাকে কোন কথা বলতে কেউ কখনো তো সংকোচ করে না গিরিন- কি কথা?
গিরিন বলিল দিদির কাছে শুনেছি, নবীন বাবুর খুব বেশি সুদ। তাই বলি আমার অনেক টাকাই তো অমনি পড়ে রয়েছে, কোন কাজেই আসে না আর তার দরকার না হয় এই লন টা শোধ করেই দিন না?
ললিতা ও গুরুচরণ উভয়েই আশ্চর্য হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন ,
গিরিন অত্যন্ত সংকোচের সহীত বলিতে লাগিল আমার এখন তো টাকার বিশেষ কোনো আবশ্যক নাই, তাই যখন আপনার সুবিধা হবে ফিরিয়ে দিলেই চলবে ওদের আবশ্যক সেজন্যে বলছিলাম যদি-
গুরুচরণ ধীরে ধীরে বলিলেন সমস্ত টাকাটা তুমি দিবে?
গিরিন মুখ নিচু করিয়া বলিল বেশ তো তাদের উপকার হয়-
গুরুচরণ প্রত্যুত্তরে কি একটা বলিতে যাইতে ছিলেন ঠিক এই সময়ে আন্না কালী ছুটিয়া আসিয়া পরিল ।সেজদি জলদি- শেখর দা কাপড় পড়ে নিতে বললেন ,থিয়েটার দেখতে যেতে হবে- বলিয়াই যেমন করিয়া আসিয়াছিল তেমনি করিয়া চলিয়া গেল । তাহার ব্যাগ্রতা দেখিয়া গুরুচরণ হাসিলেন ললিতা স্থির হইয়া রহিলো।
আন্না কালী মুহূর্ত পরেই ফিরিয়ে আসিয়া বলিল কই উঠলে না শেষ দি আমরা সবাই দাঁড়িয়ে রয়েচি যে!
তথাপি ললিতা উঠিবার কোন লক্ষণ প্রকাশ করিল না। সে শেষ পর্যন্ত শুনিয়া যাইতে চায়, কিন্তু গুরুচরণ কালীর মুখের দিকে চাহিয়া একটুখানি হাসিয়া ললিতার মাথায় একটা হাত দিয়া বলিলেন , তাহলে যা মা দেরি করিসনে - তোর জন্য বুঝি সবাই অপেক্ষা করছে।
অগত্যা ললিতাকে উঠিতে হইল । কিন্তু যাইবার পূর্বে গিরিনের মুখের পানে সে যে গভীর কৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল গিরীন্দ্র তাহা দেখিতে পাইল।
মিনিট দশেক পরে কাপড় পরিয়া প্রস্তুত হইয়া সে পান দিবার ছুতা করিয়া আর একবার বাহিরের ঘরে নিঃশব্দ পদক্ষেপ আসিয়া প্রবেশ করিল।
গিরিন চলিয়া গিয়াছে।একাকী গুরুচরণ মোটা বালিশটা মাথায় দিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া আছেন , তাহার মুদিত চক্ষুর দুই পাশ বাহিয়া জল ঝড়িতেছে এই যে আনন্দ অশ্রু ললিতা তাহা বুঝিল বলিয়া তাহার ধ্যান ভেঙ্গে দিল না ,যেমন নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়াছিল তেমনি নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।
অনতিকাল পরে সে যখন শেখরের ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন তাহার নিজের চোখ দুটি ও অশ্রু ভারে ছলছল করিতেছিল।
কালী ছিল না সে সকলের আগে গাড়িতে গিয়া বসিয়া ছিল একাকী শেখর তাহার ঘরের মাঝখানে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া বোধ করি ললিতার অপেক্ষাতে ছিল মুখ তুলিয়া তাহার জল ভারাক্রান্ত চোখ দুটি লক্ষ্য করিল।
সে ৮-১০ দিন ললিতাকে দেখতে না পাইয়া মনে মনে অতিশয় বিরক্ত হইয়াছিল। কিন্তু এখন সে তাহা ভুলিয়া উদ্বিগ্ন হইয়া বলিয়া উঠিল ও কি কাঁদছো নাকি ?
ললিতা ঘার হেট করিয়া প্রবল বেগে মাথা নাড়িল ।
এই কয়দিনের একান্ত অদর্শনে শেখর এর মনের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটিতেছিল , তাই সে কাছে সরিয়ে আসিয়া দুই হাত দিয়া সহসা ললিতার মুখ তুলিয়া ধরিয়া বলিল সত্যিই কাঁদছো যে হল কি?
ললিতা এবার নিজেকে আর সামলাইয়া রাখিতে পারিলো না সেইখানে বসিয়া পড়িয়া আঁচলে মুখ ঢাকিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।