Posts

চিন্তা

কোথায় বিবিসি, আর কোথায় আমরা!

November 10, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

42
View

BBC-র মহাপরিচালক (Director-General) Tim Davie এবং নিউজ বিভাগের প্রধান (CEO of BBC News & Current Affairs) Deborah Turness উভয়েই নিজেদের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। 

BBC-র একটি ডকুমেন্টারি/প্রোগ্রামে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৬ জানুয়ারি ২০২১-র বক্তব্যের কিছু অংশ (Capitol riot-এর প্রসঙ্গে) “মিসলিডিং” উপায়ে এডিট করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বিবিসি দুই হেডের পদত্যাগের মূল কারণ এই অভিযোগ। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয় একটি অভ্যন্তরীণ মেমো বা স্মারক (dossier) লিক হয়েছে যেখানে উল্লেখ আছে BBC-র নিউজ কভারেজে “institutional bias” বা সাংগঠনিক পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে -যেমন ট্রান্সজেন্ডার বিষয়, ইসরায়েল/গাজা বিষয়, ট্রাম্পের বক্তব্যের এডিটিং ইত্যাদি। 

এ বিষয়ে রয়টার্স লিখেছে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠার পর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণ সম্পাদনার ধরন নিয়ে সমালোচনার পর, রবিবার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী এবং নিউজ বিভাগের প্রধান পদত্যাগ করেছেন। 

ডেইলি টেলিগ্রাফে ফাঁস হওয়া বিবিসির এক সাবেক নীতিমালা উপদেষ্টার অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ, ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু এবং ট্রাম্পের একটি ভাষণ কভার করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনের পর থেকেই বিবিসি ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে ছিল। 

ট্রাম্প এই দুই কর্মকর্তার পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়ে তাদের “খুবই অসৎ ব্যক্তি” হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিবিসির ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম প্যানোরামা তার একটি ভাষণের দুটি অংশ সম্পাদনা করে এমনভাবে জোড়া দিয়েছিল যাতে মনে হয় তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারির ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গাকে উসকে দিচ্ছেন। 

বিবিসি নিউজের প্রধান নির্বাহী ডেবোরা টারনেস পদত্যাগের পর ভুলের সব দায়দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে কর্মীদের উদ্দেশে এক ইমেলে লিখেছেন, 'I want to be absolutely clear recent allegations that BBC News is institutionally biased are wrong. (আমি একেবারে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, বিবিসি নিউজ প্রতিষ্ঠানগতভাবে পক্ষপাতদুষ্ট -সাম্প্রতিক এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভুল।' 

অনেকসময় আমরা পশ্চিমা মিডিয়ার সমালোচনা করি। কিন্তু দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতা অনুশীলনে আমাদের দেশের গণমাধ্যম এখনো পাশ্চাত্যের ধারেকাছেও নেই। বাংলাদেশে প্রায়ই দেখি একজনের গবেষণামূলক অনুসন্ধানি রিপোর্ট কোনোপ্রকার ক্রেডিট স্বীকার কিংবা অনুমতি ছাড়াই অন্যরা হুবহু ছেপে দেয়। মিস ইনফরমেশন ও ডিজইনফরমেশন সম্বলিত অজস্র ভুল নিউজ হয়, সেসব নিয়ে প্রতিবাদ জানালেও ভুল স্বীকার বা ভুল থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এখানকার সংবাদমাধ্যমগুলো ক্ষমতা যেদিকে থাকে নিজেদের আত্মস্বার্থে ঠিক সেদিকে ঝুলে থাকে। নিজেদের ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত আত্মমর্যাদা বা প্রতিষ্ঠানের সুনামের দিকে কেউ খেয়াল করে না। সেখানে ভুল নিউজের জন্য পদত্যাগ তো বহু দূরের কথা। কেন এমনটা হয়? 

বাংলাদেশে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের মালিকই সাংবাদিক নন; বরং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত কেউ। ফলে -সাংবাদিকতার নৈতিকতা নয়, বরং মালিকের বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক স্বার্থই সংবাদ নীতি নির্ধারণ করে। রিপোর্টারের অনুসন্ধানী কাজ বা কোনো এক্সক্লুসিভ স্টোরি তাই সহজেই “shared asset” হয়ে যায় -“কে আগে দিয়েছে” সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ, বরং “কোন মালিক রাগ করবে না” সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ভুল খবর বা অন্যের কাজ চুরি -এগুলো নৈতিক বা পেশাগত লঙ্ঘন নয়, বরং “ব্যবসায়িক কৌশল” হিসেবে দেখা হয়। ফলাফল: Accountability বা জবাবদিহি অনুপস্থিত থাকে, কারণ কোনো ভুল প্রকাশের দায় শেষ পর্যন্ত সম্পাদক বা রিপোর্টারের নয়, বরং মালিকের ক্ষমতার ছায়ায় ঢাকা পড়ে। 

অপরদিকে বেশিরভাগ সাংবাদিকের পেশাগত প্রশিক্ষণ নেই। সাংবাদিকতার পাঠ্যক্রমে বা কর্মজীবনে “attribution”, “plagiarism”, “verification”, “correction policy”– এসবের ধারণা দুর্বল। Fact-checking, source validation, data verification -এই পদ্ধতিগত দক্ষতা অনুপস্থিত। আরেকটি বড় বিষয় হলো institutional mentorship নেই। পুরোনো সাংবাদিকরা তরুণদের শেখান না বা শেখানোর কাঠামোই নেই। কার্যত দেখা যায়, একজন রিপোর্টার ভুল খবর করলে সম্পাদক বলেন, “ঠিক আছে, ওয়েব থেকে সরায় ফেলো” -কিন্তু কেউ বলেন না, “কেন ভুলটা হলো?” বা “এবার থেকে কীভাবে এড়ানো যায়?” 

সবার আগে খবর দিতে হবে” -এই হুড়োহুড়ির সংস্কৃতি সাংবাদিকদের যাচাই ছাড়াই খবর ছাপাতে বাধ্য করে। অনেক সময় সম্পাদক বা নিউজরুমের টিমই বলে দেয়, “অমুক চ্যানেলে গেছে, তুমিও দাও” -এটাই হয়ে দাঁড়ায় নরমাল প্র্যাকটিস। বড় বড় নিউজরুমে collective responsibility culture না থাকায়, ব্যক্তিগত ভুল কেউ নেয় না। সবাই দায় এড়াতে চায়। ফলে একজন সাংবাদিকের স্কুপ অন্য চ্যানেলে বা পত্রিকায় কপি হয়ে যায়, অথচ কেউ “source credit” দেয় না -কারণ newsroom-এ এটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্যই করা হয় না। 

আমাদের সামাজিক কাঠামোতেই দায় স্বীকার করার সংস্কৃতি নেই। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী -কেউ ভুল স্বীকার করেন না। সংবাদমাধ্যমও একই ধারায় পড়ে। ফলে সাংবাদিকও ভাবে, “ভুল হতেই পারে, পাঠক ভুলে যাবে।” বরং যিনি ভুল স্বীকার করেন, তাঁকে দুর্বল হিসেবে দেখা হয় -নৈতিক অবক্ষয়ের এটা বড় লক্ষণ। 

বাংলাদেশের মিডিয়া পরিবেশ এখনও গভীরভাবে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন। ভুলের দায়ে পদত্যাগ করবার মতো নৈতিক চাপ এখানকার সাংবাদিকরা অনুভব করেন না, কারণ মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের কাঠামোই রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে গাঁথা। সাংবাদিকতা গিলে নিয়েছে আধিপত্যবাদী রাজনীতি। 

এই সুযোগে ভুল নিউজ বা বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশের মহামারি শুরু হয়েছে। ভুল প্রমাণিত হলেও কেউ ক্ষমা চায় না, সংশোধন প্রকাশ করে না, বরং প্রতিবাদকারীকেই দোষারোপ করা হয়। ফলে পেশাটির মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দিনে দিনে কমছে। পেশাগত জবাবদিহির অনুপস্থিতি, মিডিয়া মালিকদের রাজনৈতিক আনুগত্য, এবং সংবাদপেশাকে আদর্শ নয় বরং প্রভাব ও ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাই এর প্রধানতম কারণ। যখন সাংবাদিকতা সত্যের অনুসন্ধান থেকে সরে এসে ক্ষমতার পদলেহনে পরিণত হয়, তখন ভুল সংবাদ, কারচুপি, নৈতিক অবক্ষয় ও আত্মসন্মানবোধহীনতার সংস্কৃতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন চূড়ান্ত নিমজ্জনের ঠিক ওই পথটিতেই আছে। ঐতিহ্যবাহী, আধুনিক ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম বিবিসির উদাহরণ থেকে আমরা কি কিছুটা হলেও শিখতে পারি? 

লেখক: সাংবাদিক 
১০ নভেম্বর ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login