Posts

চিন্তা

অধস্তন নারী দ্বিগুণভাবে নীরব-- একবার পুরুষতন্ত্রের দ্বারা, আরেকবার রাষ্ট্রের দ্বারা!

November 12, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

34
View

নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে একটি বৈশ্বিক বন্দোবস্ত আছে।
নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ তথা সিডও (CEDAW) সনদে বিশ্বের ১৮৬টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ।

Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women (CEDAW) সনদ অনুযায়ী নারীর ক্ষমতায়নের মূল বিষয়গুলো হলো: সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমতা, শিক্ষায় সমান সুযোগ, কর্মক্ষেত্রে সমতা, পারিবারিক সমতা, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা। ওই সনদের সবগুলো ক্লজ মেনে নেয়া হলেও ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করা বাংলাদেশ সম্পত্তিতে নারী ও পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করবার ধারাটিতে প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠীর বাধার মুখে এখনো মান্যতা দিতে পারে নি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোট কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২ কোটি ৪৬ লাখ এবং ৪ কোটি ৬৪ লাখ পুরুষ কর্মজীবী। মোট কর্মজীবী জনশক্তি: ৭ কোটি ১১ লাখ। তবে নানাবিধ পারিপার্শ্বিক কারণে উদ্বেগজনক হারে দেশে নারী কর্মজীবীর সংখ্যা কমছে। ইউএন উইমেনের সহযোগিতায় ২০২৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত ‘জেন্ডারভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রায় ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ১৮ লাখই নারী, যা মোট চাকরি হারানো মানুষের ৮৫ শতাংশ। বর্তমানে মাত্র ১৯ শতাংশ নারী শ্রমবাজারে সক্রিয়, যা কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এমন এক বাস্তবতায় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, 'তারা ক্ষমতায় গেলে নারীর কর্মঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টায় নামিয়ে আনবেন এবং তাদের জামানায় নারীরা ঘরে থাকলে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে।'

একবিংশ শতকের বাংলাদেশে এই বক্তব্য সময়োচিত নয়ই, বরং সময়ের উল্টো দিকেই হাঁটা। নারীকে ঘরে ফেরানো মানে তার শ্রম, মেধা ও স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা। এবং একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে নারীর শিক্ষা, ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে একেবারে অস্বীকার করা। মানবিক মর্যাদা পুরোদস্তুর রহিত করা।

নোবেল লরিয়েট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন Development as Freedom-এ লিখেছিলেন, “No society can claim to be free if half its population lives in bondage.” বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ৩৭ শতাংশের বেশি। গার্মেন্টস শিল্পে নারীরা দেশের বৈদেশিক আয়ের মূল ভিত্তি। সেই নারীদের ঘরে রাখার চিন্তা আসলে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে পঙ্গু করার আহ্বানের শামিল।

আফগানিস্তানের উদাহরণ স্পষ্ট। নিজস্ব শাস্ত্রানুবর্তী তালেবান নারীদের তথাকথিত “সম্মান” দেখাতে গিয়ে তাদের স্কুল, অফিস ও স্বপ্ন সব বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যে দেখা যায়, এক বছরে দেশটির জিডিপি ২১ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ সমাজের অর্ধাংশ নারীকে অদৃশ্য করলে সমাজও অন্ধ হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন হলো, নারী ঘরে থাকলে কার লাভ? লাভ হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের, রক্ষণশীল রাজনীতির, আর সেই অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর, যারা নারীর অনুপস্থিতিতে নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে চায়।

ভারতীয় সাহিত্যতত্ত্ববিদ ও নারীবাদী চিন্তাবিদ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর বহুল আলোচিত প্রবন্ধ “Can the Subaltern Speak?” (১৯৮৮)-তে লিখেন, "The subaltern woman is doubly silenced -by patriarchy and by the state.” এখানে  তিনি বলেন, সমাজের প্রান্তিক বা “subaltern” নারীরা দ্বিগুণভাবে নীরব -একদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তাদের কণ্ঠরোধ করে, অন্যদিকে রাষ্ট্র ও উপনিবেশিক ক্ষমতাব্যবস্থা তাদের প্রতিনিধিত্ব করবার নাম তাদের কন্ঠরোধ করে।

যে জাতি নারীর অর্ধাঙ্গকে অন্ধকারে রাখে, সেই জাতির অগ্রগতির আলো কখনও পূর্ণতা পায় না। স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখেছিলেন—“আপনারা কি কোনোদিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কী? দাসী! পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? না। আমরা দাসী কেন? কারণ আছে।”

আমাদের নারীদেরকে এই কারণ খুঁজে বের করে প্রতিবাদে সরব হতে হবে। নইলে ঘর গেরস্থালীর যাতাকলে পিষ্ট হয়ে আধিপত্যবাদী পুরুষের দাসানুদাসের বদনামই আজন্ম বয়ে বেড়াতে হবে।

দেশে হাজারো নারী শিক্ষক, বিচারক, প্রশাসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, পুলিশ ও সামরিক অফিসার, কর্পোরেট কর্মকর্তা, গায়ক, অভিনেতা, পোশাক কারখানার ওয়ার্কার, গ্রামীণ শ্রমজীবী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীই নারী। ধর্মভিত্তিক কোনো দল একবার নয় বেশ কয়েকবারও যদি ক্ষমতার পাদপ্রদীপে আসে নারীদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। একসাথে এত পরিবারে মুখে অন্ন জোগানোর ক্ষমতা জামায়াত কেন কোনো রাজনৈতিক দলই রাখে না। সুতরাং এই বাজে বাতচিতে কেবল আলোচনা ও সমালোচনার মাঠ গরম হবে কার্যত দেশটা বৈশ্বিক মানদণ্ড মেনে যেখানে থাকার কথা সেখানেই থাকবে। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিশ্বসমাজ থেকে আমাদেরকে ডা. শফিকুর রহমানদের মতো কেউই বিচ্ছিন্ন করবার অধিকার রাখেন না। যুগ অবশ্যই বদলেছে। মানুষ তার অধিকার সম্পর্কেও বেশ সচেতন হয়েছে। জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, জগতের আয়নায় সবাই এখন সবকিছু দেখতে পায়।

লেখক: সাংবাদিক 
১২ নভেম্বর ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login