ধারণার দাসত্ব
রিশান দিনদিন বুঝতে পারছিল, সে নিজের চিন্তার ওপর এক ধরনের বঞ্চনার মাঝে আটকে রয়েছে। ছোটবেলা থেকে যা শিখেছে, তা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন তোলে নি সে। মা-বাবার কথা, স্কুলের শিক্ষক, বন্ধুদের মতামত, সমাজের নিয়ম-কানুন—সবই একরকম স্বাভাবিক সত্য মনে হতো। কিন্তু কলেজে এসে সে বুঝতে পারল, পৃথিবীটা তার ধারণার চেয়েও অনেক বড় এবং জটিল।
ক্লাসরুমে যখন নতুন কোনো তত্ত্ব বা ধারণা আসত, তখন রিশান দেখতে পেত, বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা একভাবে স্থির—তারা শুধুই পুরনো ধারণা মেনে নেয়, আর নতুন কিছু চিন্তা করতে চায় না। যারা একটু ভিন্ন মত প্রকাশ করে, তাদের দিকে অস্বস্তিকর দৃষ্টিতে তাকানো হত, আবার কখনো কখনো বিরক্তির সুরও শোনা যেত। রিশানেরও মনে প্রশ্ন জেগেছিল, “আমি কি সত্যিই নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারি? নাকি সবাই আমার মতামত মেনে নিতে বাধ্য?”
একদিন বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনে সে জানতে পারল, তার চারপাশের মানুষগুলো একে অপরকে বুঝতে চায় না। সবাই নিজস্ব একটি মন্ত্র অনুসরণ করে, যা হচ্ছে ‘আমার মতটাই সঠিক’। ভিন্ন মত পোষণকারীকে ঘৃণা করা, অবজ্ঞা করা আর তাদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে না করাই তাদের ‘সাধারণ নিয়ম’।
রিশানের মনে এক ঝড় বয়ে গেল। সে উপলব্ধি করল যে, বহু বছর ধরে সে নিজের মনকে বন্দি করে রেখেছে—একটা কাঠামোর মধ্যে আটকে, যেখানে মুক্ত চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। তার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো ফিরে এল যখন স্কুলে কোনো প্রশ্ন করলেই সে হেসে উঠত, কিংবা শিক্ষক বা সহপাঠীদের চোখে দোষ দেখাত। তখন বুঝতে পারত না, সেই ‘প্রশ্ন করা’ ছিল তার মনের একমাত্র মুক্তির পথ।
সময়ের সঙ্গে সে বুঝতে পারল, আমাদের চারপাশের সমাজ এক গভীর বিভ্রান্তিতে বদ্ধ। মানুষ অন্যদের প্রশ্ন তোলার স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে, নিজের ভুল মেনে নেওয়া অস্বীকার করছে, আর অন্ধভাবে পুরনো ধারণায় আটকে আছে। আর এই পরিস্থিতিই হল প্রকৃত ‘ধারণার দাসত্ব’—যেখানে মানুষ নিজের চিন্তা ও যুক্তি না নিয়ে অন্যদের চিন্তা ও বিশ্বাসের দাস হয়ে পড়ে।
এক সন্ধ্যায়, রিশান একটা পুরনো বইয়ের পাতা উল্টে পড়ল—‘বিবেকের স্বাধীনতা’ নামে একটি বই। সেখানে লেখা ছিল, “স্বাধীনতা মানে শুধু বাহ্যিক শৃঙ্খলা থেকে মুক্তি নয়, বরং নিজের অন্তরের চিন্তার বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়া।” এই কথাগুলো তার হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলল। সে বুঝতে পারল, যদি নিজের ভেতরের ভুল বিশ্বাস আর অন্ধকার থেকে বের না আসে, তাহলে সে কখনো সত্যিকারের স্বাধীন হতে পারবে না।
এই উপলব্ধি থেকে রিশান নিজের জন্য এক অটুট সংকল্প করল—সে আর নিজের মনের ওপর অন্যের ভুল ধারণার জঞ্জাল ঝুলতে দেবে না। নিজের ভুল স্বীকার করবে, প্রশ্ন তুলবে, চিন্তা করবে, এবং নতুন করে নিজের মত গড়ে তুলবে। এই প্রতিজ্ঞা তাকে নতুন পথে হাঁটার সাহস দিল, যেখানে সে হতে পারবে নিজের চিন্তার অধিকারী।
চিন্তার প্রশ্ন:
১. কখনো কি নিজের ধারণাকে প্রশ্ন করতে গিয়েও ভয়ের সম্মুখীন হয়েছ? কেন?
২. আপনার চারপাশের মানুষ কি আপনাকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে দেয়?
৩. নিজের মতামত গড়ার জন্য আপনি কী ধরণের কাজ বা অভ্যাস শুরু করতে পারেন?