নবীন রায় সমস্ত সুদ আসল করা ক্রান্তি গুনিয়া লইয়া বন্ধকী কাগজখানা ফিরাইয়া দিয়া বলিলেন ,বলে টাকাটা দিলে কে হে?
গুরুচরণ নম্রভাবে কহিলেন সেটা জিজ্ঞেস করবেন না দাদা বলতে নিষেধ আছে।
টাকাটা ফেরত পাইয়া নবীন কিছু মাত্র সন্তুষ্ট হন নাই ,এটা আশা ও করেন নাই ইচ্ছাও করেন নাই। বরং বাড়িটা ভাঙিয়া ফেলিয়া কিরূপ নতুন অট্টালিকা প্রস্তুত করিবেন তাহাই ভাবিয়া রাখিয়াছিলেন। শ্লেস করিয়া বলিলেন ,তা এখন নিষেধ তো হবেই ভাইয়া, দোষ তোমার নয় দোষ আমার, দোষ টাকাটা ফিরে চাওয়ার নইলে কলিকাল বলেছে কেন।
গুরুচরণ অত্যন্ত ব্যথিত হইয়া বলিলেন ,সে কি কথা দাদা! আপনার টাকার ঋণটাই শোধ করেছি , কিন্তু আপনার দেয়া ঋণ তো শোধ করতে পারিনি।
নবীন হাসিলেন। তিনি পাকা লোক -এ সকল কথা বিশ্বাস করিলে গুড় বেচিয়া এত টাকা করিতে পারিতেন না। বলিলেন সে যদি সত্যিই ভাবতে ভায়া তাহলে এমন করে শোধ করে দিতে না। না হয় একবার টাকা টাই চেয়েছিলাম , সেও তোমার ওই বৌঠানের অসুখের জন্য, আমার নিজের জন্য কিছু নয় বলি কত সুদে বন্ধক রাখলে বাড়িটা?
গুরুচরণ ঘার নাড়িয়া কহিলেন বন্ধক রাখিনি সুদের কথাও কিছু হয়নি।
নবীন বিশ্বাস করিলেন না, বলিলেন ,বল কি শুধু হাতে?
হ্যাঁ দাদা এরকম তাই বটে, ছেলেটি বড় সৎ বড় দয়ার শরীর। ছেলেটি ?ছেলেটি কে?
গুরুচরণ এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না ,মৌন হইয়া রহিলেন যতটা বলিয়া ফেলিয়াছেন ,এতটাও তাহার বলা উচিত ছিল না।
নবীন তাহার মনের ভাব বুঝিয়া মৃদু হাসিয়া কহিলেন ,যখন নিষেধ আছে তখন কাজ নেই। কিন্তু সংসারের অনেক জিনিসই দেখেছি বলে এইটুকু সাবধান করে দেই ভায়া -তিনি যেই হোন এত ভালো করতে গিয়ে শেষকালে যেন ফ্যাসাদে না ফেলেন। গুরুচরণ সে কথায় আর জবাব না দিয়া নমস্কার করিয়া ,কাগজ গুলি হাতে করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন।
প্রায় প্রতিবছরই ভুবেনেশ্বরী এই সময়টাই কিছুদিনের জন্য পশ্চিমে ঘুরিয়ে আসিতেন। তাহার অযির্ণ রোগ ছিল , ইহাতে উপকার হইত । রোগ বেশি নয় নবীন গুরু চরণের কাছে সেদিন কার্যদ্বারের জন্যই বাড়াইয়া বলিয়াছিলেন । যাইহোক যাত্রার আয়োজন হইতেছিল।
সেদিন সকাল বেলা একটা চামড়ার তরঙ্গে শেখর তাহার আবশ্যকীয় জিনিসপত্র গুছাইয়া লইতেছিলেন।
আন্নাকালী ঘরে ঢুকিয়ে বলিল, শেখর দা তোমরা কাল যাবে না?
শেখর তোরঙ্গ হাতে মুখ তুলিয়া বলিল, কালি তোর সেজদিকে ডেকে দে , কি সঙ্গে নেবে টেবে এই সময়ে দিয়ে যাক, ললিতা প্রতিবছর মায়ের সঙ্গে যাইত এবারেও যাইবে তাহাই শেখর জানিত।
কালী ঘাড় নারিয়া বলিলো এবার সেজদি ত যাবেনা।
কেন যাবে না?
কালী কহিল বাহ: কি করে যাবে! মাঘ ফাল্গুন মাসে ওর বিয়ে হবে বাবা বর খুঁজে বেড়াচ্ছেন যে।
শেখর নির্নিমেষ চোখে ইস্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।
কালী বাড়ির ভিতরে যাহা শুনিয়াছিল উৎসাহের সহিত ফিসফিস করিয়া বলিতে লাগিল। গিরিন বাবু বলেছেন যত টাকা লাগে ভালো পাত্তর চাই । বাবা আজও অফিসে যাবেন না, খেয়ে দেয়ে কোথায় ছেলে দেখতে যাবেন গিরিন বাবু সঙ্গে যাবেন।
শেখর স্থির হইয়া শুনিতে লাগিল এবং কেন যে ললিতা আর আসিতে চাহেনা তাহার যেন কতটা কারণ বুঝিতে পারিল।
কালী বলিতে লাগিল গিরিন বাবু খুব ভালো মানুষ শেখর দা। সেজদির বিয়ের সময় আমাদের বাড়ি জ্যাঠামশাই এর কাছে বাধা ছিল , তো বাবা বলেছিলেন আর দু মাস তিন মাস পরেই আমাদের সবাইকে পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াতে হতো, তাই গিরিন বাবু টাকা দিলেন, কাল সব টাকা জ্যাঠামশাই কে বাবা ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেজদি বলছিল আর আমাদের কোন ভয় নেই সত্যি না শেখর দা?
প্রত্যুত্তরে শেখর কিছুই বলিতে পারিল না। তেমনি চাহিয়া রহিলো।
কালী জিজ্ঞাসা করিল কি ভাবছো শেখর দা?
এইবার শেখরের চমক ভাঙ্গিলো ,তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, কিছু না রে । কালি তোর শেষ দিকে একবার শিগগির ডেকে দে বল আমি ডাকছি যা ছুটে যা ।
কালি ছুটিয়া চলিয়া গেল।
শেখর খোলা তোরঙ্গের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করিয়া বসিয়া রহিল, কোন দ্রব্যে তাহার প্রয়োজন ,কোন দ্রব্যে প্রয়োজন নাই ,সমস্তই এখন তাহার চোখের সম্মুখে একাকার হইয়া গেল।
ডাক শুনিয়া ললিতা উপরে আসিয়া প্রথমে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখিল, তাহার শেখর দা মেঝের ওপর একদৃষ্টে মাটির দিকে চাহিয়া স্থির হইয়া বসিয়া আছে। তাহার এরকম মুখের ভাব সে পূর্বে কখনো দেখে নাই। ললিতা আশ্চর্য হইল ,ভয় পাইলো। ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া দাঁড়াইতে, শেখর এসো বলিয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলো।
ললিতা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল আমাকে ডাকছিলে?
হ্যাঁ বলিয়া শেখর ক্ষণকাল স্থির হইয়া থাকিয়া, কহিল কাল সকালের গাড়িতেই আমি মাকে নিয়ে পশ্চিমে যাচ্ছি, এবার ফিরতে হয়তো দেরি হবে । এই চাবি নাও, তোমার খরচের টাকা করি ও দেরাজের মধ্যেই রইল।
শেখর তাহার দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়া একবার কাশিয়া গলাটা পরিষ্কার করিয়া বলিল ,সাবধানে থেকো -আর যদি কোন কিছুর বিশেষ আবশ্যক হয় ,দাদার কাছে ঠিকানা জেনে নিয়ে আমাকে চিঠি লিখো।
অতঃপর দুজনেই চুপ করিয়া রহিল। এবার ললিতার সঙ্গে যাইবে না শেখর তাহা জানিতে পারিয়াছে এবং তাহার কারণটাও হয়তো শুনিয়াছে মনে করিয়া ললিতা লজ্জায় সংকুচিত হইতে লাগিল।
হঠাৎ শেখর কহিল, আচ্ছা যাও এখন ,আমাকে আবার এইগুলো গুছিয়ে নিতে হবে। বেলা হল আজ একবার অফিসে যেতে হবে।
ললিতা খোলা তোরঙ্গের সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বলিল, তুমি স্নান করো গে ,আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।
তাহলে তো ভালই হয় ,বলিয়া শেখর চাবির গোছাটা ললিতার কাছে ফেলিয়া দিয়া ঘরের বাহিরে আসিয়া সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল ,আমার কি কি দরকার হয় তা ভুলে যাও নি ত?
ললিতা মাথায়্ ঝুকাইয়া তো রঙ্গের জিনিসপত্র পরীক্ষা করিতে লাগিল ,সে কথার কোন জবাব দিল না।
শেখর নিতে গিয়া মাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলো ,কালীর সমস্ত সংবাদই সত্য। গুরুচরণ ঋণ পরিশোধ করিয়াছেন সে কথা ও সত্য ।ললিতার পাত্র স্থির করিবার বিশেষ চেষ্টা হইতেছে তাহাও সত্য । সে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করিয়া স্নান করতে চলিয়া গেল।
ঘন্টা- দুই পড়ে স্নানাহার শেষ করিয়া অফিসের পোশাক পড়িতে নিজের ঘরে ঢুকিয়া সে সত্যই অবাক হইয়া গেল।
এই দুই ঘন্টা কাল ললিতা কিছুই করে নাই, তোরঙ্গের একটা পাটির উপর মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়াছিল ,শেখরের পদশব্দে চকিত হইয়া মুখ তুলিয়াই ঘাড় হেট করিয়া রহিল ।তাহার দুই চোখ জবা ফুলের মত রক্তবর্ণ হইয়াছে।
কিন্তু শেখর তাহা দেখিয়েও দেখিলো না ,অফিসের পোশাক পড়িতে পড়িতে সহজ ভাবে বলিল এখন পারবে না ললিতা, দুপুর বেলা এসে গুছিয়ে রাখো।
বলিয়া প্রস্তুত হইয়া অফিসে চলিয়া গেল। সে ললিতার রাঙা চোখের হে তু ঠিক বুঝিয়াছিল, কিন্তু সবদিক বেশ করিয়া চিন্তা না করা পর্যন্ত আর কোন কথা বলিতে সাহস করিল না।
সেদিন অপরাহ্নে মামা দের চা দিতে আসিয়া ললিতা সহসা জড়োসড় হইয়া পরিল ।আজ শেখর বসিয়া ছিল । সে গুরু চরণ বাবুর কাছে বিদায় লইতে আসিয়াছিল।
ললিতা ঘার হেট করিয়া দু বাটি চা প্রস্তুত করিয়া গিরিন ও তাহার মামার সম্মুখে দিতেই ,গিরিন কহিল শেখর বাবুকে চা দিলে না ললিতা?
ললিতা মুখ না তুলিয়াই আস্তে আস্তে বলিল, শেখর দা চা খান না।
গিরিন আর কিছু বলিলো না, ললিতার নিজের কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল, শেখর নিজে এটা খায় না অপরে খায় তাহাও ইচ্ছা করে না।
চায়ের বাটি হাতে তুলিয়া লইয়া গুরুচরণ পাত্রের কথা পাড়িলেন। ছেলেটি বি এ পড়িতেছে ইত্যাদি বিস্তর সুখ্যাতি করিয়া শেষে বলিলেন , অথচ আমাদের গিরিনের পছন্দ হয়নি, অবশ্য ছেলেটি দেখিতে তেমন সুশ্রী নয় বটে, কিন্তু পুরুষ মানুষের রূপ আর কোন কাজে লাগে গুণ থাকলেই যথেষ্ট।
কোনমতে বিবাহটা হইয়া গেলেই গুরু চরণ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচেন।
শেখরের সহিত গিরিনের এইমাত্র সামান্য পরিচয় হইয়াছিল। তাহার দিকে চাহিয়া একটুখানি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, গিরিন বাবুর পছন্দ হলো না কেন ? ছেলেটি লেখাপড়া করছে অবস্থা ভালো এইতো সুপাত্র ।
শেখর জিজ্ঞাসা করিল বটে ,কিন্তু সে ঠিক বুঝিয়া ছিল কেন ইহার পছন্দ হয় নাই এবং কেন ভবিষ্যতেও হইবে না ।কিন্তু গিরিন সহসা সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিল না, তাহার মুখ ঈষৎ রক্তাভ হইল , শেখর তাহা ও লক্ষ্য করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কাকা, কাল মাকে নিয়ে পশ্চিমে চললাম ঠিক সময়ে খবর দিতে যেন ভুলে যাবেন না
গুরু চরণ বলিলেন সেকি বাবা তোমরাই যে আমার সব । তাছাড়া ললিতার মা উপস্থিত না থাকলে তো কোন কাজেই হতে পারবেনা ,কি বলিস মা ললিতা? বলিয়া হাসিমুখে ঘাড় ফিরাইয়া বলিলেন সে উঠে গেল কখন?
শেখর কহিল কথা উঠাতেই পালিয়েছে।
গুরুচরণ গম্ভীর হইয়া বলিলেন পালাবে বৈকি হাজার হোক জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে তো বলিয়া সহসা একটা ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন মা আমার একাধারে যেন লক্ষ্মী সরস্বতী ! এমন মেয়ে বহু ভাগে মিলে শেখরনাথ! কথাটা উচ্চারণ করিতে তার শীর্ন কৃশ মুখের উপর গভীর স্নেহের এমন একটা স্নিগ্ধ- মধুর ছায়াপাত হইল যে ,গিরিন ও শেখর আন্তরিক শ্রদ্ধার সহিত তাহাকে মনে মনে নমস্কার না করিয়া থাকিতে পারিল না ।