Posts

উপন্যাস

ধূসর মেঘের শেষ অধ্যায় পর্ব:০১

November 16, 2025

Eshrat Zaman

20
View

ধূসর মেঘের শেষ অধ্যায় পর্ব ০১‎পর্ব:০১ 
 

‎সময়টা ছিল ২০১৮ সালের এক ঝলমলে সকাল। চারপাশে নতুন প্রাণের স্পন্দন, প্রকৃতির রং যেন সেদিন আরেকটু বেশি উজ্জ্বল। এমনই এক দিনে শুরু হলো থিয়ানের জীবনের এক নতুন অধ্যায়—প্রাথমিক স্কুল পেরিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার দিন। এই নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ, আর নতুন অচেনা মানুষগুলোর মাঝে একটা স্নিগ্ধ উত্তেজনা নিয়ে থিয়ানের হৃদয় নাচছিল। সবকিছুই তার কাছে আজ নতুন এবং ভীষণ সুন্দর মনে হচ্ছিল।
 

‎​“থিয়ান, সকাল হয়ে গেছে। ঘুম থেকে ওঠ! স্কুলে যেতে হবে, আজকে তোর অ্যাডমিশন!” মায়ের পরিচিত, কিছুটা কড়া কণ্ঠস্বর থিয়ানের কানে বাজতেই সে চোখ মিটমিট করে খুলল। খোলা জানালার ফ্রেমে এক টুকরো সোনালী রোদ এসে তার চোখে পড়ল।
 

‎​থিয়ান ভ্রু কুঁচকে ভাবল—সত্যিই সকাল হয়ে গেছে! এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। আর দেরি নয়, আজ তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। দ্রুত হাতে ব্রাশ সেরে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে সে এক লাফে গোসলঘরে প্রবেশ করল।
 

‎​গোসল সেরে থিয়ান যখন বের হলো, তখন তার পরনে তার নতুন স্কুলের ইউনিফর্ম,  পরিপাটি হয়ে নিচে গিয়ে দেখল, তার মা নোয়ারা নূর সকালের নাস্তা নিয়ে বসে আছেন।  তার ছোট্ট বোনটি কাইরা, সেও তার প্রাইমারি স্কুলের দিকে পা বাড়িয়েছে।
 

‎​“এত দেরি কেন থিয়ান? আজ তোর প্রথম দিন, তাড়াতাড়ি কর!” নোয়ারা নূর মেয়েকে দেখে মৃদু ধমক দিলেন।
 

‎​থিয়ান হাসিমুখে টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো। "এইতো মা, এখনই শেষ করছি।"
 

‎​নাস্তা শেষ হতেই মা-মেয়ে বেরিয়ে পড়ল স্কুলের উদ্দেশ্যে। স্কুলের গেটের সামনেটা আজ যেন এক মেলায় পরিণত হয়েছে। নতুন ছাত্রছাত্রী আর উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের ভিড়। নোয়ারা নূর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে থিয়ানকে তার নতুন ক্লাসে পৌঁছে দিলেন। মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললেন, “সাবধানে থাকিস। কোনো সমস্যা হলে আমায় জানাস।”
 

‎​নোয়ারা নূর চলে যেতেই থিয়ান এক বুক কৌতূহল নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করল। যদিও থিয়ানের পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার অভ্যাস নেই, কিন্তু আজকের পরিবেশটা তাকে টানছিল। সে ক্লাসরুমের দৃশ্যগুলো দেখছিল। নতুন বেঞ্চ, দেয়ালে টাঙানো বর্ণমালা আর ফলমূলের ছবি—আর তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়—একেকটি নতুন মুখ। সবাই সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে, হাসছে, নিজেদের পুরোনো স্কুলের গল্প বলছে।
 

‎​থিয়ানের পাশে এসে বসল উর্মি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কিন্তু মুখটা হাসি-খুশি। “হাই, আমি উর্মি,” বলেই সে হাত বাড়িয়ে দিল।
 

‎​“আমি থিয়ান,” বলেই থিয়ানও হাত মেলাল।
 

‎​শুরু হয়ে গেল তাদের গল্প। উর্মি তার পুরোনো স্কুলের মজার সব ঘটনা বলল, আর থিয়ান বলল তার এক দুষ্ট বন্ধুর কথা, যে সবসময় ক্লাসে ঘুমাত। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের মধ্যে একটা মিষ্টি বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। থিয়ানের কাছে স্কুলের প্রথম ক্লাস যেন মনে হলো বহুদিনের চেনা কোনো বন্ধুর সাথে দীর্ঘ আড্ডা।
 

‎​ক্লাসে স্যার এসে সবার সাথে পরিচিত হলেন। যেহেতু প্রথম দিন, তাই পড়াশোনার কোনো চাপ নেই। স্যার-ম্যাডামরা একে একে এসে নিজেদের পরিচিতি দিলেন এবং নতুন স্টুডেন্টদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করলেন। এভাবেই চারটি ক্লাস কেটে গেল, আর থিয়ানের মনে হলো, এই স্কুলটা তার জীবনের 'মাস্তি জোন' হওয়ার জন্য একেবারে পারফেক্ট! সে হাসি-ঠাট্টা আর ফিসফিসানিকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাস শেষ করল।
 

‎​এদিকে, স্কুলের অন্য প্রান্তে...
 

‎​এই একই উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে সাহির। শান্ত, ধীর-স্থির সাহিরকে দেখলে মনে হয়, সে স্কুলের পোশাক পরা এক ভবিষ্যৎ-মুখী সন্ন্যাসী। তার জগৎ বলতে শুধু বইয়ের পাতা আর পরীক্ষার ফল। ক্লাসের এক কোণে বসে আছে সে। তার কাছে নতুন কোনো বিষয় মানেই নতুন জ্ঞান, যা সে গভীর মনোযোগ দিয়ে আত্মস্থ করতে চায়। চারপাশে যে হৈ-হুল্লোড় চলছে, পরিচিত হওয়ার যে আগ্রহ অন্যদের মাঝে, তা সাহিরকে একটুও স্পর্শ করেনি।
 

‎​ক্লাসে তার প্রথম সহপাঠী তার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি আজ আমাদের সাথে টিফিনে ক্যান্টিনে যাবে?”
 

‎​সাহির মুখ তুলে তাকাল। সে বললো হুম চলো,সাহির সবার সাথে মিলেমিশে থাকে,এই সময় তার বিশেষ কোনো বন্ধু নেই,সাহির শান্ত স্বভাবের, প্রথম দিনই ক্লাসের কিছু মেয়ে সাহিরের ওপর ক্রাশ খেয়েছে,কিন্তু সাহির মেয়েদের সাথে তেমন কথা বলে না,ভদ্রভাবে থাকে,,সাহির মনে করে এই বয়সে মেয়েদের সঙ্গ না দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া উচিৎ,  সাহিরের কাছে স্কুল মানে স্রেফ একটা স্থান, যেখানে গেলে স্বপ্নপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা যায়। প্রেম, ভালোবাসা, কৈশোরের চঞ্চলতা—এসব তার কাছে কেবল সময়ের অপচয়। তার নিবিষ্ট লক্ষ্য—একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। এই পথের সামান্য বিচ্যুতিও তার কাম্য নয়।
 

‎​টিফিন আওয়ারের ঘণ্টা বাজতেই থিয়ান আর উর্মি ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো। হাতে হাতে টিফিনবক্স, আর মুখে অদম্য হাসি।
 

‎​“চল, করিডোরে যাই। কী সুন্দর লাগছে স্কুলটা!” থিয়ান বলল।
 

‎​স্কুলের লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছিল কত শত অচেনা মুখ। তার মধ্যেই ছিল থিয়ান আর সাহির।
 

‎​একপাশে, থিয়ান আর উর্মি একটা নতুন জায়গায় দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে। উর্মি হঠাৎ বলল, "জানিস, আমাদের ক্লাসের পেছনের ছেলেটা নাকি তার নাম লিখতে গিয়েও ভুল করে ফেলেছিল!" থিয়ান হাসতে হাসতে প্রায় বেঞ্চের ওপর পড়ে যাচ্ছিল। তাদের হাসির শব্দে যেন পুরো করিডোর মুখরিত। তাদের বিশ্ব ঘুরছে বান্ধবীদের কেন্দ্র করে, তাদের কাছে এই টিফিন আওয়ার মানেই চুটিয়ে আড্ডা।
 

‎​অন্যপাশে, করিডোরের ঠিক মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সাহির। হাতে তার একটা ফাইল, যাতে ভর্তি সংক্রান্ত কিছু কাগজ। তার মাথা নিচু, চোখ তার ফাইলে বা কখনও কখনও নিজের পায়ের দিকে। থিয়ানদের হাসির আওয়াজ তার কানে এল, কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে যেন নিজের তৈরি এক অদৃশ্য বুদ্বুদের মধ্যে রয়েছে, যেখানে প্রবেশাধিকার শুধু বই আর লক্ষ্যের।
 

‎তারা একই ছাদের নিচে ছিল, কিন্তু তাদের চোখ কোনোদিন একে অপরের দিকে ফেরেনি।
 


 

‎​করিডোর ধরে সাহির যখন দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তার হাতের ফাইলটি সামান্য অসাবধানতাবশত হাত থেকে ফস্কে গেল। কাগজগুলো মুক্ত বিহঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সে নিচু হয়ে দ্রুত কাগজগুলো কুড়াতে শুরু করল। ঠিক তখনই, হাসতে হাসতে প্রায় বেঞ্চের উপর পড়ে যাওয়া থিয়ান, নিজেকে সামলে ঘুরে দাঁড়াতেই, তার চোখ গিয়ে পড়ল মাটিতে হাঁটু গেড়ে থাকা সাহিরের উপর।
 


 

‎​এই প্রথম!
 


 

‎​থিয়ান তার উচ্ছল হাসি থামিয়ে একটু অবাক হলো। ছেলেটিকে তার ক্লাসের মনে হলো না। তার শান্ত,  মুখ আর ছড়ানো কাগজগুলোর দিকে এক পলক তাকিয়েই থিয়ান চোখ ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছিল। কারণ, অচেনা মানুষের জীবনে নাক গলানো তার স্বভাব নয়।
 

‎​কিন্তু তখনই ঘটল সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি।
 

‎​সাহির যখন তার শেষ কাগজটি কুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, তখন করিডোরের খোলা জানালা দিয়ে আসা মিষ্টি সোনালী রোদ এসে পড়ল থিয়ানের মুখের উপর। থিয়ানের চুলগুলো পরিপাটি করে বাঁধা ছিল, কিন্তু কিছু ছোট, দুষ্টু চুল (বেবি হেয়ার) রোদ আর বাতাসের কারণে তার কপালে খেলা করছিল। সেই রোদের ঝিলিকে চোখ ছোট ছোট করে উর্মিকে কিছু একটা বলছিল থিয়ান।,
 

‎​চুল বাঁধলেও কপালের পাশে উড়তে থাকা সেই কিউট ছোট চুলগুলো এবং রোদে ঝলমলে থিয়ানের সেই হাসিমাখা মুখ—প্রথমবারের মতো সাহিরের চোখ আটকে গেল সেই চঞ্চল দৃশ্যে।
 

‎​সাহির দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল, যেন কোনো পবিত্র গ্রন্থ থেকে ভুল করে তার দৃষ্টি সরে গিয়েছিল। কিন্তু সেই এক ঝলকের দৃষ্টিতে থিয়ানের হাসিমাখা মুখের এক ঝলক ছবি যেন তার কঠোর, লক্ষ্যভেদী মনের কোণে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও একটা অপ্রত্যাশিত ধাক্কা দিল।
 

‎​থিয়ান উর্মির দিকে ফিরে বলল, "চল, আর এখানে নয়। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।"
 

‎​সাহির তার ফাইল চেপে ধরল। তার মনে শুধু তার আগামী পরীক্ষার কথা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, কপালে উড়তে থাকা সেই ছোট চুল আর মিষ্টি হাসির ঝলকানিটা তাকে সামান্য হলেও অস্থির করে তুলল।তারা একে অপরের দিকে না তাকিয়েই দ্রুত নিজেদের ক্লাসে ফিরে গেল। থিয়ানের মন তখনও উর্মির সাথে করা দুষ্টুমি আর হাসিতে মশগুল। সাহিরের মনে সামান্য অস্থিরতা থাকলেও, তা সে এক মুহূর্তের মধ্যেই দমন করে নিল। তার কাছে এখন ক্লাসের পড়া আর বাড়ির কাজই আসল।
 

‎​বাকি ক্লাসগুলোও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে শেষ হলো। শিক্ষকরা প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দিলেন, আর থিয়ান ও উর্মি সুযোগ পেলেই ফিসফিস করে গল্প করে যাচ্ছিল। বিদায় ঘণ্টা বাজার আগে, উর্মি দ্রুত থিয়ানের হাতে একটি ছোট নোটবুক এবং কলম গুঁজে দিয়ে বলল, "এই নে, তোর মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে দে। কাল আসার আগে আমি তোকে ফোন করব।" থিয়ান হেসে নিজের নম্বরটা লিখে দিতেই দু'জনার মধ্যে নতুন বন্ধুত্বের প্রথম সেতুটি তৈরি হয়ে গেল।
 


 

‎​ঘণ্টা বাজতেই থিয়ান আর সাহির, একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পথে, যে যার বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
 

‎​থিয়ানের বাড়ি
 

‎​সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। স্কুলের নতুন ইউনিফর্ম ছেড়ে থিয়ান তার প্রিয় একটি ক্যাজুয়াল পোশাক পরে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আজ সারাদিনটা যেন একটা রঙিন ঘুড়ির মতো ছিল—উচ্ছ্বল, হালকা আর মুক্ত।
 

‎​নোয়ারা নূর মেয়ের ঘরে এসে দরজায় মৃদু টোকা দিলেন। "কী রে, প্রথম দিন কেমন কাটল? কোনো সমস্যা হয়নি তো?"
 

‎​"না মা, সব একদম ভালো," থিয়ান উঠে বসে হাসিমুখে বলল। "আমার একটা নতুন বন্ধু হয়েছে, উর্মি। সে খুব মজার! আর স্কুলটা তো 'মাস্তি জোন' হবে মনে হচ্ছে!"
 

‎​মা মেয়ের কথায় আশ্বস্ত হলেন। "আচ্ছা, এখন ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসবি। প্রথম দিন মানেই যে পুরোটা সময় গল্প, তা নয়।"
 

‎​"আচ্ছা মা," বলে থিয়ান বইয়ের ব্যাগ খুলল। কিন্তু পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিতে পারছিল না সে। একটু আগেই উর্মির কল এসেছিল। সারা দিনের গল্প, নতুন স্কুলের শিক্ষকদের কথা, আর ক্লাসের পেছনের বেঞ্চের ছেলেটির নাম ভুল করার ঘটনা—সব নিয়ে তাদের দীর্ঘ ফোনালাপ শেষ হয়েছে।
 

‎​হঠাৎ, তার চোখ পড়ল বিছানার এক কোণে রাখা তার স্কুলের ফাইলটির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে করিডোরের সেই দৃশ্যটা তার মনে ভেসে উঠল—মাটিতে ছড়িয়ে থাকা কাগজ, আর হাঁটু গেড়ে দ্রুত সেগুলো কুড়াতে থাকা সেই শান্ত চেহারার ছেলেটি। 'কী যেন নাম ছিল তার? দূর, অচেনা মানুষের নামে আমার কী! সে তো আমার ক্লাসেরও না।' থিয়ান মনে মনে নিজেকে বলল, কিন্তু কেন যেন সেই ছড়ানো কাগজ কুড়ানোর দৃশ্যের সাথে সাথে কপালের ওপর খেলা করা তার নিজের ছোট চুলগুলোর ছবিও তার মনে আসছিল। সে হেসে ভাবল, 'বাহ! আজব তো! আমি কেন ওসব ভাবছি!'—এই ভেবে সে মাথা ঝাঁকিয়ে জোর করে মনোযোগ বইয়ের পাতায় ফিরিয়ে আনল।
 


 

‎​সাহিরের বাড়ি:
 


 

‎​সাহিরের রুটিন ছিল ঘড়ির কাঁটার মতো স্থির। স্কুল থেকে ফিরেই হাত-মুখ ধুয়ে, স্কুলের বইপত্রগুলো গুছিয়ে সে সোজা পড়তে বসল। সন্ধ্যার নাস্তা টেবিলের পাশে রাখা আছে, কিন্তু সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার প্রথম দিনের নোটগুলো একেবারে নিখুঁতভাবে সাজানো চাই।
 

‎​সাহিরের বাবা, ফাহাদ আহমেদ একজন ব্যবসায়ী,ছেলের এই নিবিষ্টতা দেখে খুবই খুশি। "সাহির, প্রথম দিনেই দেখি একদম গভীর পড়াশোনায় মন দিয়েছিস। এটাই তো চাই বাবা! লক্ষ্য থেকে এক চুলও সরবি না।"
 

‎​"জি বাবা," সাহির মৃদু উত্তর দিল।
 

‎​সে মনোযোগ দিয়ে বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণাগুলো পড়ছিল। তার মনোযোগ ছিল ১০০ শতাংশ। কিন্তু হঠাৎ করেই, তার চোখ যেন বইয়ের লাইনের ওপর স্থির হয়েও স্থির হচ্ছিল না। করিডোরের সেই দ্রুত, অপ্রত্যাশিত মুহূর্তটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
 

‎​জানালার সোনালী রোদ, বাতাসের সাথে খেলা করা সেই দুষ্টু ছোট চুল, আর সেই হাসিমাখা মুখ...
 

‎​সাহির এক মুহূর্তের জন্য কলম থামালে। সে ভ্রু কুঁচকে ভাবল, 'আশ্চর্য! আমি কী ভাবছি? এটা মনোযোগ নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই না।' সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ধমক দিল। তার মনে হলো, কোনো এক অদৃশ্য চঞ্চলতা যেন তার শৃঙ্খলিত মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে দ্রুত সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলল।
 

‎​সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল: "বই আর লক্ষ্য ছাড়া অন্য কোনো বিষয় আমার মাথায় আসার কোনো সুযোগ নেই।"
 

‎​সে তার ফাইলটি আরও শক্ত করে ধরল। কিন্তু, থিয়ানের সেই এক ঝলকের হাসি যেন তার মনের গভীরে, কঠোরতার আড়ালে, এক ফোঁটা রং ছিটিয়ে দিয়ে গেল, যা সে নিজেই এখনো বুঝতে পারেনি। নতুন স্কুল, নতুন জীবন—দুজনের জন্যেই নতুন অধ্যায় শুরু হলেও, তাদের জীবনের গল্প দু'টি যে ইতিমধ্যেই একটি করিডোরে এসে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও স্পর্শ করে গেছে, সেই খবর তারা কেউই রাখেনি।
 


 

‎পড়াশোনা শেষ করে সাহির রাতের খাবার খেল এবং নিজের দৈনিক রুটিন অনুযায়ী ঠিক রাত দশটায় বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার ঘরটা ছিল শান্ত এবং পরিপাটি, ঠিক তার মনের মতোই। বালিশে মাথা রাখতেই তার শরীর এলিয়ে পড়ল। দিনের ক্লান্তি হয়তো তাকে দ্রুত ঘুমের রাজ্যে নিয়ে যাবে, এমনটাই আশা করছিল সে।
 

‎​কিছুক্ষণ সে এপাশ-ওপাশ করল। তার অভ্যাস অনুযায়ী, 
 

‎​কিন্তু হঠাৎ, তার মনোযোগের সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল।
 

‎​অন্ধকারের মাঝে, তার বন্ধ চোখের পর্দায় হঠাৎ ভেসে উঠল সেই উজ্জ্বল দৃশ্যটি। করিডোরের জানালা দিয়ে আসা মিষ্টি সোনালী রোদ, বাতাসের সাথে মৃদু দুলতে থাকা থিয়ানের কপালের পাশে উড়ন্ত দুষ্টু ছোট চুলগুলো, আর সেই উচ্ছল, মুক্ত হাসি। মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য দেখা সেই মুখচ্ছবি যেন রাতের নিস্তব্ধতায় আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
 

‎​সাহিরের ভেতরটা যেন সামান্য কেঁপে উঠল। তার কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ মন এই অনাহূত দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কেন বারবার এই অচেনা মুখের স্মৃতি তার লক্ষ্যভেদী চিন্তাকে ব্যাহত করছে?
 

‎​ধড়ফড় করে উঠে বসল সাহির। তার কপালে সামান্য ঘাম জমেছে। সে দ্রুত শ্বাস নিল। নিজেকে ধমক দিল—"এটা কী হচ্ছে? স্রেফ একটা মেয়ের হাসি! এর কোনো গুরুত্ব নেই। এটা কেবল সময়ের অপচয়!"
 

‎​পাশের টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা টেনে নিল সে। ঠান্ডা জলটা এক নিঃশ্বাসে পান করে সে উঠে দাঁড়াল। সে জানালার দিকে তাকিয়ে কিছু সময় দাঁড়াল, তারপর নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। সে নিজেকে বোঝাল, এই ধরনের কৈশোরের চঞ্চলতা তার লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা হতে পারে না।
 

‎​টেবিলের ওপর রাখা তার বইগুলোর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সে যেন নতুন করে শক্তি খুঁজে পেল। সে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। এবার সে জোর করে তার আগামী দিনের পড়ার রুটিন নিয়ে ভাবতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর, সেই হাসিমাখা মুখচ্ছবিটি ম্লান হয়ে আসতে শুরু করল, আর সাহিরও এক গভীর ঘুমের কোলে নিজেকে সঁপে দিল।
 


 

‎​এদিকে, থিয়ানের বাড়িতে তখন অন্যরকম পরিবেশ।
 

‎​উর্মির সাথে দীর্ঘ ফোনালাপের পর, রাত তখন প্রায় এগারোটা। থিয়ান ল্যাপটপে তার প্রিয় একটি কমেডি মুভি দেখছিল। কিছুক্ষণ পর, তার ছোট্ট বোন কাইরা এসে তার ঘরে ঢুকল।
 

‎​"আপু, মা বলেছে এখন ঘুমিয়ে যেতে!" কাইরা শান্ত গলায় বলল।
 

‎​"আহ, যা তো! আর দু'মিনিট, প্লিজ!" থিয়ান মনোযোগ না হারিয়েই বলল।
 

‎​কাইরা তখন সোজা তার ল্যাপটপের চার্জিং সকেটে হাত দিল—এবং মুহূর্তের মধ্যে সকেট থেকে ল্যাপটপের প্লাগটা টেনে বের করে দিল!
 

‎​মুভিটা ঠিক যখন ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছেছে, তখনই সব অন্ধকার। থিয়ান অবাক হয়ে দেখল তার মুভি বন্ধ হয়ে গেছে।
 

‎​"কাইরা!" থিয়ান চিৎকার করে উঠল। "তুই এটা কী করলি!"
 

‎​কাইরা হাসতে হাসতে দৌড়ে পালাচ্ছিল। থিয়ান বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বোনের পেছনে ছুটল।
 

‎​hallways! দু'বোন ছুটতে ছুটতে ডাইনিং টেবিলের পেছনে, সোফার আড়ালে লুকোচুরি খেলতে শুরু করল। তাদের হাসির শব্দে নোয়ারা নূরের ঘুম ভেঙে গেল।
 

‎​নোয়ারা নূর দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন, দুই মেয়ে হাঁপাচ্ছে এবং হাসছে।
 

‎​"থিয়ান! কাইরা! এ কী হচ্ছে মাঝরাতে? কাল তোদের স্কুল আছে না? এক্ষুনি নিজেদের ঘরে যা!" মায়ের ধমক শুনে দু'জনেই থমকে গেল।
 

‎​থমকে গেলো,থিয়ান বললো "মা, কাইরা আমার মুভি বন্ধ করে দিয়েছে!"
 

‎​"চুপ! আজ প্রথম দিন, তাই ক্ষমা করলাম। কাল থেকে রাত দশটার পর এসব হবে না। যা, এখন ঘুমিয়ে পড়!"
 

‎​মায়ের ধমক শুনে কাইরা জিভ ভেঙিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। থিয়ানও হেসে নিজের ঘরে ফিরে এল। সে হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আজকের দিনের এই শেষ দুষ্টুমিটুকু তার কাছে একদম পারফেক্ট মনে হলো। ল্যাপটপের কথা ভুলে, হাসির রেশটুকু মনে রেখেই, সেই চঞ্চল স্বভাবের মেয়েটি অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
 

‎পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন।
 

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Taspia Akter 2 weeks ago

    অনেক সুন্দর পরের পর্ব দ্রুত দাও আপু❤️‍🩹