আদালতের রায়ে যদি গণমানুষের অধিকার ফেরে, সুশাসন নিশ্চিত হয়, মানবাধিকার রক্ষা পায়, শুভবোধ জাগে, মানুষে মানুষে লোভ, হিংসা, ক্ষমতার দম্ভ ও ঘৃণা রহিত হয়ে মমতা এবং ভালোবাসা মুক্তি পায় -তবে ওই রায় সর্বমহলে প্রশংসা পাবে। কোথাও যদি এতটুকু পরিবর্তন সূচিত না হয় তবে কোনো কিছুই ইতিবাচক মানে তৈরি করবে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, আইসল্যান্ডের নারী রাষ্ট্রপতি ভিগদিস ফিনবগাদত্তির, জার্মানীর চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল, আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি ম্যারি ম্যাকলিস, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি এলেন জনসন সারলিফ, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো, বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা (প্রধানমন্ত্রীর সমমান) অং সান সুচি কারোরই বিরুদ্ধে তাদের নিজেদের দেশের আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়নি। এই নারী শাসকদের কেউ কেউ অপঘাতে মারা গেছেন, কেউবা ক্ষমতাসীনদের কাছে গৃহবন্দি আছেন -তবে অধিকাংশ শাসকই তাদের দীর্ঘদিনের মেয়াদ শেষে সম্মান ও গৌরবের সাথে অবসর জীবনযাপন করছেন।
এদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম শেখ হাসিনা। যিনি দেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের কন্যা পরিচয়ে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে একটানা ১৫ বছরের অধিককাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন এবং ৪৪ বছর ধরে দলীয় প্রধানের পদ ধরে রেখেছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে দৃশ্যমান প্রায় সবাই চাটুকারিতা ও দালালিতে তার চোখের সামনে টিনের চশমা ঝুলিয়ে রাখতেন। ওই কঠিন চশমা ভেদ করে তিনি ন্যায়-অন্যায় ও শ্রেয়বোধ ঠিকঠাক দেখতে পেতেন না। যার পরিণতি জুলাই গণ-আন্দোলন এবং আজকের মৃত্যুদণ্ডের সাজা। তার বাবার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যিনি ২৩ বছরের পাকিস্তান আমলে জনগণের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে ১৩ বছরই কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন -সেই তিনি স্বাধীনতার পর নিজের দলের লোকদের আলগা সুবিধা দিতে গিয়ে চারিধারে বিপুলসংখ্যক সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেন। যাদের একাংশ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আইন নিজের হাতে তুলে নেয়।
শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে দেশের জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশকে নিজের শত্রু বানিয়ে ফেলেন। যেটির মীমাংসা তার বাবাই করে গিয়েছিলেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস তিনি শত্রুপক্ষ বলে যাদেরকে দূরে ঠেলে রেখেছিলেন, সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর করেছিলেন -তারাই এখন ক্ষমতাসীন হয়ে গিয়ে ঠিক ওই একই ট্রাইব্যুনালে তাদের লিডারদের অনুরূপ সাজা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও নিশ্চিত করেছে।
শেখ হাসিনা বা আ.লীগ এখন মুখে যতই ক্যাংগারু কোর্ট বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক -ওই কোর্ট যে বাঘ বা সিংহ নয় এটা প্রমাণ করবার দায় পুরোটাই এখন সাজা পাওয়া গ্রুপের।
সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন। তাহলে হাজার মানুষের কান্নার হিসাবও তাকেই চোকাতে হবে বৈকি। তিনি নিশ্চয়ই আজকের বিচার চলাকালীন জুলাই গণ-আন্দোলনে নিহতদের স্বজন এবং আহতদের চোখে আনন্দের কান্না দেখেছেন।
আজকের এই রায় ৭৮ বছর বয়সী প্রায় অশীতিপর একজন নারীর জন্য বড় লজ্জা, অমর্যাদা ও অগৌরবের। আমরা বিশ্বের ইতিহাস থেকে অন্য নারী শাসকদের কার্যবিধি পাঠ করে তার মতো ক্ষমতাচ্যুতি, দেশ থেকে চলে যাওয়া এবং মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়া আর কারো ক্ষেত্রেই দেখি না। আমরা জানি না এর প্রায়শ্চিত্ত ও অনুশোচনা তিনি ঠিক কিভাবে করবেন?
ইতিহাস পাঠ থেকে আমরা জানি, স্কটল্যান্ডের রানী মেরি স্টুয়ার্ট, ইতিহাসে বিখ্যাত নারীদের মধ্যে অন্যতম -যাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৫৮৭ সালে, তাকে বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাজনীতির ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মেরি স্টুয়ার্টের দণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল গিলোটিনে। এই ঘটনা ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের শাসনামলে ঘটে।
এন বোলিন ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি অষ্টমের দ্বিতীয় স্ত্রী -যিনি ইতিহাসে আরও এক বিখ্যাত নারী যার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। তাকে বিশ্বাসঘাতকতা, ব্যভিচার এবং যাদুবিদ্যা চেষ্টার অভিযোগে ১৫৩৬ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হয়েছিল গিলোটিনে।
সোফি শোল ছিলেন নাজি বিরোধী আন্দোলন "হোয়াইট রোজ" এর একজন সদস্য। ১৯৪৩ সালে তাকে এবং তার ভাইকে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রচারমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তারা নাজি সরকারের বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড ছড়িয়ে দিয়েছিল।
এলিজাবেথ উইনস্টন, যিনি গ্রেট ব্রিটেনে ১৮০০ সালের দিকে বেশ বিখ্যাত ছিলেন, তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এবং খুনি হিসেবে অভিযোগ ছিল, এবং তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
অনেকেই মনে করেন ক্লিওপেট্রা, মিশরের শেষ ফ্যারাও, আসলে মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। যদিও তার মৃত্যু ছিল আত্মহত্যা, তবে সে সময় রোমান সম্রাট অগাস্টাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল। ক্লিওপেট্রা -ইতিহাসে সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিরল সমন্বয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৬৯ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ অব্দ পর্যন্ত তিনি মিশর শাসন করেন। রোমের জুলিয়াস সিজার ও মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে মিশরের স্বাধীনতা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মিশর রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়।
বিশ্বের যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বেশি দেওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। কঠোর এ সাজা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড রহিত করে যাবজ্জীবন কারাবাস করেছে। নারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ এ সাজা দেওয়া নিয়ে সমালোচনা থাকলেও দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো নারীর ফাঁসির সাজা কার্যকর হয়নি। বিচারিক আদালতে তাদের রায় হলেও হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে সাজা রহিত হয়ে যাবজ্জীবন অথবা খালাস হয়ে যায়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত কারা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন কারাগারের কনডেম সেলে (কয়েক ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের ছোট কক্ষ) বর্তমানে ৮২ জন নারী মৃত্যু আর জীবনের প্রহর গুনছেন। তাদের প্রায় সবাই হত্যা মামলার আসামি। আর কনডেম সেলে নারী আসামিদের এ সংখ্যা এখন ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৫-১০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে বন্দি আছেন অন্তত ৫৪ জন নারী। এছাড়া দুটি কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে ফাঁসির অপেক্ষায় থাকা দুই নারী বন্দির সঙ্গে বড় হচ্ছে দুই শিশু।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অথবা পরের নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের নির্বাসন থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করতে পারবে কিনা সেটি সময়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ভারত সরকার তাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থী মিত্র শাসককে সাধারণত বিপদের মুখে ঠেলে দেয় না। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার এখন সমূহ বিপদ। কাজেই দায়মুক্ত হয়ে দেশে ফেরাটা অত সহজ হবে না।
তবে এই রায়ের মাধ্যমে ভবিষ্যত শাসকরা যদি শিক্ষা নেন এবং বাংলাদেশ স্বৈরশাসন মুক্ত হয় -সেটি হবে প্রাণ হারানো এবং আহত হওয়া ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের সার্থকতা। অন্যথায় যেই লাউ সেই কদু ছাড়া বাংলাদেশের কপালে ভিন্নতর রাজনৈতিক ইতিহাস কখনোই অঙ্কিত হবে না।
লেখক: সাংবাদিক
১৭ নভেম্বর ২০২৫
34
View