সুন্দর ধরিত্রীতে নদীর অবস্থান কোথায়? ঠিক ধরেছেন সর্বংসহা মৃত্তিকার বুকজুড়ে 'নীল আকাশের নিচে'। ওই শিরোনামের একটি বাংলা চলচ্চিত্রে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি গান আছে। নদীর সাথে মানুষের আত্মিক বন্ধন নিবিড়তর করে রাখবার চমৎকার উদাহরণ এই গানটি শোনেনি এমন বাঙালি হয়ত একজনও পাওয়া যাবে না।
ও নদীরে,
একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে
বলো কোথায় তোমার দেশ
তোমার নেই কি চলার শেষ
তোমার কোনো বাঁধন নাই
তুমি ঘর ছাড়া কি তাই
এই আছো ভাটায় আবার এই তো দেখি জোয়ারে।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি', তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা', সমরেশ বসুর 'গঙ্গা', সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাস আমাদের অনেকেরই পড়া। এসব কথাসাহিত্যে নদী ও মানুষের চিরায়ত সম্পর্কের মধুরতম আখ্যান বর্ণিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১১১ বছর আগে নদীর যে বর্ণনা দিয়ে গেছেন, তার কিছু বাস্তবতা আটেপক্ষে আমরা এখনো খুঁজে পাই। ছিন্নপত্রতে কবি লিখেছেন, ‘নদী পর্যন্ত একটি গড়ানে কাঁচা ঘাট, সেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ নাইছে, কেউ বাসন মাজছে; কোনো কোনো লজ্জাশীলা বধূ দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসি কাঁখে জমিদার বাবুকে সকৌতুকে নিরীক্ষণ করছে। তার হাঁটুর কাছে আঁচল ধরে সদ্যঃস্নাত একটি তেলচিক্কণ বিবস্ত্র শিশুও একদৃষ্টে বর্তমান পত্রলেখক সম্বন্ধে কৌতূহল নিবৃত্তি করছে। তীরে কতগুলো নৌকা বাঁধা এবং একটি পরিত্যক্ত জেলেডিঙি অর্ধনিমগ্ন অবস্থায় পুনরুদ্ধারের প্রতীক্ষা করছে।’
ঠিক এই একই বর্ণনা রবিঠাকুর তাঁর 'আমাদের ছোটো নদী' কবিতাটিতেও এভাবে দেন:
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
নদীকে ভাবের বাহন করে নেয়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা 'নদী' কবিতায় কী বিস্ময়করভাবে নদীর আত্মদর্শন তুলে ধরেন:
ওরে তোরা কি জানিস কেউ
জলে কেন ওঠে এত ঢেউ।
ওরা দিবস-রজনী নাচে,
তাহা শিখেছে কাহার কাছে।
বাংলা সাহিত্যের মূলে আছে নদী। এই নদী কখনো মাতৃসম স্নেহবতী, কখনো বিধ্বংসী রুদ্ররূপে প্রকট, আবার কখনো আত্মজিজ্ঞাসার নীরব প্রতীক। বাংলার ভূগোল যেমন নদীনির্ভর, তেমনি এর সাহিত্যও নদীমাতৃক চেতনার ধারক। প্রাচীন পাল ও মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ কিংবা সমকালীন লেখক -সবাই নদীর সঙ্গে এক অন্তর্লীন সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
প্রাচীন বাংলার কাব্য সাহিত্যে নদী উপস্থিত প্রকৃতি ও বিশ্বাসের মিলিত রূপে। চণ্ডীমঙ্গল বা মনসামঙ্গল–এর কাহিনিগুলোয় নদী শুধু ভৌগোলিক উপাদান নয়, দেবতার অনুগ্রহ ও অভিশাপের বাহকও বটে। নদী পার হওয়া, ভাটিয়ালি গান, কিংবা মনসার পূজার আয়োজন -সবই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক জীবনজগতের বর্ণনা দেয়। লোকসাহিত্যে নদী মানে জীবিকা, প্রেম, অপেক্ষা ও অনিশ্চয়তার এক সুষম সম্ভার।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি'র এই কথকতাটি সকলকালকেই প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
'ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ ঠিক ঈশ্বর যাদের বরাবর পক্ষ হয়ে থাকেন সেই ভদ্রপল্লীর লোকেরাই নদীকে নিজের মনে করে কাটাছেঁড়া করছে। ভোগের উপকরণ বানিয়েছে। আর যেখানে কথাকারের ভাষায় ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানকার নিরীহ লোকেরাই এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে।
বাংলাদেশ একসময় পরিচিত ছিল নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। 'নদীই বাংলাদেশ' -এই বাক্য শুধু ভৌগোলিক বাস্তবতা নয়, ছিল এক সাংস্কৃতিক পরিচয়ও। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ শত শত নদী এই ভূখণ্ডের কৃষি, মৎস্য, পরিবহন ও মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু আজ সেই নদীগুলোর প্রাণ নেই। প্রবাহ থেমে গেছে, নাব্যতা হারিয়েছে, পানি কালো হয়ে গেছে। নদী দখল, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রশাসনিক উদাসীনতায় বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থা এখন মৃত্যুপথযাত্রী।
রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা একসময় ছিল জীবন ও বাণিজ্যের ধমনী। এখন সেই নদীগুলো কালো পানি ও দুর্গন্ধে ভরা। শিল্পবর্জ্য, ট্যানারি ও প্লাস্টিক বর্জ্যে প্রতিদিন হাজার হাজার টন বিষ ঢালা হয় নদীতে। দূষণের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, অনেক জায়গায় নদীর পানি আর পানির মতোও নেই -নরম, কালো কাদা হয়ে গেছে।
বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধারে বহু প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। নদীর তীরে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন স্থাপনা, বালু ভরাট করে নদী গিলে খাচ্ছে দখলদাররা। জাতীয় নদী কমিশনের হিসাবে, দেশে প্রায় ৫০ হাজার নদীদখলকারী চিহ্নিত, কিন্তু আইনি ব্যবস্থা খুবই সীমিত।
রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী রাজধানীর সন্নিকটে গাজীপুরে ১৯টি নদী আছে। তুরাগ, চিলাই, লবণদহ, বালু, শীতলক্ষ্যা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, খিরো, পারুলী, সুতী, বানার, নাগদা, লৌহজং, বংশী, সালদহ, সুতিয়া, গোল্লার, নালজুড়ি, কনাই ও টঙ্গী নদী। এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এর মধ্যে তুরাগ, লবণদহ, চিলাই ও বংশী বেশি দূষিত। আমরা তুরাগ নদে প্রায় ২৯৬টি দূষণের উৎস পেয়েছি, লবণদহে ১৪৫টি আর চিলাই নদে ৫৬টি। দূষণ পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে কারখানা, বাজার ও গৃহস্থালির বর্জ্যসহ পয়োনালি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বালু উত্তোলন ও অবহেলিত নদী ব্যবস্থাপনার কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নদী শুধু স্থানীয় নয়, আন্তঃসীমান্তের গুরুতর বিষয়। উজানে ভারতের বিভিন্ন বাঁধ ও ব্যারেজের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রাকৃতিক প্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গঙ্গা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, মহানন্দা -সব নদীতেই এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না বললেই চলে। বর্ষায় আবার অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।
এই অনিয়মিত প্রবাহ কৃষি, মৎস্য ও নৌপরিবহনকে ধ্বংস করছে। নদীর তলদেশে জমে থাকা পলি নাব্যতা নষ্ট করছে, ছোট নদীগুলো শুকিয়ে পরিণত হচ্ছে খালে কিংবা ডোবায়। গ্রামীণ নৌযানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, নদীভিত্তিক জীবনধারা বিলুপ্তির পথে।
নদী শুধু জলজ আধার মাত্র নয় -একটি সভ্যতারও প্রাণ। ইলিশ, রুই, বোয়াল, চিংড়ির মতো দেশি মাছ নদীর সঙ্গে জড়িত। এখন সেই নদীগুলো মরে যাওয়ায় দেশি মাছের প্রজাতিও হারিয়ে যাচ্ছে। নদীভিত্তিক পেশা জেলে, মাঝি, নৌকার কারিগর, ঘাট শ্রমিক -সবাই পেশা বদল করছে। নদীপাড়ের কৃষিজমি উর্বরতা হারাচ্ছে, পানি সংকটে গ্রামীণ অর্থনীতি টালমাটাল।
এভাবে নদীর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্য -নৌকা বাইচ, বর্ষার গান, নদীউৎসব কিংবা নদীর গল্প। একটি জীবন্ত সভ্যতা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হচ্ছে।
নদী রক্ষায় নীতিমালা থাকলেও বাস্তব প্রয়োগ নেই। নদী কমিশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন -সব সংস্থা একে অপরের দায়িত্ব এড়িয়ে চলে। বহু নদী উদ্ধার প্রকল্প শেষ হয় ফাইলেই। দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান হলেও কিছুদিন পর তারা আবার ফিরে আসে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নদী দখল এখন একেবারেই ‘খোলামেলা গোপন রহস্য’। অথচ দেশের প্রচলিত আইন বলছে, নদী জনসাধারণের সম্পদ -কেউ এর মালিক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতার অংশীদার, তথাকথিত সেই ভদ্রপল্লীর লোকেরাই নদীর মালিকানা ভোগ করছে।
নদী বাঁচানো শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই জরুরত নয়, এটি মানুষের টিকে থাকবার এক অনিবার্য লড়াই:
১. সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা নিতে হবে -প্রতিটি নদীর জন্য আলাদা ডেটাবেজ, মানচিত্র ও রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা জরুরি।
২. দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে -আইনি কাঠামো শক্ত করতে হবে।
৩. শিল্পবর্জ্য শোধনাগার (Effluent Treatment Plant) বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. আন্তঃসীমান্ত নদীর ন্যায্য পানি বণ্টনে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করতে হবে।
৫. স্থানীয় জনগণ ও নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে নদী রক্ষার কাজে -কারণ নদী শুধু সরকারি প্রকল্প নয়, এটি জনগণের অধিকার।
বাংলাদেশের নদীগুলো আজ আমাদের অপরাধবোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় যেসব নদী এই ভূখণ্ডে প্রাণ সঞ্চার করেছিল, আজ তারা যেন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। নদী হারানো মানে শুধু জলাধার হারিয়ে ফেলা নয় -এটি একটি জাতির আত্মহননেরই করুণ শোকগাথা। কাজেই এখনই সময় নদীকে কেন্দ্র করে নতুন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার। নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও -এটিই আমাদের সমস্বর স্লোগান।
বাংলা সাহিত্যে নদী কখনো কাব্য, কখনো কান্না, কখনো রক্তিম ইতিহাস। এটি শুধুই প্রকৃতির বর্ণনা নয়; এর অবস্থান বাংলার আত্মপরিচয়ের মূল কেন্দ্রে। নদী যেমন ভৌগোলিক বাস্তবতা, তেমনি এটি স্মৃতি, প্রেম, সংগ্রাম ও অস্তিত্বেরও প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের ধ্যান, জীবনানন্দের স্মৃতি, মানিকের বাস্তবতায় -নদী এই বাংলায় এক অবিরাম প্রাণপ্রবাহ। আমরা এই প্রবাহের নিষ্ঠ সারথি।
লেখক: সাংবাদিক
৪ নভেম্বর ২০২৫
30
View