:
অচেনা স্মৃতির কোণ
রিহান প্রতিদিন একই রুটে কলেজে যেত। কিন্তু আজ কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল। পথের এক কোণে ছোট, অচেনা একটি বইয়ের দোকান চোখে পড়ল, যা আগে কখনও তিনি লক্ষ্য করেননি। দোকানের বাইরে ঝুলন্ত এক ক্ষুদ্র ঘন্টা এবং ধুলোমাখা জানালার ফ্রেম যেন বলছিল—“এই জায়গায় আসা মানেই এক ভিন্ন জগতের দরজা খোলা।” কৌতূহল তাকে থামাতে পারল না, এবং ধীরে ধীরে সে ভিতরে প্রবেশ করল।
দোকানের ভিতরে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ল এক পুরনো দিনের ছবি—একটি শিশু, যার হাসি রিহানের ছোটবেলার সঙ্গে অভূতপূর্ব মিল খুঁজে পেল। ছবি দেখে রিহান হঠাৎ অচেনা অনুভূতি অনুভব করল, যেন সেই শিশু তারই অন্য জীবন থেকে এসেছে। ছবির নিচে লেবেল লেখা ছিল: “যাদের স্মৃতি হারিয়ে গেছে, তারা এখানেই ফিরে পাবে।”
প্রথমে সে অবাক হলেও কৌতূহল তাকে থামাল না। দোকানির সঙ্গে কথা বলল। দোকানি বললেন, “এই দোকানটি সময়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো ধরে রাখে। প্রতিটি বই, প্রতিটি নোটবুক, প্রতিটি ছবি—সবই মানুষের হারানো মুহূর্তের সাক্ষী।” রিহান একধরনের অবিশ্বাস বোধ করলেও, দোকানির চোখে অদ্ভুত গভীরতা দেখে সে চুপচাপ মাথা নাড়ল।
রিহান একটি ধুলোয় মোড়া খাতা পেল। খাতা খুলতেই চোখের সামনে যেন একটি জীবন্ত জগৎ খুলে গেল। ছোটবেলার হাসি, হারানো বন্ধু, ভাঙা স্বপ্ন—সবই যেন তার চারপাশে নড়াচড়া শুরু করল। সে দেখতে পেল, প্রতিটি স্মৃতি শুধু অতীত নয়, বরং একটি জীবন্ত অনুভূতি যা আজও তার ভিতরে সাড়া দেয়।
একটি নোটবুকও তার হাতে এল। পাতায় লেখা ছিল: “তুমি একা নও, আমি আছি।” রিহান প্রথমে ভাবল, এটি শুধু শব্দ, কিন্তু পরবর্তী পাতায় আঁকা একটি চিত্র তাকে অবাক করে দিল। চিত্রটি ছিল তার ছোটবেলার বন্ধু আলিফের—যার সঙ্গে সে বহু বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে রিহান বুঝল, হারানো স্মৃতির ভেতর দিয়ে বন্ধুত্ব, ভালবাসা, এবং অচেনা জীবনের খণ্ডাংশ এখনও তার সাথে রয়েছে।
প্রতিদিন রিহান দোকানে আসে। প্রতিটি বই খুলে নতুন স্মৃতির আবিষ্কার করে। কখনও সে হাসে, কখনও কেঁদে ওঠে, কখনও নীরব হয়ে শুধু স্মৃতিগুলোকে অনুভব করে। একদিন সে একটি খাতা খুলল, যেখানে ছোট ছোট চিঠি ছিল—নিজের লেখা, যা সে কয়েক বছর আগে লিখেছিল কিন্তু পরে ভুলে গিয়েছিল। চিঠিগুলোতে দেখা গেল তার ছোটবেলার স্বপ্ন, ভয়, আশা এবং নিজের প্রতি অমর প্রতিজ্ঞা। এই খাতার প্রতিটি পাতায় সে যেন তার নিজের অন্য এক জীবন খুঁজে পেল।
সময় গড়িয়ে যায়, কিন্তু রিহানের অভিজ্ঞতা গভীরতর হয়। সে বুঝল, প্রতিটি হারানো স্মৃতি শুধুই অতীতের ছায়া নয়; তা জীবনের এক অদৃশ্য শিক্ষার উৎস। স্মৃতিগুলো তাকে শিখায়, কীভাবে ব্যর্থতা থেকে সাহসী হওয়া যায়, কীভাবে ভাঙা সম্পর্ককে মেরামত করা যায়, এবং কীভাবে ছোট আনন্দগুলোকে জীবনের মূল শক্তি হিসেবে দেখা যায়।
একদিন, দোকানের ভিতরে বসে রিহান একটি অদ্ভুত নোট খুঁজল। নোটে লেখা ছিল, “তুমি যা হারিয়েছো, তা শুধুই তোমার পথচলার অংশ। হারানো স্মৃতি মানেই হারানো নয়, তা শুধু অপেক্ষা করছে ফিরে আসার জন্য।” রিহান হঠাৎ বুঝল, তার সমস্ত ভয়, সমস্ত দুঃখ, সমস্ত একাকীত্ব—এগুলোই তাকে নতুন করে শক্তিশালী করেছে।
রিহান প্রতিজ্ঞা করল, এই অচেনা স্মৃতির কোণগুলোকে কখনও ভুলবে না। প্রতিটি হারানো স্মৃতি তার জীবনের অদৃশ্য শিক্ষক, যারা তাকে জীবনের গভীরতা, সৌন্দর্য এবং মানবিক সংবেদন শেখায়। রিহান শিখল, হারানো স্মৃতিও যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান আলোর উৎস হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত, রিহান বুঝল যে এই দোকান শুধু একটি স্থান নয়; এটি একটি আত্মার আয়না। প্রতিটি বই, প্রতিটি নোটবুক, প্রতিটি ছবি—সবই এক অচেনা জগতের দরজা, যেখানে হারানো স্মৃতি জীবিত থাকে, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আলোকের রেখা সৃষ্টি করে। রিহান তখন থেকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করল। প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কান্না, প্রতিটি নীরবতা—সবই তার হৃদয়ে গভীর প্রতিধ্বনি ফেলল।
রিহান শিখল, স্মৃতি শুধু অতীত নয়, বরং জীবনের পথপ্রদর্শক। প্রতিটি হারানো স্মৃতি তাকে নতুন গল্প শেখায়, নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলে, এবং নতুন আলোয় তার জীবনকে সমৃদ্ধ করে। “অচেনা স্মৃতির কোণ” এখন শুধু একটি দোকান নয়; এটি তার জীবনের অভ্যন্তরীণ জগত, যেখানে হারানো প্রতিটি মুহূর্ত তাকে শক্তি, বোধ, এবং জীবনকে ভালোভাবে বোঝার ক্ষমতা দেয়।