জহির রায়হান বাংলাদেশের এক বহুমাত্রিক প্রতিভা ও অবহেলিত নায়ক। তিনি একাধারে লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ঔপন্যাসিক ও সফল চলচ্চিত্রকার—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যের স্বাক্ষর অমলিন। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই রেখেছেন কৃতিত্বের অটুট চিহ্ন।
এই বহুগুণে গুণান্বিত মানুষের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মজুপুর গ্রামে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আবু আবদার মোহাম্মদ জহীরুল্লাহ; ডাকনাম জাফর। আবু আবদার মোহাম্মদ জহীরুল্লাহ থেকে জহির রায়হান হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে একটি ইতিহাস। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় পড়াশোনার সময় বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের উৎসাহে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সে সময় দলের প্রতিটি কর্মীর জন্য একটি করে সাংগঠনিক নাম নির্ধারিত হতো। পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মণি সিংহ তাঁর নাম রাখেন “রায়হান”—সেখান থেকেই তিনি পরিচিত ও অমর হয়ে ওঠেন ‘জহির রায়হান’ নামে।
জহির রায়হান নামটি নিজেই এক প্রতিরোধ—অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানবিকতার পক্ষে কণ্ঠস্বর। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সোনাগাজী আমিরাবাদ বি.সি. লাহা স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যয়নকালে ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘ওদের নানিয়ে দাও’ প্রকাশিত হয়। সেই কবিতাতেই অত্যাচারিত, নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা ও প্রতিবাদী মনোভাব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎ ও প্রতিবাদী সাহিত্যচর্চায় তিনি এক প্রধান শিল্পী। চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, সাহিত্য—সব ক্ষেত্রেই তিনি তৈরি করেছিলেন নিজস্ব এক স্বতন্ত্র সত্তা। বাংলা সাহিত্যে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন “ব্যক্তিত্ববাদ”—যা তাঁর কাব্যময় ও অনন্য গদ্যভঙ্গিকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।
জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে নির্মাণ করেছেন ভিন্ন এক জগৎ। তাঁর সৃষ্টিশৈলী ছিল নিজস্ব, ভাষা ছিল ব্যতিক্রমী। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের শেষ লাইনে—“রাত বাড়ছে, হাজার বছরের পুরোনো সেই রাত”—বা ‘আরেক ফাল্গুন’-এর “আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব”—এইসব বাক্য তাঁর সাহিত্যিক চেতনা ও মৌলিকতার উজ্জ্বল প্রমাণ।
সাহিত্যকর্ম
তাঁর সাহিত্য-পরিমণ্ডল বিশ্লেষণে দেখা যায়—তিনি মূলত নগরজীবনের লেখক। সাতটি উপন্যাসের মধ্যে শুধু ‘হাজার বছর ধরে’ গ্রামীণ জীবনের প্রেক্ষাপটে রচিত; বাকিগুলো নগরভিত্তিক। উপন্যাসগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—
আরেক ফাল্গুন, আর কত দিন
হাজার বছর ধরে
শেষ বিকেলের মেয়ে, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা, কয়েকটি মৃত্যু
‘আরেক ফাল্গুন’ ও ‘আর কত দিন’–এ ইতিহাস, রাজনীতি, আন্তর্জাতিকতা, যুদ্ধবিরোধী অবস্থান এবং শোষণমুক্ত এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন প্রকাশিত হয়েছে।
‘আরেক ফাল্গুন’ ছিল বাংলার ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস—এখনও ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক সাহিত্যের শীর্ষে অবস্থান করে।
‘আর কত দিন’–এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণ-নিপীড়নে বিপর্যস্ত বিশ্বমানবতার আর্তনাদ ফুটে ওঠে। মানুষ ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতির নামে বারবার আত্মাহুতি দিয়েছে—এই মৃত্যুবলয়ের বিরুদ্ধে তিনি মানবিকতার আলো খুঁজেছিলেন।
‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ফেনী অঞ্চলের গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি, আচরণ ও চলনভঙ্গির স্বতন্ত্র রূপ।
‘শেষ বিকেলের মেয়ে’তে নগর মধ্যবিত্ত জীবনের প্রেম, বিষণ্ণতা ও অস্তিত্ববোধ উঠে এসেছে নদীর মতো প্রবহমানতায়।
‘কয়েকটি মৃত্যু’তে মৃত্যুর আতঙ্কই প্রধান চরিত্র; মৃত্যু-অপরিহার্যতার কঠিন বাস্তবতা সেখানে প্রবীণ চরিত্র বাবা আহমেদ আলীর উপলব্ধিতে স্পষ্ট।
‘তৃষ্ণা’য় তিনি শহুরে জীবনের খণ্ডচিত্রকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যা সে সময়ের মানুষ ও সমাজের প্রকৃত মুখচ্ছবি নির্মাণ করে।
জীবদ্দশায় তিনি ২১টি গল্প লিখেছেন। এসব গল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের অস্তিত্বসংকট, স্বপ্ন, সংগ্রাম ও অন্তর্দহন প্রতিফলিত হয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন—এসব রাজনৈতিক বাস্তবতা তাঁর গল্পের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি মাত্র একটি গল্প লিখতে পেরেছিলেন—‘সময়ের প্রয়োজন’।
জহির রায়হান স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন—মধ্যবিত্তের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়ন আসলে তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক টানাপোড়নের ফল। তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণেই তাঁর গল্পগুলো আন্দোলন-সংগ্রামমুখী।
হুমায়ুন আজাদ যথার্থ বলেছেন—
“বাংলাদেশে সম্ভবত জহির রায়হানই একমাত্র কথাসাহিত্যিক, যার উৎস ভাষা আন্দোলনে নিহিত। ২১ ফেব্রুয়ারি না থাকলে জহির রায়হান হয়তো লেখকই হতেন না।”
চলচ্চিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক তাঁর চলচ্চিত্র স্টপ জেনোসাইড বিশ্বজনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। শরণার্থী শিবির, সমাবেশ, আন্দোলনে এই ছবিটি ছিল বাংলাদেশকে পরিচিত করার শক্তিশালী মাধ্যম। কলকাতায় জীবন থেকে নেয়া প্রদর্শনীতে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ উপস্থিত ছিলেন। ছবিটি দেখে সত্যজিৎ রায় মন্তব্য করেছিলেন—
“এ এক অনন্য প্রতিভা—চলচ্চিত্রে নতুন যাত্রার সূচনা। জহির রায়হান অত্যন্ত মেধাবী নির্মাতা।”
মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার দলিল হিসেবে স্টপ জেনোসাইড আজও বিশ্ব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।
নিখোঁজ হওয়া ও নির্মম সত্য
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও মিরপুর মুক্ত হয় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি। এর মধ্যে আল-বদর কর্তৃক অপহৃত বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন জহির রায়হান।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে এক রহস্যময় টেলিফোন কল আসে—মিরপুর-১২–তে শহীদুল্লাহ কায়সার জীবিত আছেন, তাকে উদ্ধার করতে হলে এখনই যেতে হবে। সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থাকার কথা থাকলেও তিনি ছুটে যান মিরপুরে। পথে সেনাবাহিনী তাঁর গাড়ি আটক করে, বাকিদের ফিরিয়ে দেয়—এরপর আর কখনো পাওয়া যায়নি তাঁকে।
সেদিন মিরপুরে পাকিস্তানি সৈন্য, বিহারি রাজাকার ও আলবদরদের হামলায় অসংখ্য সেনা ও পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছিলেন। বহু বছর তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হলেও ১৯৯৯ সালে ভোরের কাগজ–এর সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিকের অনুসন্ধানে সত্য উদ্ঘাটিত হয়—জহির রায়হানকে হত্যা করেছিল অবাঙালি রাজাকার-আলবদর চক্র।
জহির রায়হানের অনুপস্থিতি—আজও বেদনার নাম
আজ যখন কিছু অপদার্থ রাজনীতিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করে, শহীদসংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিভ্রান্তি ছড়ায়—তখন জহির রায়হানের সত্য উচ্চারণ আমাদের কণ্ঠে ফিরে আসে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ—জহির রায়হান নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন, শিল্পীর দেশপ্রেম কেমন হয়, দেশের প্রতি দায়িত্ব কেমন হতে পারে। আজ যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষ চারদিকে ছড়ায়, তখন তাঁর অনুপস্থিতি আরও বেশি করে অনুভূত হয়।
মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে জহির রায়হান এই দেশের জন্য যা দিয়ে গেছেন, তা অনন্য। তাঁর মতো উজ্জ্বল নক্ষত্র আরও বাঁচলে দেশ আরও এগিয়ে যেত। তিনি আজও অনুপ্রেরণার প্রতীক, তরুণ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক।