
হুদাইবিয়ার সন্ধির পরিবর্তে ‘মুহাম্মদ (সা.)’ বিভিন্ন জায়গার শাসকদের কাছে ইসলাম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে চিঠি প্ররেণ করেন। এরই অংশাবিশেষ হিসেবে ‘মুহাম্মদ (সা.)’ ‘হারেস ইবনে উমায়ের আল আযদী (রা.)’-কে একটি চিঠিসহ তৎকালীন বসরার গভর্নরের নিকট প্রেরণ করেন। তখন রোমের কায়সারের গভর্নরের পক্ষে থেকে ‘শুরাহবিল ইবনে আমর গাস্সানি’ বসরার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিল। সে ‘মুহাম্মদ (সা.)’-এর প্রেরিত দূতকে গ্রেফতার করে হত্যা করে। সে সময় রাষ্টদূত বা সাধারণ দূত হত্যা করা ছিল জঘন্যতম অপরাধ এবং যা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল ছিল।
‘মুহাম্মদ (সা.)’ তার প্রেরিত দূতের হত্যার খবর শোনার পর সেই এলাকায় অভিযান পরিচালানা করার জন্যে সৈন্যদের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী তিন হাজার সৈন্যের বিশাল বহর তৈরী হয়। খন্দকের যুদ্ধ ছাড়া ইতিপূর্বে অন্য কোন যুদ্ধেই মুসলিমরা এত সৈন্যের সমাবেশ করে নি।
তিনি ‘যায়েদ বিন হারেসা (রা.)’-কে এ সৈন্যদলের প্রধান সেনাপতি মনোনীত করেন। এরপর বলেন যে, “যদি ‘যায়েদ’ শহিদ হয়, তাহলে‘জাফর’ এবং যদি ‘জাফর’ শহিদ হয়, তাহলে ‘আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা’ সেনাপ্রধান নিযুক্ত হবে। আর যদি ‘আব্দুল্লাহ’ও শহিদ হয় তাহলে তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে সেনাপতি নিযুক্ত করবে” ।
‘মুহাম্মদ (সা.)’ মুসলিম সেনাবাহিনীর জন্যে সাদা পতাকা তৈরী করে তা ‘যায়েদ ইবনে হারেসা(রা.)-এর কাছে দেন এবং সৈন্যদলকে এ বলে ওসিয়ত করেন যে, ‘হারেস ইবনে ওমায়ে’রে হত্যাকান্ডের জায়গায় তারা যেন অবশ্যই আগে স্থানীয় লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেয়। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে কোনো যুদ্ধ হবে না আর তাঁরা যদি ইসলাম গ্রহণ না করে, তবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে।
মুসলিম বাহিনী রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে সাধারণ মুসলমানরা ‘মুহাম্মদ (সা.)’-এর মনোনীত সেনানায়কদের সালাম এবং বিদায় জানান।
মুসলিম সৈন্যরা যখন মাআন নামক এলাকায় পৌঁছায়। তখন গুপ্তচর এসে খবর দিলেন যে, “রোমের কায়সার বালকা অঞ্চলের মাআব এলাকায় এক লাখ রোমান সৈন্য সমাবেশ করে রেখেছে। এছাড়া তাদের পতাকাতলে লাখাম, জাজাম, বলকিন, বাহরা এবং বালা গোত্রের আরো এক লাখ সৈন্য সমবেত হয়েছিলো” ।
মুতা নামক জায়গায় উভয় দলের মধ্যে লড়াই শুরু হয়। মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম রোমান সৈন্যের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। যুদ্ধে সর্বপ্রথম ‘রাসূল (সা.)’-এর প্রিয় পাত্র ‘যায়েদ (রা.)’ পতাকা গ্রহণ করেন। অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
‘যায়েদ (রা.)’-এর শাহাদাতের পর পতাকা তুলে নেন রাসূলের চাচাতো ভাই ‘জাফর (রা.)’। তিনিও তুলনাহীন বীরত্বের পরিচয় দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। শত্রুদের আঘাতে আঘাতে তিনিও একসময় শহিদ হন।
‘জাফর (রা.)’-এর শাহাদাতের পর ‘আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.)’ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ‘আব্দুল্লাহ(রা.)’ বীর বিক্রমে লড়াই করতে করতে তিনিও একসময় শহিদ হন।
পর পর তিনজন সেনাপতির মৃত্যুতে মুসলিম বাহিনী নেতৃত্ব শূন্য হয়ে যায় এবং দাঁড়িয়ে যায় খাদের কিনারায়।
‘আব্দুল্লাহ (রা.)’-এর শাহদাতের পর ‘ছাবেত ইবনে আরকাম (রা.)’ পতাকা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “হে মুসলমানরা, তোমারা উপযুক্ত একজনকে সেনাপতির দায়িত্ব দাও” ।
সাহাবিরা ‘ছাবেত (রা)-কেই সেনাপতির দায়িত্ব নিতে বললে তিনি বলেন,“আমি একাজের উপযুক্ত নই” ।
এরপর সাহাবিরা পরামর্শ করে ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)’-কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। (এই প্রথম বারের মতো ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)’ মুসলিম বাহিনীতে যোগ দেন) । তিনি নেতৃত্ব গ্রহণের পর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।
‘খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)’ থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, “মুতার যুদ্ধের দিনে আমার হাতে একে একে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার হাতে একটি ইয়েমেনী ছোট তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো” ।
এদিকে ‘রাসূল (সা.)’ রণক্ষেত্রের খবর লোক মারফত পৌঁছার আগেই ওহীর মাধ্যমে পান। তিনি বলেন, ‘যায়েদ’ পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি শহীদ হন। এরপর ‘জাফর’ পতাকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি শহীদ হন। এরপর ‘আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা’ পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনিও শহীন হন। ‘রসূল (সা.)’-এর চোখ এ সময় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, এরপর পতাকা গ্রহণ করেন আল্লাহর তলোয়ার সমূহের মধ্যে একটি তলোয়ার।
যুদ্বের সমাপ্তি
মুসলমানদের মাত্র তিন হাজার সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সামানে টিকে থাকা ছিলো এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। মুতার যুদ্ধে তিনজন সেনাপতি সহ ১২জন শহিদ হন অন্য দিকে রোমানদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল মুসলিমদের তুলনায় বহুগুণ বেশি কিন্তু তাঁরা ছিল অগণিত। যদিও সাহাবিরা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাঁরা উপলব্ধি করতে পারে কোন কিছুর বিনিময়ে বিজয় অর্জন করা সম্ভব না।
সার্বিক পরিস্তিতি বিবেচনা করে পরদিন সকালে তাঁরা আর যুদ্ধে না জড়িয়ে মদীনায় ফিরতি যাত্রা করেন। কিন্তু তাঁরা জানতেন না যুদ্ধ শেষ না করেই তাদের এই ফিরতি যাত্রা কিভাবে নেবেন ‘রাসূল (সা.)’। মুসলিম বাহিনী যখন মদীনার প্রবেশ পথে তখন মদীনার মানুষ তাদের তিরস্কার করতে থাকে। তাঁরা চিৎকার করে বলতে থাকে, “তোমার আল্লাহর পথ থেকে পালিয়ে এসেছ”
কিন্ত ‘রাসূল (সা.)’ তাঁদেরকে নিনৃত্ত করে বলে, “তাঁরা পালিয়ে আসেনি। আল্লাহর ইচ্ছে হলে তাঁরা আবার সেখানে যাবে” ।
‘রাসূল (সা.)’ ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)’-এর কাধে হাত রেখে বলেন, “হে সুলাইমানের পিতা আজ তুমি যে বীরত্বের পরিচয় দেন, ইতিহাসে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না” ।
এরপর ‘রাসূল (সা.)’ উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘খালিদ’ হলো ‘সাইফুল্লাহ’ তথা ‘আল্লাহর তলোয়ার’’
মুতার যুদ্ধের প্রভাব
যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুতা অভিযান পরিচালিত হয়েছিলো, সেটা সম্ভব না হলেও এ যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের সুনাম সুখ্যাতি বহু দূর বিস্তার লাভ করে। কেননা, রোমানরা ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ শক্তি। আরবরা মনে করতো যে, রোমানদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। কাজেই, উল্লোখযোগ্য বড় ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তিনহাজার সৈন্য দুইলাখ সৈন্যের মোকাবেলায় আরবের জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো যে, ইতিপূর্বে পরিচিতি সকল শক্তির চেয়ে মুসলমানরা সম্পূর্ণ আলাদা। মুতার যুদ্ধের পর মুসলমানদের চিরশত্রু হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু গোত্র ইসলামের ছায়াতলে আসে।