Posts

প্রবন্ধ

অক্ষরের অতীতস্মৃতি : বাংলা প্রাচীন পাণ্ডুলিপির পাঠ ও সমালোচনার গুরুত্ব

November 18, 2025

মোঃ আব্দুল আউয়াল

Original Author অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল

47
View

বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। মুদ্রণযন্ত্রের আগমন-পূর্ব যুগে বাংলার ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, কাব্য, লোকসংস্কৃতি, চিকিৎসা ও জ্যোতিষসহ নানা জ্ঞানচর্চার ধারক ছিল এইসব হাতে লেখা দলিল। সময়ের ধুলোবালির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এসব পাণ্ডুলিপি শুধু সাহিত্য ইতিহাস নয়, সমগ্র বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির মূল্যবান নিদর্শন।
পাণ্ডুলিপির বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বাংলার পাণ্ডুলিপি সাধারণত তালপাতা, ভোজপত্র বা হাতে তৈরি কাগজে লেখা হতো। কালি তৈরি হতো উদ্ভিজ্জ রঙ ও চারকোলের মিশ্রণে। ফলে প্রতিটি পাণ্ডুলিপি হয়ে উঠত স্বতন্ত্র শিল্পকর্ম। একই রচনার বহু ভিন্ন প্রতিলিপি পাওয়া যায়; কোথাও সংক্ষিপ্ত, কোথাও সম্প্রসারিত। প্রতিলিপিকারীর হাতে বোনা ভুল, বানানভেদ, আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব—এসব কারণে পাণ্ডুলিপির পাঠধারা হয়েছে জটিল, আবার বৈচিত্র্যময়ও।
এই বৈচিত্র্যের কারণেই পাণ্ডুলিপিগুলো হয়ে উঠেছে গবেষকদের সম্ভার। মধ্যযুগীয় সাহিত্য, ভাষার বিবর্তন ও সমাজ-মনস্ক ভাবনার সন্ধান আজও পাওয়া যায় এসব নথিতে।
পাঠ-সমালোচনার প্রয়োজনীয়তা
কোনো পাণ্ডুলিপির পাঠই এককভাবে নির্ভরযোগ্য নয়। বহু প্রতিলিপি তুলনা করে মূল পাঠ নির্ধারণ করাই পাঠ-সমালোচনার কাজ। এতে ব্যবহৃত হয় ভাষাতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব, ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি ও তুলনামূলক সাহিত্যবিজ্ঞানের পদ্ধতি।
এই প্রক্রিয়ায়—
• প্রতিলিপিগুলোর শব্দ, বাক্য, ছন্দের ব্যবধান চিহ্নিত করা হয়
• প্রাচীনতর ও যথার্থ পাঠ নির্বাচন করা হয়
• সংশোধনযোগ্য স্থান ফুটনোটে উল্লেখ করা হয়
• সম্ভব হলে রচনার ‘সম্ভাব্য মূলরূপ’ পুনর্গঠিত করা হয়
বাংলা সাহিত্যের প্রধান সম্পদ যেমন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য কিংবা মধ্যযুগের রূপক-প্রণয় কাহিনি—সবকিছুই পাঠসমালোচনার আলোকেই আজ প্রতিষ্ঠিত।
পাঠে প্রতিবন্ধকতা
প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাঠে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়—
• সময়ের ক্ষয়ে লেখা মুছে যাওয়া
• আঞ্চলিক বানান ও ভাষাভেদ
• লিপির রূপান্তর ও অপ্রচলিত অক্ষর
• পরবর্তী সময়ের সংযোজন বা পরিবর্তন
• দুর্লভ বা বিলুপ্ত শব্দের ব্যবহার
এসব বাধা অতিক্রম করতে প্রয়োজন নিখুঁত নজর, ভাষাবোধ ও ঐতিহাসিক চেতনা।
গবেষণায় পাণ্ডুলিপির অবদান
পাণ্ডুলিপি গবেষণার মাধ্যমে আমরা পাই—
• সাহিত্যকর্মের নির্ভরযোগ্য পাঠ
• মধ্যযুগীয় সমাজ-সংস্কৃতির স্পষ্ট ছবি
• বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের ধারাবিবরণী
• হারিয়ে যাওয়া রচনার উদ্ধৃত অংশ
• নতুন সাহিত্য-ইতিহাস রচনার পথ
সাহিত্য গবেষণার জন্য যেমন পাণ্ডুলিপি অপরিহার্য, তেমনি এটি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের গভীরে পৌঁছে যাওয়ার মাধ্যম।
উপসংহার
বাংলা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আমাদের অতীতের সেতুবন্ধ। এগুলোর পাঠ ও সমালোচনা শুধু কোনো একাডেমিক কাজ নয়—এটি বাঙালি সমাজের স্মৃতি সংরক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। পাণ্ডুলিপির প্রতিটি পাতায় লুকিয়ে আছে সময়, কল্পনা, বিশ্বাস, রীতি ও সাহিত্যরুচির ইতিহাস। সুতরাং পাণ্ডুলিপিকে ঘিরে গবেষণা যত বিস্তৃত হবে, ততই সমৃদ্ধ হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ঐতিহ্য।
 

Comments

    Please login to post comment. Login