তাসলিহা মওলা দিশা
শীত গ্রীষ্ম বর্ষা যাই হোকনা কেন, হাঞ্জেলার ঘুম ভাঙে সূর্য ওঠার আগে। চারিদিক অন্ধকার থাকতে থাকতেই সে পুকুর ঘাটে যায়, হাতমুখ ধোয়। ততক্ষণে ঘুম ভেঙে যায় তার বৌ টুন্ডুর। স্বামীর জন্য গরম ভাত, মরিচ পোড়া, আর ডাল তৈরী করে রাখে। হাঞ্জেলা মুখ হাত ধুয়ে, লাঙল টুকরি, মাথাল আর গামছা গুছিয়ে নেয়। বৌ ডাকলে সে চুলার ধারে বসে গপাগপ খেতে শুরু করে ভাত। প্রথমে শুধু নুন মেখে কয়েক গরাস খেয়ে নেয়। এরপর পোড়া মরিচ গুলো একে একে ডলতে থাকে গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাতে। মরিচের রঙে ভাত একেবারে রাঙা হয়ে যায়। সাত আটটা মরিচ ডলে ভাত মেখে খেয়ে এবার সে ডাল নেয়। গরম গরম ডালে সাধা ভাত ডুবে যায়। সুড়ুৎ সুড়ুৎ টানে খেতে থাকে হাঞ্জেলা। স্বামীর খাবার দৃশ্যটা কেন যেন বড় ভাল লাগে টুন্ডূর। নেশার মত সে হাঞ্জেলার ভাত খাবার দৃশ্য দেখে যায় প্রতিদিন, প্রতিবেলা। তাদের তো ভাল খাবার জোগাড়ের সঙ্গতি নেই। এ অতি সামান্য খাবারও যে একই রকম তৃপ্তি নিয়ে দিনের পর দিন খাওয়া যায়, হাঞ্জেলাকে না দেখলে টুন্ডু বুঝতনা। ক্ষেতের সবজি উঠলে তখন তারা কিছুটা ভাল খেতে পারে। বেগুনটা, কপিটা পড়ে পাতে। সবজি বেঁচে লাভের টাকা দিয়ে প্রতিবছর বৌকে শাড়ি কিনে দেয় হাঞ্জেলা। বছরের এই একটা সময়েই তারা মাছ খেতে পারে। দুজনের সংসারে আর কতইবা খরচ?
হাঞ্জেলা উত্তরাধিকার সুত্রে এক টুকরো জমি পেয়েছে বাপ মারা যাবার পর। কতই বা সেই জমির পরিমাণ, বড়জোর দুই শতক। দুই ফসলী সে জমিতে চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোনা আমনের বীজ ছিটায় হাঞ্জেলা। অগ্রাহায়নে ধান তোলে। সে জমি আবার তৈরী করে শাক-সব্জির চাষ করে হাঞ্জেলা। ধান আর নানান জাতের শাক সবজি ফলিয়ে বছর শেষে যে যৎসামান্য লাভের মুখ দেখ, তাই দিয়ে দুজনে নিজেদের জন্য কিছু কেনাকাটা করে, একটু ঘুরতে যায় পাশের গ্রামে আত্মীয় বাড়ি, অথবা গঞ্জের মেলায়। এভাবেই দিন কেটে যায় তাদের। টোনা-টুনির সংসার তাদের। সন্তানাদি নেই। তা বিধাতা দেননি কিইবা করার আছে? সে নিয়ে তাদের কোনো আক্ষেপ নেই। তারা সুখেই দিন কাটায়। স্বামী কাজে গেলে ঘরের কাজ সেরে, রান্না সেরে স্নান সেরে নেয় টুন্ডু। দুপুরে দুটো খেয়ে কাঁথা সেলাই করতে বসে, অথবা শীতল পাটি বোনে। কোনো কোনো দিন আবার পাশে রাবুদের বাড়ি যায়, অথবা মালতিদের বাড়ি। রাবু, মালতি সকলেই এই পারুলী গাঁয়ের বৌ। দুপুর বেলাটা তারাও হয়ত বিশ্রাম নেয়, অথবা পাটি বোনে কি কাপড়ে সুঁই সুতোর নকশা তোলে আপন মনে। টুন্ডু তাদের বাড়ি গেলে কখন সখনো নকশা তোলে কাপড়ে, নকশী পিঠা বা অন্য কোনো পিঠা বানায়, কখনো আবার নিছক হাসি ঠাট্টা গল্পে মেতে ওঠে।
হাঞ্জেলা আসে সূর্য ডোবার কিছু আগে। ক্ষেতীর কাজ সেরে পায়ে কাদা গায়ে ধুলো মেখে, কাঁধে লাঙল, পিঠে মাথাল ঝুলিয়ে। এসেই ছোট্ট পুকুর ঘাটে গিয়ে হাপুস হুপুস স্নান সেরে এসে বসে ঘরের দাওয়ায় বৌ এর পেতে রাখে পাটিতে। সূর্য তখন ডুবে গেছে, অন্ধকার নেমে এসেছে পারুলী গাঁয়ে, অন্ধকার নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকেও। সারাদিনের ক্লান্তি আর এক পেট ক্ষুধা তখন তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে যেন। ক্ষুধার জ্বালা মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। টুন্ডু গরম গরম ভাত , কিছু তরকারী, ডাল এনে সামনে দিলে আর দেরী করেনা হাঞ্জেলা। গোগ্রাসে খেতে থাকে গরম ভাত। মাঝে মাঝে ঘরের হাঁস মুরগীর ডিম পাতে পড়ে। বেশীর ভাগ সময়ই ডিম বিক্রি হয়ে যায় , ক্রেতা এই আশে পাশের বাড়ির মানুষজনই। প্রতিবেলার খাবারই অসামান্য তৃপ্তি নিয়ে খায় হাঞ্জেলা। একবার টুন্ডূ জিজ্ঞেস করেছিল, “হ্যাঁগো, এই সামান্য খাবারও তুমি কিভাবে এত তৃপ্তি নিয়ে প্রতিদিন খাও? আমারোতো অরুচি চলে আসে মাঝে মাঝে”। ভাত পেটে পড়লে হাঞ্জেলার চোখ চক চক করে ওঠে। খুশীর ঝিলিক তুলে সে বৌকে বলে “ জানিস, এই যে তুই আমি খেতে পাচ্ছি এ আল্লাহর কত বড় নেয়ামত? তিনি দেন বলেই না খেতে পাচ্ছি। আমাদের রিজিকে এই খাবার লেখা আছে। একে অসম্মান করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। এই খাবারকে অভক্তি করলে সংসারে বরকত কমে যাবে যে টুনি।“ বৌকে আড়ালে আদর করে টুনি ডাকে হাঞ্জেলা। টুন্ডু অবাক হয়ে ভাবে, কত জ্ঞানী তার স্বামী, কতই না বোঝে! নইলে কি আর এভাবে ভাবতে পারে?
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে একটা বিড়ি ধরায় হাঞ্জেলা। বড় দীঘির ধারে গণি মিঞার চায়ের দোকানে যেয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে চলে আসে বাড়িতে। আজ গণি মিঞার দোকানে তালকদার বাড়ির সোহেল তালুকদার এসে বসেছে। এ লোকটা মহা ধড়িবাজ। কোন উদ্দেশ্য ছাড়া কোথাও যায়না। সকলে তাই তাকে এড়িয়ে চলে। তবে সামনে পড়লে কথা না শুনে তো উপায় নেই কোনো। হাঞ্জেলার মত মানুষদের তাকে এড়িয়ে যাবার সাহসই বা কোথায়? আজো তাই জড়োসরো হয়ে তক্তার বেঞ্চিতে বসে পড়ে সে। গণি মিঞা চা দিলে চুপচাপ খেতে থাকে চা। কথাটা তালুকদারই তোলে। তার কথার সারমর্ম হল এই যে, শুধু চাষবাশ করে আর কত টাকাই বা পাচ্ছে এ গাঁয়ের মানুষ। দিনকাল যা পড়েছে বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা সকলের জন্যই প্রয়োজন। এই পারুলী গ্রামটা শহরের এত কাছে, জমির দামও বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। যদের অনেক জমি তারা কিছু অংশ বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকা ব্যাংকে রাখলেও সুদে আসলে বাড়এ টাকা। আর যাদের হাঞ্জেলার মত কম পরিমাণ জমি, তারা চাইলে বিভিন্ন কোম্পানিকে সাইনবোর্ড ভাড়া দিতে পারে। সে সাইনবোর্ড বাবদ মাসে যা আসবে তাই বা কম কী?
তালুকদারের কথার মাঝে হাঞ্জেলার নাম এলে সে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে। সহজসরল মানুষ সে। তালুকদারদের মত ব্যবসায়ী মানুষদের সে বড় ভয় পায়। টাকা পয়সার হিসেবে হাঞ্জেলা বড় কাঁচা। লেখাপড়াও জানেনা। তবে তার বাপের শিক্ষা হল জমিজিরাতের ব্যপারে কাউকে বিশ্বাস না করা। কেউ যেচে পড়ে উপকার করতে আসলে সরে পড়া, বা তাকে এড়িয়ে চলা। হাঞ্জেলা তাই চুপচাপ চা খেয়ে চলে। গণি মিঞার দোকানের পরিবেশ এখন বেশ সরগরম। তালুকদার বেশ জমিয়ে বসেছে। গল্প ফেঁদে বসেছে কোথায় কোন গ্রামে সে দেখে এসেছে মানুষ বিলবোর্ড ভাড়া দিয়ে টাকা কামাচ্ছে দেদারছে। পাকা ঘর তুলে ফেলেছে মাঝের গ্রামের রহিম শেখ। আর পারুলী গ্রামের মানুষ কত ভীতু, এরা ভাল থাকতে জানেনা, ইত্যাদি আরো কত কথা। রাত বেড়ে চলে। হাঞ্জেলা তার হাতের কাপে থাকা চা টুকু শেষ করে উঠে পড়ে তক্তার বেঞ্চ ছেড়ে। গণি মিঞার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে। তালুকদারের এসব বারফাট্টাই শোনার চাইতে টুন্ডুর সাথে দুটো সুখ দুঃখের কথা বললেও মনটা শান্ত হয়। অর্থের প্রয়োজন তারও আছে। কিন্তু তাই বলে বাপ দ্দাদার আমলের এই শেষ চিহ্নটিকে সে হারাতে পারবেনা। তার পূর্ব পুরুষের অবস্থা নেহাৎ মন্দ ছিলনা। জমিজমাও ছিলে বেশ কিছুই। কিন্তু ৮৮ এর বন্যার পর যে আকাল হল তাতেই চলে গেল অনেক জমি। হাঞ্জেলার বাবা সংসার চালাতে গিয়ে একেরপর এক জমি বিক্রি করে ফেললেও শেষ সম্বল এই দুই শতক জমিটি ধরে রেখেছিল। এ জমি নাকি লক্ষ্মী জমি। হাঞ্জেলার বাবার দাদার আমল থেকে এ জমি তাদের ফসল দিয়ে আসছে। আর এ জমির মাটিও বেশ সরেস। যাই বোনে তাতেই যেন সোনা ফলে।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই বাড়ি ফেরে হাঞ্জেলা। বেড়ার আড় ঠেলে উঠোনে ঢুকতেই দেখে দাওয়ায় বসে ঢুলছে টুন্ডু। স্বামীর পায়ের আওয়াজে ঝিমুনির রেশ কাটে তার। একগাল হাসি হেসে এগিয়ে যায় স্বামীর দিকে। নিজের ভেতরের অস্থিরতা এড়াতেই হয়ত তাড়াতাড়ি স্ত্রীর হাত ধরে ঘরে ঢুকে খিল দিয়ে দেয় হাঞ্জেলা শক্ত করে। মনে তার আজ কেমন এক শঙ্কা। কি জানি কেন, তালুকদারের কথাগুলো তার ভাল লাগেনি। এত জোর দিয়ে কথা বলছিল, যেন সব জেনেই সে এসেছে। হাঞ্জেলার আশেপাশে অনেক বড় বড় ধানী জমি, রাই সর্ষের ক্ষেত, গমের ক্ষেত আছে। কোনো কোনোটা এক বিঘাও আছে। রহিমুদ্দিনের আছে আঠারো শতাংশ, আবার করিম শেখের দুই বিঘা। করিম শেখের জমি দুই ফসলী। কিন্তু সে বছরে একবার ধান ফলিয়েই আর কিছু করেনা। করিম শেখের বর্গাদার নছিরুদ্দিন বছরের বাকী সস্ময়টা অন্যের জমিতে বর্গা দেয়। বসে থাকবে নাকি সে – পেট চলতে হবেনা?
হারিকেনের সলতে নামিয়ে বিছানায় এসে বৌকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হাজেলা। টুন্ডু বোধহয় টের পেয়ে গেছে হাঞ্জেলার বুকের ভেতরে গাঙপাড়ের ভাঙন। স্বামীকে তাই সবটা দিয়ে আগলে ধরে সে। রাত পোহালেই নতুন ভোর, নতুন দিন। আলোর আশা বুকে নিয়েই ঘুমের অতল দেশে হারিয়ে যায় দুজন। কিন্তু রাতে সে ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন দেখে। দেখে তার ওয়ি ছোট্ট দুইশতক জমির চারপাশে কেউ এসে দেয়াল উঠিয়ে দিয়েছে বিশাল। সে দেয়ালে নেই কোনো দরজা, নেই জানালা। ঢোকার রাস্তা বন্ধ। হাঞ্জেলা সেই বিশাল দেয়ালে মাথা কুঁটে কাঁদছে আর বলছে “আমার ধানের চারাগুলো কিভাবে পানি পাবে?” কাঁদতে কাঁদতে তার গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘুম ভেঙে উঠে দেখে সত্যিই তার গলা শুকিয়ে গেছে। স্বামীকে ঘুম ভেঙে উঠে যেতে দেখে উঠে বসেছে টুন্ডুও। হাঞ্জেলার হাঁসফাঁস করা দেখে ভয় পেয়ে যায় সে। চৌকি থেকে নেমে এক গ্লাস পানি এনে দেয় তার হাতে। এক নিঃশ্বাসে ঢক ঢক করে পানিটুকু শেষ করে বৌয়ের দিকে থাকায় হাঞ্জেলা। স্বামীর বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে টুন্ডু, “কিগো, আজ তোমার কী হল? সন্ধ্যের পর থেকে দেখছি তুমি অস্থির। কেউ কিছু বলেছে?”
তার উদবেগ উৎকন্ঠা দেখে হাঞ্জেলা চেপে যায় তালুকদারের প্রস্তাবের কথা। স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “কিছু হয়নি গো। এমনি শরীরটা ভাল নাই। চল ঘুমিয়ে পড়ি।“
স্বামীর মুখে অভয়বাণী শুনে টুন্ডু ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম আসেনা হাঞ্জেলার। বাকী রাতটা জেগেই কাটায় সে। ভোরে উঠে চারটি মুখে গুঁজে প্রতিদিনকার মতই চলে যায় ক্ষেতে। এ যেন এক নেশা তার। ভোর সকালে নধর নধর ধানের চারা গুলোকে আদর না করলে তার দিন শুরু হতে চায়না। কি পরম মমতায় সে আগাছা তোলে, গোড়ার মাটি নিড়োয়, পানি দেয়। তার তো সন্তান নেই, এই দুই শতক জমিই তার সন্তানের মত। কতদিন বিনা কাজে আসে সে এখানে। বসে বসে বেড়ে ওঠা সবুজ সব্জির চারা, বা আধপাকা ধান অথবা পাকা ধানের নাচন দেখে। তার বোনা আমনগুলো যখন একেবারে পেকে টইটম্বুর হয়ে যায়, হাঞ্জেলার মনে যে কী আনন্দ হয় ! সন্তান থাকলে বুঝি তাদের খলখলে হাসি দেখে এমনই মন ভিজে উঠত তার।
রাতে ঘুম ভাল হয়নি বিধায় আজ কিছুটা দেরী করেই ঘর থেকে বের হয় হাঞ্জেলা। ক্ষেতে গিয়ে কিছুটা ধাক্কা খায় সে যখন দেখে করিম শেখ নিজেই এসে হাজির মাঠে। সাথে আছে নছিরুদ্দিন, হারাধন দাস, ফজল মিঞা, গণি মিঞা, আরো অনেকে। সকলের মুখেই গতকাল তালুকদার যা বলে গেল সে কথা। টাকার যে হিসেব দিয়েছে তাদেরকে, তা যদি সত্য হয় তবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় তাদের জীবনে। আর তেমন কোনো কঠিন কাজ তো না। শুধু কিছু বিলবোর্ড নাকি সাইনবোর্ড কি যেন গেড়ে দেবে জমির ওপর, তাতে আর কতটুকু জায়গাই বা লাগবে তাদের। ্দুইপাশে দুটো খুঁটি এমন কোনো ক্ষতিই করবেনা। মাসে মাসে একেকজন তিন থেকে হাজার করে টাকা পাবে। যা দিনকাল পড়েছে, টাকা ছাড়া তারা ছেলেমেয়ে মানুষ করবে কিভাবে? হাঞ্জেলা ওদের কাউকেই বোঝাতে পারেনা, এভাবে টাকা নেয়াটা ঠিকনা, কাকে না কাকে ভাড়া দেবে। সেই লোককে তো চেনেওনা তারা।
করিম শেখ এবার একেবারে তেরে ফুঁরে ওঠে। মোটে দুই শতক জমি মালিক দুদিনের এই হাঞ্জেলা কিনা তা ওপর কথা বলে? তার আঁচে ঝাঁঝিয়ে ওঠে আর সকলেই। সকলের জমির পরিমানই এখানে অনেক বেশী। সে তুলনায় হাঞ্জেলার জমি কিছুই না। তাকে নিয়ে হাসাহাসিও শুরু করে দেয় তারা। হারাধন তো বলেই বসে “যেইনা একখান চেহারা, নাম রাখছ পেয়ারা – ও হাঞ্জেলা, তোর এই আধ টুকরা জমি নিয়ে এত আদেখেলপনা কেনরে? আমাদের এত জমি, কই আমরা তো এত ভাবছিনা”। হাঞ্জেলা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের জমিতে ফিরে যায়। কাজে নেমে পড়ে।
সপ্তাহ দুয়েক পরে একদিন সকালে সবাই দেখে করিম শেখ, ফজল মিঞা, নছিরুদ্দিন, হারাধন দাস সকলের জমি মিলিয়ে যে বিশাল জায়গাটা এই মাঠে, সেখানে তিনটি বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। “সততা বিল্ডার্স” নামে কোন এক কোম্পানির সাইন বোর্ড। কি সব প্লট, জমি এসব লেখা আছে সেসবে। অত আর কী বোঝে নছিরুদ্দিন, ফজল মিঞা এরা। তারা মাসকাবারি টাকা পাচ্ছে এতেই খুশি। সংসারের বাড়তি খরচটা মিটে যাচ্ছে অনেকের। কেউ আবার টাকাগুলো জমিয়ে রাখছে ভবিষ্যতের জন্য। ব্যাতিক্রম শুধু হাঞ্জেলা। সে একমনে তার জমি চাষ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
মাস ছয়েক পর তারা লক্ষ্য করে পারুলী গ্রামে অজানা লোকের আনাগোনা বেড়ে গেছে বেশ। শহর থেকে গাড়িতে করে মানুষজন আসে। এসে গ্রামের ফসলের ক্ষেতগুলো দেখতে আসে। যেই আসুক, সাথে তালুকদার থাকবেই। জিজ্ঞেস করলে তালুকদার বলে “আরে এরা সরকারী লোক, জমি মাপতে এসেছে। সার্ভেয়র আর কি”। সরল বিশ্বাসে তারা মেনেও নেয়। ভাবে, সরকার থেকে যদি তাদের জমি দেখে কিছুটা সাহায্য করা হয়, তাতে ক্ষতি কী?
এভাবে চলে যায় চার বছর। হাঞ্জেলা ছাড়া বাকী সকলেরই আর্থিক অবস্থা আগের চাইতে ভাল। তবু হাঞ্জেলার কোনো আক্ষেপ নেই। সে তার কাজ করে চলে। শীত – গ্রীস্ম – বর্ষা তাকে থামাতে পারেনা। ক্ষেতে কাজ কররতে করতে, আগাছা নিড়াতে নিড়াতে বা ধান কাটতে কাটতে সে দেখে গাড়িতে করে আসে আরো কত মানুষ। তালুকদার তাদের পেছন পেছন কী সব বলতে বলতে ঘোরে। মেঘে মেঘে বেলা আরো গড়ায়। গঞ্জের মেলা বসে। হাঞ্জেলা টুন্ডুকে নিয়ে যায় মেলায়। রাঙা শাড়ি আলতায় টুন্ডু নতুন বৌয়ের মতই ঝলমল করে।
সততা বিল্ডার্স এ কয় বছরে আরো নতুন কিছু জমিতে বিল বোর্ড বসায়। এবার বুঝি কিছুটা বেঁকে বসে করিম শেখ। আপত্তি জানায় হারাধন দাস, নছিরুদ্দিন, ফজল মিঞাও। না বাবা এভাবে খুঁটী গেড়ে দিলে তারা ছাষাবাদ করবে কোথায়? তালুকদারের সেই মোলায়েম চেহারা এবার কঠোর। সে বলে ওঠে, “বাহ, এতদিন যে টাকাগুলো নিয়ে এসেছ, তার হিসাব দিতে হবেনা?” কিসের হিসাব তারা বোঝেনা। প্রতিমাসে ভাড়ার টাকা দিয়ে যাচ্ছে হিসাব আবার কিসের?
একদিন ভোর বেলা হাঞ্জেলা ক্ষেতে গিয়ে দেখে আশপাশের ক্ষেত গুলোতে বালি ঢেলে দিয়ে গেছে কারা যেন। শুধু গণি মিঞা আর তার ক্ষেতটা রেহাই পেয়েছে। এখন জমি তৈরীর সময়, তাই সবার জমিই ছিল খালি। কেউ মাটি সমান করে, দাগ কেটে তৈরী করে রেখেছে। এর মাঝেই বস্থায় বস্তায় বালু এনে ফেলে দিয়ে গেছে।
সকলের তো মাথায় হাত। খোঁজ পড়ে তালুকদারের। জানা যায় তালুকদার দিন দুই আগে বিদেশে চলে গেছে। এবার ব্যাপারটা সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। জমি তাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। কান্নার রোল পড়ে যায় চারপাশে। হাঞ্জেলা ছাড়া আর সকলের জমিই “সততা বিল্ডার্স” নিজের নামে বিক্রি করে দিয়েছে অন্য মানুষদের কাছে। আছে শুধু হাঞ্জেলার দুই শতক জমি। গত দু’দিন ধরে মেঘও করেছে বেশ। আজ তো গুড় গুড় করে মেঘও ডাকছে। হাঞ্জেলা এসে দাঁড়িয়েছে তার দুই শতক জমির ঠিক মাঝখানটিতে। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকায় যতদূর দৃষ্টি যায়। তাকায় ক্ষেতের আলে বসে থাকা ক্রন্দনরত মানুষগুলোর দিকে। আবারো মেঘ গর্জে ওঠে। কড় কড় কড়াৎ করে বিজলী একেবারে এ মাথা থেকে ও মাথায় বিজলী চমক দেয়। সেদিকে তাকিয়ে হাজেলা প্রার্থণা করে “আল্লাহ বৃষ্টি দিওনা, আমার জমিনটা বাঁচাও মাবুদ”। তার প্রার্থণা উপেক্ষা করেই নামে বৃষ্টি। আশেপাশের ক্ষেতের বালি ধুয়ে এসে পড়তে থাকে হাঞ্জেলার দুই শতক জমিতে। বুকটা বুঝি ফেটে যাচ্ছে হাঞ্জেলার। বাপদাদার শেষ চিহ্নটাও চলে যাচ্ছে ভূমিদস্যুদের পকেটে। অথচ সে তো লোভ করেনি। লাঙল কাঁধে নিয়ে হাঁটা ধরে সে। আজ থেকে নুতন জীবীকার খোঁজে নামতে হবে সবাইকে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। চেনা পথে চলতে চলতে সে আউড়ায় “আহারে। আমার দুই শতক জমি”।