অতিথি পাখি
শহরের কোলাজ মতো ব্যস্ততা থেকে দূরে, নদীর পাড়ে ছোট্ট এক গ্রাম ছিল। গ্রামের মাঝে একঝোপের ঘরে থাকত বৃদ্ধা ললিতা। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই একাকীত্বে কাটিয়েছেন। দিনের বেলা বাগানে ফুলের যত্ন নিতেন, শীতের সকালে হাওয়ায় দোয়া পাঠ করতেন, আর সন্ধ্যায় নদীর ধারে বসে নদীর ঢেউয়ের কূর্দল শব্দ শুনে মনে শান্তি খুঁজতেন।
একদিন হঠাৎ ঝোপের উপর এক অচেনা, রঙিন পাখি এসে বসে। পাখিটি এতই সুন্দর ছিল যে ললিতা প্রথমে ভয়ে লাজুকভাবে তাকাল। কিন্তু পাখিটির চোখে যেন কোনো অদ্ভুত বোঝাপড়া, এক গভীর আকর্ষণ। পাখিটি তার ডানা ঝাপটাতে থাকলেও কখনো উড়ে গেল না। ললিতা প্রথমে মনে করলেন, এটি কেবল এক সৌন্দর্যের ঝলক, কিন্তু দিনগুলো কাটতে কাটতে পাখিটি যেন তার জীবনের অংশ হয়ে উঠল।
প্রতিদিন সকালে ললিতা যখন বাগানে কাজ করতেন, পাখিটি পাশে এসে বসত। মাঝে মাঝে পাখিটি নরম কণ্ঠে শব্দ করত, যেন কথার চেষ্টা করছে। ললিতা ভাবতেন, হয়তো প্রকৃতির কোনো চমকই তার জীবনের একাকীত্ব দূর করতে এসেছে। গ্রামের লোকেরা দেখল এই দৃশ্য, তারা বলত, “এই পাখি কোনো সাধারণ পাখি নয়, এটি যেন তোমার জীবনের অতিথি।”
বছর ঘুরল, পাখি আর ললিতার মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হল। পাখি কখনও দূরে যায় না, আর ললিতা প্রতিদিনের ব্যস্ততার মাঝেও এই বন্ধুত্বে আনন্দ খুঁজে নিতেন। মাঝে মাঝে পাখি নদীর ওপর উড়ে যেত, আর ফিরে আসত। তার ডানা যখন বাতাসে ছড়াত, ললিতা বুঝত, প্রকৃতির এই ছোট্ট অতিথি তাকে জীবনের বড় শিক্ষা দিচ্ছে—মুক্তি এবং বিশ্বাসের শক্তি।
একদিন ললিতা ভাবল, পাখিটিকে ঘরে নিয়ে আসা উচিত। কিন্তু পাখিটি শুধু বসে থাকল, চোখে যেন কোনো অদ্ভুত দুঃখ। ললিতা বুঝতে পারল, সত্যিকারের অতিথি কখনো জোরে বাধা দেয় না; সে আসে, থাকে, এবং চলে, যতক্ষণ সে ইচ্ছা করে। তিনি ডানার খোঁচায় পাখিটিকে মুক্তি দিলেন।
পরদিন পাখি আবার ফিরে এলো। এবার ললিতা জানলেন, আসল বন্ধুত্ব হয় মুক্তির মধ্যে, যেখানে কেউ কারও উপর জোর করে নয়। পাখি গ্রামের মানুষদের মাঝে আনন্দ ছড়াতো, আর ললিতা তার বন্ধু পাখির সঙ্গে নদীর ধারে বসে প্রকৃতির সব কণার সাথে গল্প করতেন।
শীত, বসন্ত, বর্ষা—প্রকৃতি যত পরিবর্তন ঘটাত, পাখি এবং ললিতার বন্ধুত্ব ততই গভীর হতে লাগল। পাখিটি কখনো ললিতার পাশে না থাকলেও, ললিতার মনে একটি শান্তির রঙ নেমে আসত। তিনি বুঝলেন, I কখনো কখনো জীবনে আসা অতিথি শুধু উপস্থিতি নয়, তারা আমাদের জীবনের গল্প, অভিজ্ঞতা, এবং অনুভূতির গভীরতা বাড়ায়।