উপন্যাস: “মানুষের ভিতরের মানুষ”
রাতের শেষ অন্ধকার ভেঙে ভোরের আগমুহূর্ত। দূরের গ্রামের ছোট্ট কুঁড়েঘরটিতে জন্ম নিল এক শিশু—তার নাম হলো আরিব। জন্মের মুহূর্ত থেকেই তার কান্নার সুর ছিল অন্যরকম; তীক্ষ্ণ নয়, শান্ত নয়—অদ্ভুত এক গভীরতা ছিল সেই কান্নায়। যেন এ পৃথিবীতে আসার আগেই সে অনেক কিছু জেনে এসেছে।
বাবা-মা দরিদ্র, কিন্তু সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন অনেক। এই পৃথিবী তাকে কি দেবে তারা জানত না, কিন্তু সে পৃথিবীকে কি দেবে—তার আশাও করত না। কেবল চাইত, সে যেন ভালো মানুষ হয়। আরিব খুব ছোটবেলা থেকেই অন্যদের মত ছিল না। অন্য ছেলেরা কাদা মাখা খেলে, দৌড়ায়, চেঁচায়—আরিব বসে আকাশ দেখে। সে জিজ্ঞেস করত—“মা, আকাশের ওপারে কি আছে?” মা জানত না, কিন্তু উত্তর দিত—“আলো আছে বাবা, আলো।”
আলোর প্রতি তার এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। রাতে মশালের আলো, দুপুরে রোদ, বজ্রপাতের আগুন—যে কোন আলোতে সে দাঁড়িয়ে থাকত চুপচাপ। বাবা বলত—“এই ছেলে একদিন বড় কিছু হবে।” কিন্তু বড় কিছু মানে কী—সেটা কেউ জানত না।
সময় এগিয়ে যায়। আরিব বড় হতে থাকে, কিন্তু তার ভেতরে জন্ম নেয় একাকিত্ব। তার বন্ধু ছিল না, কারণ সে অন্যদের মতো খেলাধুলা বা দৌড় প্রতিযোগিতা বুঝত না। সে বুঝত মানুষ কাঁদে কেন, মানুষ ভাঙে কেন, মানুষ ভালো হয় কীভাবে। সে অনেক রাতে ঘুমানোর আগে ভাবত—“জীবন আসলে কী?”
একদিন স্কুলে নতুন এক মেয়ে আসে—তার নাম ছিল সামিনা। তাকে দেখেই আরিব প্রথমবার অনুভব করল, হৃদয়ের ভিতর লুকানো আলো যেন দু’মুহূর্তের জন্য ঝলসে উঠল। সামিনার হাসি ছিল কোমল, আরিবকে প্রথমবার মনে করালো— সে একা নয়। তারা ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করল। চারপাশের মানুষ তাদের নিয়ে হাসাহাসি করলেও তারা পাত্তা দিত না। দু’জনের মাঝে জন্ম নিল নরম সম্পর্ক—যা প্রেম না হলেও প্রেমের চেয়েও মূল্যবান।
কিন্তু সুখ কখনো দীর্ঘ হয় না। সামিনার বাবা শহরে চাকরি পেল। পরদিনই সামিনাকে যেতে হবে। বিদায়ের আগের সন্ধ্যায় সামিনা শুধু বলল—“তুমি একদিন তোমার ভেতরের আলো খুঁজে পাবে।” আরিব উত্তর দিতে পারেনি। সে শুধু তাকিয়ে ছিল সামিনার চলে যাওয়া গাড়ির পিছনের ধুলোর দিকে। সেই ধুলোতে মিলিয়ে গেল তার প্রথম আলোর স্পর্শ।
জীবন তখন তাকে নতুন পথে ঠেলে দিল। সে কলেজে গেল, শহরে পড়তে গেল, ভাড়া বাসায় থাকত। দিনে ক্লাস, রাতে দোকানে কাজ। ঘুম কম, কষ্ট বেশি—কিন্তু সে পিছপা হল না। তার লক্ষ্য ছিল সহজ—নিজেকে খুঁজে পাওয়া। সে বুঝতে শিখল, মানুষ যত বড় হয়, তত বেশি একা হয়ে যায়। কিন্তু একা হওয়া খারাপ নয়—একা হওয়া মানুষকে গভীর করে।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হলো। চাকরি পেলেও বেতন কম, জীবন কঠিন, কিন্তু সে খুশি ছিল। কারণ এখন সে বুঝেছে, ছোট ছোট অর্জনই বড় স্বপ্নের পথ খুলে দেয়। এই সময়ে তার জীবনে আসে রিদা—সাধারণ, শান্ত, বাস্তববাদী। সামিনার মত ঝড় ছিল না, কিন্তু ছিল প্রশান্তি। আরিব রিদাকে বিয়ে করল। তাদের সংসার হলো ছোট, কিন্তু ভালোবাসায় পূর্ণ।
এরপর জন্ম নিল তাদের মেয়ে—আরফা। শিশুটি আরিবকে শিখাল, জীবন যতই কঠিন হোক, সন্তানের এক হাসি সব ব্যথা ভুলিয়ে দেয়। আরিব তখন বুঝল—মানুষের মধ্যে সবচেয়ে আলো থাকে সন্তানের চোখে।
বছর কেটে যেতে লাগল। বাবার মৃত্যু তাকে ভেঙে দিল। মায়ের অসুস্থতা তাকে বোঝাল—জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। কাজের চাপ, পরিবারের দায়িত্ব, নিজের ভেতরের ক্লান্তি—সব মিলিয়ে সে নিঃশব্দ হয়ে গেল। রাতে নিজের মেয়েকে ঘুমাতে দেখে মনে হতো—আমি আজো আমার ভেতরের মানুষটাকে খুঁজে পাইনি।
একদিন তার মেয়ে জিজ্ঞেস করল—“বাবা, তুমি কি সুখী?”
এই প্রশ্নে আরিব থেমে গেল। সে জানত না কী উত্তর দেবে। কারণ সুখ তার জীবনে এসেছে অনেকবার, আবার সরে গেছে অনেকবার। সে বলল—“আমি আলো খুঁজছি।”
মেয়ে হেসে বলল—“আলো কি খুঁজে পেতে হয়? আলো তো নিজের ভিতরেই থাকে।”
এই কথাটি আরিবকে বদলে দিল।
বার্ধক্য ধীরে ধীরে এসে গেল। চুল সাদা হলো, মুখে ভাঁজ, হাতে দুর্বলতা। কিন্তু তার মন তখন আগের চেয়ে শান্ত। সে বুঝল—জীবনের বড় শিক্ষা হলো: মানুষ বাইরে আলো খোঁজে, যতক্ষণ না বুঝে—আলো সবসময় নিজের ভিতরেই ছিল।
এক শীতের রাতে, ঘরের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছিল। রিদা তার হাত ধরে ছিল, আরফা তার পাশে বসে ছিল। আরিব গভীর শ্বাস নিল। তার মনে হলো—এবার সে পুরো পথটুকু বুঝে ফেলেছে।
সে চোখ বন্ধ করল।
তার শেষ অনুভূতি ছিল—আলো আসলে কখনো নিভে যায় না, শুধু শরীর বদলায়।
আরিব চলে গেল নিঃশব্দে।
কিন্তু তার আলো ছড়িয়ে রইল পরিবারে, মানুষের মনে, আর তার নিজের খুঁজে পাওয়া সত্যে।
এভাবেই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের ভেতরের মানুষ খুঁজে পাওয়ার যাত্রা শেষ হলো—কিন্তু গল্পের আলো রয়ে গেল অনন্ত।