Posts

চিন্তা

ধর্মকে গণমানুষের কাছে অসহ্য করে তোলা আপনার ব্রত নয়!

November 20, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

114
View

বিচার গানের শিল্পী মানিকগঞ্জের ছোট আবুল সরকার গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই ভদ্রলোক শিল্পী ও সুফি সাধক। কয়েক দশক ধরে গান করে আসছেন। এতদিন কিছু হয়নি। নতুন বন্দোবস্তের পর এখন যেন সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।

আমরা নিশ্চিত এখনকার এই দেশে লালন ফকির, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ, দূরবীন শাহ -কেউই টিকতে পারতেন না। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকলে এরা তাঁকে টিনে হিচড়ে শূলে চড়াত।

বিচার গান এই ভারতবর্ষের হাজার বছরের লোক ঐতিহ্য। ধর্ম, শাস্ত্র ও নীতিকথার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধ চর্চা ও গানের ভাবাবেগে শিল্পী ও তাঁদের শিষ্যদের নিজস্ব সাধনার মার্গ উন্মোচন করবার বাইরে তাদের তেমন কোনো গুরুতর কাজ নেই। তারা কোনো মানুষকে বিপথে নিয়ে গেছেন এমন অভিযোগও তাই খুব ঠুনকো।

পৃথিবীর সকল ধর্ম তার নিজস্ব রীতি মেনে চলে, আপনাআপনিই সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। এবং করেই চলেছে। ধর্মের আবেদন কমেছে এমন নজির খুব বেশি নেই। তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে একজন ব্যক্তির প্ররোচনার বয়ান একেবারেই ঠুনকো ও মনগড়া। শাস্ত্রগত ঐশী ধর্মে সামান্য পরিবর্তন, পরিমার্জন ও বিবর্তনের মুরোদ‌ কোনো মানুষের নেই। সেখানে একজন লোক শিল্পীকে গান গাওয়ার অপরাধে জেলে ভরে দিলে ধর্মের অনুভূতি বাঁচবে -এটি ভীষণ হাস্যকর।

ধর্ম হল মানুষের অভ্যন্তরীণ মুক্তি এবং বিশ্ব মানবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক জীবন যাপন। ধর্মতন্ত্র বা বাহ্যিক আচারের চেয়ে মানুষের মধ্যেকার ত্যাগের ইচ্ছা ও ভালোবাসাই আসল ধর্ম। মানুষের ধর্ম হল সেই ধর্ম যা মানুষকে ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় এবং মানুষের মধ্যকার সকল ভেদাভেদ দূর করে ‘অমৃতের সন্তান’ হিসেবে সকলকে এক করে দেখতে শেখায়। -বাংলা সাহিত্যের দিকপাল এবং আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাগুলো উড়িয়ে দেবেন কোন মুখে?

আপনার মনে যদি ভুলেও এই প্রতীতি জাগে যে, পবিত্র ধর্ম বা মহান স্রষ্টাকে কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষ অসম্মান বা অমর্যাদা করবার সক্ষমতা রাখে, তবে আপনি ঐশ্বরিক শক্তির চরম অবমাননা করলেন। এবং আপনি ঈশ্বরের সৃষ্ট হিসেবে নিজেকেই অধঃপাতে নিপতিত করলেন। নিজের অধঃপাত না ঠেকিয়ে অন্যের পেছনে খামোখা কেন লাগতে যাবেন?

প্রিয় মহাত্মন আপনাদের একটা অনুরোধ করি...
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'মানুষ' কবিতাটি হাজারবার পড়েন। অনুভূতি শক্ত করেন। দেখবেন পৃথিবীটা হিংসা ও বিভাজনের নয় -অতি অবশ্যই সুন্দর সহাবস্থানের।

তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কা’রা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!
আদম দাউদ ঈসা মূসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর, বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশি ক’রে প্রতি ধমনীতে-রাজে।
আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ,
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।
হেস না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।
হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদি ঈসা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারি বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি!

অতঃপর ভেবে দেখেন নিরীহ নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ মহারাজ আবুল সরকারকে আপনাদের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করা যায় কিনা? ধর্মকে কেন গণমানুষের কাছে অসহ্য করে তুলতে যাবেন? আপনার কাজ তো এটা নয়। এটা করতে পারবেনও না। বরং ধর্মের মহিমা ও গড়িমা উত্তরোত্তর চারিধার আলোকিত করবে এবং নিজেও সমৃদ্ধ হবেন -যদি ধর্মের অনুসারী ব্যক্তি আপনি সকল প্রাণের প্রতি চরম স্থৈর্য, প্রেম, ঔদার্য ও মহানুভবতা দেখান।

লেখক: সাংবাদিক 

২০ নভেম্বর ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login