Posts

প্রবন্ধ

একজন অ্যাপ্রুভার বা ‘রাজসাক্ষী’ কে কি সাজা দেয়া যায়?

November 23, 2025

রাইসুল সৌরভ

38
View

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)-১ গ্ত ১৭ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রথম রায় ঘোষণা করেছেন। যেখানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একই মামলায় আরেক অভিযুক্ত এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩ অনুসারে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হিসেবে বিবেচিত সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও পাঁচ বছরের জেল দেয়ায় দেশে আলোচনা তৈরি করেছে। এ সংক্রান্ত পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, জুলাই শহীদদের পরিবারের সদস্যরা মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড মেনে নিতে পারেননি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি তাকে কমপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার দাবি করেছেন। অন্যদিকে, আইনাঙ্গনে কেউ কেউ মনে করছেন যে আইন অনুযায়ী প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষের) সাক্ষী হিসেবে তাকে খালাস দেয়া যেত।

আইসিটি আইনের ১৫ ধারায় অ্যাপ্রুভার বা অনুমোদনকারী শব্দটি রয়েছে। যদিও আইনের কোথাও এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। শব্দটি উল্লিখিত ধারার মূল অংশেও নেই; শুধু ধারার শিরোনাম/প্রান্তিক নোটে রয়েছে। দেশে প্রচলিত ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতেও (সিআরপিসি) শব্দটির কোন উল্লেখ বা সংজ্ঞা দেয়া নেই। সাধারণত অ্যাপ্রুভার বা বহুল প্রচলিত রাজসাক্ষী বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনও অপরাধের সাথে জড়িত বা জড়িত বলে মনে করা হয়, যিনি নিজের দোষ স্বীকার করে ওই অপরাধের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সকল দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার জ্ঞানত পূর্ণাঙ্গ ও সত্য সাক্ষ্য প্রদান করতে রাজি হন ক্ষমা পাওয়ার শর্তে। এসকল ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি দেন যে অপরাধের ব্যাপারে তার যতটুকু জ্ঞান আছে, ততটুকু তিনি পুরোপুরি সততার সঙ্গে প্রকাশ করবেন। তার সঙ্গে যারা অপরাধে জড়িত ছিলেন, তাদের কথাও তিনি অকুণ্ঠভাবে বলবেন। বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে আইনানুসারে আটক রাখা হয়।  সাধারণত গুরুতর ও জটিল প্রকৃতির অপরাধের ক্ষেত্রে প্রমাণের অভাবে যেন বিচার অনিষ্পন্ন থেকে না যায়, সেজন্য আইনে এ ধরণের বিধান রাখা হয়। 

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ও ৩৩৯ ধারায় রাজসাক্ষী কে হবেন, রাজসাক্ষীকে ক্ষমা করা ও বিচারপদ্ধতির বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে অ্যাপ্রুভার সংক্রান্ত বিধান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় দেয়া হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে বিচার শেষে ক্ষমা প্রদান করা হয়, সেসব ক্ষেত্রে তাকে সর্বদা ক্ষমা প্রদানের শর্তসমূহ স্পষ্টভাবে জানাতে হয়। প্রাক্তন পুলিশ প্রধান চৌধুরী মামুন হলেন আইসিটি আইনের অধীনে অ্যাপ্রুভার হিসেবে ঘোষিত প্রথম ব্যক্তি এবং সম্ভবত সে কারণেই তার নমনীয় শাস্তির উপযুক্ততা নিয়ে এখন বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, অভিযোগ শুনানির সময় ট্রাইব্যুনাল তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি দোষী নাকি নির্দোষ। সেই মূহুর্তে সাবেক পুলিশ প্রধান নিজের দোষ স্বীকার করে বলেছিলেন, "জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় আমাদের বিরুদ্ধে আনা হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ সত্য। আমি এই অভিযোগগুলির জন্য দোষী সাব্যস্ত। আমি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হতে চাই এবং জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সংঘটিত অপরাধের সম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করতে চাই। সত্য উদঘাটনে আমি আদালতকে সহায়তা করতে চাই।" ফলস্বরূপ, ট্রাইব্যুনাল তার আবেদন মঞ্জুর করে এবং তাকে মামলার একজন অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হিসেবে গণ্য করে। তখন থেকে তাকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং এ মামলায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। পরবর্তীকালে তার সাক্ষ্যে তিনি বলেছিলেন যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত বছরের ১৮ জুলাই তিনি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে সেই আদেশ পান। সুতরাং, বিচার শেষে  এখন গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন উঠেছে যে মামলার অভিযুক্ত একজন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে কি শাস্তি প্রদান করা সমীচীন নাকি শর্ত পূরণ করলে খালাস দেয়া যায়।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর পূর্বেই রাজসাক্ষী চৌধুরী মামুনের ভাগ্য সম্পর্কে বলেছিলেন যে এটি পুরোপুরিভাবে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার। ট্রাইব্যুনাল উপযুক্ত মনে করলে তাকে ক্ষমা করতে পারেন; যদি তার সাক্ষ্যের মাধ্যমে অপরাধের পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ পায় অথবা ট্রাইব্যুনাল চাইলে অন্য কোন আদেশও দিতে পারেন। আইসিটি আইনে বর্ণিত এই ক্ষমার শর্তগুলি হল অ্যাপ্রুভার কর্তৃক i) পরিপূর্ণ (আংশিক নয়) ii) সত্য (বানোয়াট নয়) এবং iii) সম্পূর্ণ ঘটনার প্রকাশ।

এই মামলায় ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন যে, সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে সাক্ষী হিসেবে অভিযোগ প্রমাণে প্রাক্তন আইজিপির ভূমিকা/অবদান/স্বীকারোক্তি/সহযোগিতা বিবেচনা করা হয়েছে। তিনি জুলাই-অগাস্টে ৩৬ দিনের আন্দোলনের সকল ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। ট্রাইব্যুনালের আদেশ অনুসারে আল-মামুন তার জ্ঞানত ‘সমস্ত পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ এবং সত্য বিবরণ’ প্রকাশ করেছেন; যার মধ্যে তার নিজের এবং অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তির জড়িত থাকার বিবরণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যদিও অপরাধে জড়িত থাকার কারণে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যেত, কিন্তু আদালত এজন্য নমনীয়তা দেখিয়ে তাকে মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। 

রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল আরও উল্লেখ করেছেন যে, তাদের কাছে মনে হয়েছে তিনি অপরাধের সাথে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেছেন। সেই কারণে তাকে তার সহ-অভিযুক্তদের তুলনায় কম শাস্তি দেওয়া হয়েছে; যদিও ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান এবং চৌধুরী মামুনকে প্ররোচনা, উস্কানি, গণহত্যার আদেশ প্রদান, ঊর্ধ্বতন কমান্ডের দায়িত্বে থাকা অপরাধ এবং যৌথ অপরাধমূলক উদ্যোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছে।

তবে মিডিয়া সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিচার চলাকালীন আইসিটি-১ এ সংক্রান্ত এক আদেশে বলেছিলেন যে, সকল দিক বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল বিশ্বাস করে যে, অভিযুক্ত চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ক্ষমা করা যেতে পারে এই শর্তে যে তিনি জুলাই মানবতা বিরোধী অপরাধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ এবং সত্য বিবরণ প্রকাশ করবেন এবং অভিযোগ এবং জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তার কাছে থাকা সমস্ত তথ্য সরবরাহ করবেন। ফলে সঙ্গত কারণেই এখন প্রশ্ন উঠেছে তাহলে সেই আদেশানুযায়ী শর্ত পূরণ করে থাকলে খালাস না দিয়ে এখন কেন কারাদণ্ড দেয়া হল।

এখন প্রশ্ন হলো, অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষীকে খালাস না দিয়ে সাজা দেয়ার সুযোগ কখন থাকে? সাধারণত যদি সাক্ষী উপরিউক্ত শর্ত পূরণ না করে, তাহলে আইন অনুযায়ী ক্ষমা না করে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে। সেক্ষেত্রে তাকে যার জন্য ক্ষমা করা হয়েছিল, সেই মূল অপরাধের জন্য বিচার করা যেতে পারে এবং ক্ষমা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেয়া তার নিজের স্বীকারোক্তি/বিবৃতি সেই বিচারে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া যদি সাক্ষী ক্ষমার আওতায় পড়ে না, এমন কোন ভিন্ন অপরাধ করেছে বলে বিচারে প্রমাণিত হয়; তবে তাকে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। অতএব, ফৌজদারি কার্যবিধি ও আইসিটি আইনে উল্লিখিত ক্ষমা অ্যাপ্রুভারের সকল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সম্পূর্ণ দায়মুক্তি প্রদান করে না।

তবে জটিলতা এখানেই শেষ হচ্ছে না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আইসিটি আইনে ব্যবহৃত ক্ষমা (pardon) শব্দটির আইনগত অর্থ কী? এর অর্থ কি খালাস, নাকি যা দেওয়া উচিত ছিল তার চেয়ে কম শাস্তি? বিভ্রান্তি এড়াতে আদালতের কাছ থেকে এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। যদিও প্রচলিত ফৌজদারি মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে বিচার করা হলে শর্ত ভঙ্গ না করলে সাধারণত খালাস দেয়া হয়। তবে আইসিটি আইনের ২৬ ধারানুসারে এই বিচারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনসহ অন্যান্য সাধারণ আইন কার্যকর হবে না। 

এই আইনি জটিলতা নিরসনে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, জুরিস্প্রুডেন্স ও ইতোমধ্যে সংঘটিত বিচারব্যবস্থা পর্যালোচনা করতে পারি। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধির ৬৫ অনুচ্ছেদে অপরাধ স্বীকারের উপর একটি আইনি কাঠামো ও বিধান রয়েছে। তবে সেখানে আদালত অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি আমলে নিতে বাধ্য নয় এবং আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে: i) অভিযুক্ত ব্যক্তি তার দ্বারা প্রদেয় স্বীকারোক্তির প্রকৃতি এবং পরিণতি বোঝে, ii) আইনজীবীর সাথে পর্যাপ্ত পরামর্শের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিতে ইচ্ছুক এবং স্বীকারোক্তি মামলার অন্যান্য তথ্য দ্বারা সমর্থিত। তবে রোম সংবিধিতে স্পষ্ট যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দিলেও তিনি অভিযুক্তই থাকেন; আমাদের আইসিটি আইনের মতো রাষ্ট্রপক্ষ বা প্রসিকিউশনের সাক্ষীতে রূপান্তরিত হন না। আবার অভিযুক্ত ব্যক্তি উপর্যুক্ত প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ করলেও আদালত অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত হলে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারেন। 

অতএব, রোম সংবিধির ৭৮ অনুচ্ছেদানুসারে স্বীকারোক্তি দিবেন এই শর্তে অভিযুক্তের জন্য পূর্বনির্ধারিত বা নমনীয় শাস্তির প্রদানের কোন সুযোগ নেই। এছাড়া, আইসিসি কর্তৃক গৃহীত অপরাধ স্বীকারোক্তি সংক্রান্ত চুক্তির নির্দেশিকানুসারে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযুক্তের স্বীকারোক্তির চেয়ে আদালতের স্বাধীন কর্তব্যের উপর সব সময় জোর দেয়। বিচারকদের কেবল পক্ষসমূহের মধ্যে চুক্তি নয়; বরং প্রসিকিউটরের দ্বারা উপস্থাপিত অন্যান্য প্রমাণ, যার মধ্যে ভুক্তভোগীর প্রতিনিধিত্ব এবং অন্যান্য উৎস অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে; তাও পরীক্ষা করতে হবে, যেন মামলা সংক্রান্ত তথ্য সম্পূর্ণ হয় এবং ন্যায় বিচার করা যায়। এছাড়াও, নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, অভিযুক্তের দ্বারা অপরাধ স্বীকার সম্পর্কে অভিযোগকারী/ক্ষতিগ্রস্ত/ভুক্তভোগীদের পূর্ণাঙ্গভাবে অবহিত করতে হবে এবং তাদের মতামত এবং উদ্বেগ উপস্থাপন করার সুযোগ দিতে হবে; যেন বিচারিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি তাদের স্বার্থকে উপেক্ষা করতে না পারে। অথচ আমাদের আইসিটি আইনে এ সম্পর্কিত কোন বিধানই নেই!

আবার, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া (আইসিটিওয়াই) এবং রুয়াণ্ডায় (আইসিটিআর) ব্যবহৃত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ICTY-এর বিধি 62 ter এবং ICTR-এর 62 bis-এর অধীনে স্বীকারোক্তি সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক আবেদনের বিধান রয়েছে। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট অভিযোগের জন্য দোষ স্বীকার করতে পারেন; তবে সাধারণত তা প্রসিকিউটরের সাথে আলোচনার পরে করা হয়ে থাকে। যেখানে প্রসিকিউটর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তির বিনিময়ে তার বিরুদ্ধে আনীত অন্যান্য অভিযোগ প্রত্যাহার বা শাস্তি কমাতে সুপারিশ করতে সম্মত হন। তবে ট্রায়াল চেম্বার প্রসিকিউটর ও অভিযুক্তের মধ্যকার এই চুক্তি মানতে বাধ্য নন। বিচারকদের যাচাই করতে হয় যে আবেদনটি স্বেচ্ছায় করা হয়েছে, এর পরিণতি সম্পর্কে তিনি অবহিত ও দ্ব্যর্থহীন ছিলেন এবং অপরাধের জন্য যথেষ্ট তথ্যগত ভিত্তি বিদ্যমান ছিল। এসব ক্ষেত্রে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারক তাকে যথাপোযুক্ত সাজা দিতে পারেন। তবে দোষ স্বীকার করে নেয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে সাজার মেয়াদ হ্রাস করা হয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনশাস্ত্রে কোন অপরাধীকে দোষ স্বীকারের পুরষ্কার স্বরূপ ক্ষমা না করার বিষয়টি বোঝার জন্য আমাদের প্রথমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের লক্ষ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের উদ্দেশ্য কেবল অপরাধীকে শাস্তি দেয়া নয়; বরং বিচারের মাধ্যমে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, পুনর্মিলনকে উৎসাহিত করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের অপরাধ প্রতিরোধ করা। 

অন্যদিকে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে শুধু অপরাধ স্বীকার করে নেয়ায় একতরফাভাবে ক্ষমা করে দিলে এই উদ্দেশ্যসমূহ দুর্বল হয়ে যাবে। শাস্তি ব্যক্তির অপরাধ এবং অপরাধের গুরুত্ব প্রতিফলিত করার জন্য দেয়া হয়; অপরপক্ষে ক্ষমা চতুরভাবে বিচারিক প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে যায়। 

সুতরাং, চৌধুরী মামুনের মতো একজন অপরাধী যিনি পুলিশ প্রধান হিসেবে ঘটনার সময় উচ্চপদস্থ দায়িত্বে ছিলেন; তার নির্দেশে ও সহায়তায় হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে এবং যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় আদালতে স্বীকার করেছেন ও দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন; তাকে খালাস দিলে ন্যায় বিচার পরাহত হয়। মানবতা বিরোধী অপরাধের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের ব্যাপকতা, মাত্রা, ক্ষতির সীমা ও পরিধি, ভয়াবহতা, পরিণতি প্রভৃতি আমলে নিলে তাকে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা বা খালাস করে দিলে তা আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য ব্যক্তিগত ফৌজদারি দায়বদ্ধতার মূল নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। তবে তাকে প্রদেয় শাস্তি অবশ্যই আইনানুগভাবে হতে হবে।

এখন প্রশ্ন হল, তিনি কি ন্যায় বিচারের পরিপূর্ণ সুযোগ না পেয়ে শাস্তি পেয়েছেন? শর্ত লঙ্ঘন না করে একজন প্রসিকিউশন সাক্ষীকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে? তিনি কি তার বিচার চলাকালীন তার পক্ষে সাফাই সাক্ষী আনার সুযোগ পেয়েছিলেন? কিংবা তার বিরুদ্ধে আনা সাক্ষীদের জেরা করার সুযোগ পেয়েছিলেন? নাকি বিচারের শুরুতে তার অপরাধ স্বীকার করে নেয়ার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে আর বিচার না করে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হল?

এসব বিষয়ে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ধোঁয়াশা থাকলেও, এ কথা স্পষ্ট যে বারবার সংশোধন করা সত্ত্বেও আমাদের আইসিটি আইনে এখনও অনেক অস্পষ্টতা এবং আইনি ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে এবং আইনটি এখনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি। আইনি এসব অস্পষ্টতা ও দুর্বলতার কারণে এখন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিচার প্রক্রিয়া ও শাস্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষত অ্যাপ্রুভার সংক্রান্ত বিধানে দেশে প্রচলিত আইন বা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড কোনটিই অনুসরণ করা হয়নি। ফলস্বরূপ, কোন দিক দিয়েই এই শাস্তি বা তার পরিমাণ ন্যায্যতার মানদণ্ড উত্তীর্ণ হতে পারেনি। যার ফলে এখন ন্যায়বিচার বাঁধাগ্রস্ত হতে পারে এবং সামগ্রিক বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্চতা এবং ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

Comments

    Please login to post comment. Login