আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা
আর কত কাল আমি রব দিশাহারা
রব দিশাহারা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান।
গানটির সঞ্চারিতে আছে,
আমি পথ খুঁজি নাকো পথ মোরে খোঁজে
মন যা বোঝে না বুঝে, না বুঝে তা বোঝে।
বস্তুত আমাদের সবার অবস্থাই আসলে এমনই। নিজের ছায়ার পিছে ঘুরে ঘুরে মরে আত্মশ্লাঘার ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়ছি। 'মনের মানুষ' -যার সাধনায় আমরা সবাই রত -তাকে আর ধরতে পারছি না।
বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্য বিচার গানের মূল শক্তি হলো -প্রশ্ন করা। ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন তুললে অনেক আলেম মনে করেন তাদের কর্তৃত্ব বা ব্যাখ্যাধিকার চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। তারা মনে করেন সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হতে পারে।
বিচার গানে অনেক সময় রসিকতা, exaggeration, এমনকি ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যঙ্গ থাকে। ধর্মীয় বিষয়কে হাস্যরস বা পাল্টা কথার মাধ্যমে উপস্থাপন করা অনেক মৌলভি অসম্মানজনক বলে মনে করেন।
মৌলভিরা ভুল ধরেন কারণ-
বিচার গানের তর্কমূলক, ব্যঙ্গাত্মক, লোকায়ত উপস্থাপনা ধর্মীয় ‘গুরুত্ব’ ও ‘শুদ্ধতা’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। একজন বিচার গায়েন মুক্তভাবে যুক্তি দেন, আর একজন মৌলভি ধর্মীয় নিয়মে আবদ্ধ -এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত থেকেই ভুল ধরার প্রবণতা।
একজন বিচার গানের গায়ক ও মৌলভির ঐকতান সম্ভব তখনই, যখন দু’জনই বুঝবেন যে লক্ষ্য এক -মানুষকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও সত্যের পথে রাখা। বিচার গায়েন লোকজ ভাষা, রসিকতা ও তর্ক দিয়ে সামাজিক সত্য তুলে ধরেন, আর মৌলভি ধর্মীয় শাস্ত্রের আলোকে নৈতিকতা বোঝান। যদি তারা পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে নিদেদেরকে একই সত্যের দুই ভিন্ন ভাষ্যকারী হিসেবে গ্রহণ করেন, তবে লোকসংস্কৃতির প্রাণবন্ত প্রকাশ ও ধর্মীয় নৈতিকতার বার্তা মিলেমিশে মানুষের মননে পৌঁছাতে পারে। এতে অপকার নয়, বরং মানুষের উপকারই হবে।
ছোট আবুল সরকারকে ইতোমধ্যে সবাই চিনে নিয়েছেন। স্বশিক্ষিত মানুষটি বিচার গানের বড় গায়েন। তিনি তার প্রতিপক্ষকে প্রশ্নবাণে ঘায়েল করে সুর ও বাণীর মহিমা ছড়ান। সামান্য কাটপিস অংশ নয় তাঁর হাজারটা গানের আসর পর্যালোচনা করলে দেখবেন আল্লাহ্ ও নবী(সা.) প্রশস্তিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এমনকি যে আসরের টুকরো অংশ প্রচার করে মিস্টার আবুল সরকার ও তাঁর শিষ্যদেরকে শাস্তিযোগ্য করা হচ্ছে -ওই অনুষ্ঠানের শেষাংশ ছিল দ্বৈত শিল্পী ও দোহারদের আল্লাহ্ প্রশস্তিতে ভরা ভাবাবেগের এক মহামিলন মেলা। কাজেই মানুষকে বিচার করবেন তাঁর সামগ্রিক কর্ম মূল্যায়ন দিয়ে। ক্ষণিকের কিয়দাংশ অপপ্রচার ও অপপ্রয়োগ কখনোই কারো সত্যিকারের মনুষ্য পরিচয় নয়।
ধর্মাচার নিয়ে আমাদের ৭২ দলে গুনে গুনে বাহাত্তর ফেরকাই বলবৎ আছে -এটা তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না। কেউ কয় তারাবির নামাজ ২০ রাকাত -কেউ কয় ৮ রাকাত। তাতে নামাজের মহিমা থেকে তো আমরা বিচ্যুত হয়ে যাই না। কারো কাছে শিয়া ভালো, কারো কাছে সুন্নি। চূড়ান্ত বিচারে কেউ তো আল্লাহ্-রাসূলের বাইরে নন।
একজন গায়েন তাঁর বিপক্ষ শিল্পীকে যুক্তিতে হারিয়ে দিতে মাথা আর গোয়াকে যদি উদাহরণ হিসেবে আনেন তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় বলে সোরগোল তুলবেন কেন? মহান স্রষ্টার সৃষ্ট প্রতিটি অঙ্গই আপনার আমার জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মাথার কথা বাদ দিলাম, অশুচি বা অপবিত্র ভাবনায় 'গোয়া' বন্ধ করে দিয়েছেন -কল্পনা করে দেখেন তো আপনার শরীর, দেহ, মনে কী কী ঘটে? আদৌ আপনি পৃথিবীতে সারভাইব করতে পারেন কিনা? তাই যদি না হতো মনুষ্য সমাজে Colorectal surgeon সবচেয়ে মর্যাদা পেতেন না।
মানিকগঞ্জের যে আসরের ভিডিও ক্লিপিংস মামলার বাদি প্রমাণ বলে মানছেন -ওই আসরে ছোট আবুল সরকার জীবের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। আর তাঁর প্রতিপক্ষ অপর শিল্পী ছিলেন পরমের ভূমিকায়। এখন বলেন তো মানুষ কখনো পরম হতে পারে? অভিনয়ে এটা সম্ভব। ওয়াজ মাহফিলের ময়দানে মৌলভি যখন শয়তান বা ফেরাউনের বিত্তান্ত বর্ণনা করেন ওখন তিনি ওই সময়টায় শয়তান বা ফেরাউনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এখন এসব বিষয়ে আপনি যদি পদে পদে ভুল খোঁজা কিংবা ছিদ্রান্বেষণ করতে থাকেন -তাহলে বহুত্ববাদী মানুষের সুন্দর সহাবস্থান কখনোই সম্ভবপর নয়।
কবি গান, পালা গান বা বিচার গান এই পরগণায় আগেও ছিল। এখন যা চলছে ওটারই ধারাবাহিকতা মাত্র। কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর মুক্তচিন্তার কারণে কা'ফের ও মু'রতাদ অভিধা বরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নজরুল রয়ে গেছেন। তকমাধারীদের কেউ মনে রাখে নি। তবে এখন একটু বেশিই সমস্যা হচ্ছে। কারণ কী? আগে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক নামের তাৎক্ষণিক সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। গসিপের কালাপাহাড় যত্রতত্র গণমাধ্যম ছিল না। যে কারণে সুফিবাদি, ফকির, গায়েন ঘরাণার সহজিয়া মানুষদের নিগূঢ় সাধনার হদিস প্রতিক্রিয়াশীলদের দরবারে পৌঁছত না। আমাদের সমাজে পরমতসহিষ্ণুতা প্রায় নেই বললেই চলে। এমন গণপরিসরে বাউল-ফকিরদের হজম করা বেজায় কঠিন। এই কঠিনেরে ভালোবাসার মানুষ প্রায় নাই হয়ে গেছে।
মোদ্দাকথা হলো মানুষ কেউই ভুলের উর্ধ্বে না। সেই ভুলগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে সত্য, সুন্দর ও ভালোত্বের পথটার সন্ধান যদি নিজেরা করি -অন্যেরা ওই আলোকবর্তিকার সুবর্ণ স্পর্শ এমনিতেই পেয়ে যাবে। অন্যের বিশ্বাসের মর্যাদা যদি আমি দিই -তাহলে আমিও কি অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে যাই না? অন্ধতা ভুলে প্রশ্নটাই জারি রাখতে হবে সবখানে সবার।🫡
লেখক: সাংবাদিক
২৩ নভেম্বর ২০২৫