ভূমিকম্পের ছায়া
শহরটা সবসময় ব্যস্ত থাকত। সকাল হোক বা সন্ধ্যা, মানুষের পদচারণা কখনো থামত না। কিন্তু সেই ব্যস্ততার মধ্যে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা লুকানো ছিল। মাটির গভীরে, অদৃশ্য কিছু শক্তি ক্রমে জমা হচ্ছিল।
একদিন ভোরবেলা, আরিফ নামের এক তরুণ শহরের বাজারে হাঁটছিল। হঠাৎ তার পায়ের নিচে মাটির অদ্ভুত কম্পন অনুভব হলো। প্রথমে সে ভেবেছিল, হয়তো কোনো ট্রাকের চাপ। কিন্তু কম্পন ক্রমে বেড়ে চলল, এবং শহরের অন্যান্য মানুষও এটিকে অনুভব করতে লাগল।
শহরের টেলিভিশন আর রেডিও সবই অচল। আরিফ তার ফোন খুলে খবর দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু নেটওয়ার্ক মাটির নিচ থেকে যেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষজন আতঙ্কিত, কেউ চিৎকার করছে, কেউ দৌড়াচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ, আরিফ লক্ষ্য করল—শহরের কিছু মানুষ কেমন অদ্ভুতভাবে শান্ত। তারা শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।
আরিফ শহরের কেন্দ্রস্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সেখানে বড় একটি ফাটল শুরু হয়েছে। ফাটলের চারপাশে ধোঁয়া আর মাটির গন্ধ, আর প্রতিটি কাঁপুনি যেন শহরের হৃদয়কে ছিঁড়ে দিচ্ছিল। তিনি তখন বুঝলেন, এটি সাধারণ ভূমিকম্প নয়। এটা এক প্রাচীন শক্তির বার্তা।
ফাটলের পাশে একটি প্রাচীন বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে, যার তলায় মাটির আগুন গলে আছে। বৃক্ষটি যেন পৃথিবীর নিজস্ব চোখ। আরিফ দেখল, তার চারপাশের মানুষজন ক্রমে মাটির স্পন্দন শুনতে শুরু করছে। তাদের চোখের ভেতর অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল।
ভূমিকম্প ক্রমে বাড়তে থাকল, কিন্তু ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে শহরের অনেক মানুষ তাদের হারানো স্মৃতি এবং অনুভূতি ফিরে পেতে লাগল। শিশুদের হাসি, বৃদ্ধদের স্মৃতি, প্রেমের কণ্ঠ—সবই মাটির কম্পনে ফিরে এল।
আরিফ বুঝতে পারল, ভূমিকম্প কেবল ধ্বংস নয়। এটি পৃথিবীর শিক্ষা, সতর্কতা। যারা শুনতে শিখেছে, তারা বেঁচে গেছে; যারা শোনেনি, তারা হারিয়েছে।
ফাটল ধীরে ধীরে বন্ধ হতে লাগল। শহর ধূলিময় হলেও মানুষের মন এক নতুন আলোর সঙ্গে জেগে উঠল। আরিফ ভাবল, “প্রকৃতি শুধু শক্তি নয়, সে বুদ্ধিমত্তা, সতর্কতা এবং জীবনের পথপ্রদর্শক।”
শহরের মানুষ ধীরে ধীরে বুঝল—ভূমিকম্প কেবল ভূমিকম্প নয়। এটি পৃথিবীর কথা বলার ভাষা। আর যারা শোনে, তারা বেঁচে থাকে। আর যারা শোনে না, তারা ইতিহাসের ছায়া হয়ে যায়।
আরিফ সেই দিন থেকে প্রতিদিন মাটির ছায়ায় কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগল। সে জানল, পৃথিবীর ভাষা কখনো থামে না। মানুষ যতই অমনোযোগী হোক, পৃথিবী বারবার বলবে, যদি কেউ শোনে।