অর্থনীতিতে নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য কুমার সেনের পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জের মত্ত গ্রামে। তাঁর বাবা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। অমর্ত্য সেনের জন্ম কলকাতা শান্তিনিকেতনে হলেও তিনি বাংলাদেশের সাম্মানিক নাগরিক। মানিকগঞ্জ জেলায় হাকিম আলী গায়েন বলে এক বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন। যার নামে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রাম থিয়েটারের একটি দল হাকিম আলী গায়েন থিয়েটার গড়েছিলেন।
মানিকগঞ্জ বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি চর্চার অন্যতম আকড়ভূমি। এখানকার পালাগান, কবিগান আর বিচারগানের বহু শিল্পী দেশজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। আমাদের এই আখ্যানের প্রোটাগনিস্টের বাড়িও ওই মানিকগঞ্জ। বালকবেলার নানামুখী সংসার যন্ত্রণায় একাডেমিক পড়াশোনায় খুব বেশি আগাতে পারেন নি। তবে গায়েন হিসেবে ওই অপূর্ণতা মিটিয়ে দিয়েছেন ষোলোআনা। বহু সাগরেদ এখন তাঁর কাছে জীবনবাদী দীক্ষা নেন। সম্প্রতি এই গায়েন ধর্মাবমাননার অভিযোগ মাথায় নিয়ে অ্যারেস্ট হয়েছেন। বলা হচ্ছে, গান গেয়ে কতিপয় মানুষের মনে তিনি ব্যথা দিয়েছেন। ঘটনা কি আসলেই তাই? এই শিল্পী সম্প্রতি একটা গানের জলসায় স্থানীয় বিএনপি মনোনীত এমপি প্রার্থী আফরোজা খান রীতার পক্ষে ধানের শীষে ভোট চান। এবং ওই মঞ্চে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আমরা গান গাইতে পারব। অন্যথায় আমাদের গান শেষ। এটা গেল গল্পের একটা দিক।
আমাদের এই গায়েনের এক ভাই ও তাঁর পুত্র পাপেল সরকার গান অন্তপ্রাণ মানুষ। এই গায়েন তাঁর খাশ শিষ্য ও ভ্রাতুস্পুত্র এবং নিজ ভাইয়ের ভীষণ শ্রদ্ধার পাত্র। গায়েনের আরেকজন ছোট ভাই আছে। যাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন এই গায়েন নিজেই। সশস্ত্রবাহিনী থেকে রিটায়ার্ড ভাইটির পড়াশোনা ও ভরণপোষণ সব করেছেন বড় ভাই। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্নতার কারণে বড় ভাইটি এখন ছোট ভাইয়ের একেবারেই চক্ষুশূল। ছোটভাই এমন এক দলের রাজনীতির সাথে জড়িত -যারা এখন রাজ ক্ষমতায় আসীন। আমরা বাল্মীকির রামায়ণ এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যে লঙ্কার রাজা রাবণের কণিষ্ঠ ভ্রাতা বিভীষণের কথা জেনেছি। শত্রুতা শুরু হয় ঘর থেকে। এবং জ্ঞাতি যদি শত্রু হয় তার চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কেউ হয় না।
বা'উলিয়ানা বনাম সা'লাফিজম -স্রেফ ফিলোসফিক্যাল মতদ্বৈততার জন্য নিজের ভাইয়ের বিরোধিতা, ভরা জলসায় ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাওয়া এবং বিচার গানের যুক্তি তর্কের বিতর্কিত অংশ হাইলাইটস করে অপপ্রচার। তিনে তিনে মিলে গেল ছয়। এখনকার বাংলাদেশে এসবই হয়।
সারাদেশে গায়েনের অনুসারীর সংখ্যা লাখো। মানিকগঞ্জে খানিকটা বেশিই। এমন মানুষকে যদি ধর্মানুভূতির স্পর্শকাতর বয়ান দিয়ে আটকে ফেলা যায় -তবে ভাইয়ের পক্ষের লোকদের ইলেকশানটা কিঞ্চিত সহজ হয়।
মোদ্দাকথা গায়েনের বিরুদ্ধে লেগেছে ধর্মীয় রাজনীতি। ৫ অগাস্টের পর যারা অলিখিতভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা অধিগ্রহণের ছক কষছেন। শিল্পীর পেছনে রাজনীতির ছুৎমার্গ লেগে গেলে ওই অসুখ দূর করা ভীষণ কঠিন। তার ওপর রাষ্ট্র নিজেই যদি ওই অসুখের প্রো-ভাইরাস হয় সেটি হয় আরো বড় মুসিবতের করুণ কাহন। বাউল নিধনে রাষ্ট্রীয় মদত আজকের নয় কেবল -এটি বহু পুরনো। এখনকার মতোই প্রায় একই অভিযোগে সেক্যুলার দাবিদার লাস্ট রেজিমে বাউলদের কেশ কর্তন এবং শরিয়ত বয়াতি ও রীতা দেওয়ানের গ্রেপ্তার স্মরণ করতে পারি আমরা।
আমাদের এই আখ্যানের প্রোটাগনিস্টের নাম নিজ দায়িত্বে আপনারা মিলায়ে নিন। সমঝদার আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন।🫡
লেখক: সাংবাদিক
২৪ নভেম্বর ২০২৫