Posts

উপন্যাস

নক্ষত্রহীন রাতের মুখোমুখি

November 25, 2025

Md Josam

Original Author মোঃ জসিম

Translated by মোঃ জসিম

27
View

উপন্যাস: নক্ষত্রহীন রাতের মুখোমুখি

রাতটা ছিল অদ্ভুত নীরব। এমন নীরব যে নিজের হৃদস্পন্দনও কানে বাজে। আকাশে একটিও নক্ষত্র নেই, যেন কেউ বিশাল কালো কাপড় দিয়ে পুরো আকাশ ঢেকে দিয়েছে। আরশীনগরের মানুষ এমন রাত এলে দরজা বন্ধ করে, বাতি নিভিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। গ্রামের বয়স্করা বলে—নক্ষত্রহীন রাত মানে পৃথিবীর আরেকটা দরজা খুলে যায়। যে দরজা দিয়ে অন্ধকারের অদৃশ্যরা পৃথিবীতে হাঁটতে বের হয়।

কিন্তু সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি একজন—আরিজ।
ছেলেটা ছোট থেকেই অদ্ভুত, প্রশ্ন করতে ভালোবাসে। অন্ধকার তার কাছে ভয়ের নয়, রহস্যের। উঠোনে দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে, যেটা আজ পুরো শূন্য। তার দাদি বলতেন, “আকাশ যত ফাঁকা, ভয় তত গভীর।” কিন্তু আরিজ এসব কথায় বিশ্বাস করত না। সে শুধু ভাবছিল—নক্ষত্রহীন রাত কি শুধুই অন্ধকার, নাকি সত্যিই এর ভিতরে কিছু লুকিয়ে আছে?

হঠাৎ দূরের বাঁশঝাড় থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল।
টিক… টিক… টিক…
শব্দটা মানুষের হাঁটার মতো নয়, পশুর মতোও নয়—তার মাঝামাঝি। শব্দটা এগিয়ে আসছে, আর বাতাসের ঠান্ডা বাড়ছে। আরিজ দ্বিধা না করে এগিয়ে গেল। বাঁশঝাড়ের নিচে কুয়াশা জমে আছে। কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উঠল একটা কালো ছায়া। কোনো চোখ নেই, মুখ নেই, তবুও মনে হলো সে তাকিয়ে আছে।

আকাশ যেমন নক্ষত্রহীন, তেমন এই ছায়াও নামহীন।

ছায়াটা বলল, “তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছো?”
কণ্ঠটা ভাঙা, গভীর, মানুষের মতো নয়।
আরিজ গলা শুকিয়ে গেলেও বলল, “হ্যাঁ… তুমি কে?”

ছায়াটা বলল, “আলো থাকলে আমরা নেই। আলো নিভে গেলে আমরা জন্মাই। আমরা অন্ধকারের সন্তান। মানুষের ভয়, দুঃখ, রাগ, হতাশা—এসব থেকে আমাদের সৃষ্টি।”

আরিজ স্তব্ধ।

ছায়া বলল, “তুমি জানার সাহস দেখিয়েছো। তাই তুমি আজ সত্য দেখবে।”

মুহূর্তেই চারপাশের অন্ধকার ঘুরে ঘুরে এক অদ্ভুত জগতে রূপ নিল। আরিজ হঠাৎ নিজেকে দেখতে পেল এক অচেনা শহরে—অন্ধকারের শহর। রাস্তায় হাজার ছায়া। কেউ হাঁটছে, কেউ কাঁদছে, কেউ বসে আছে, কেউ ফিসফিস করছে। কিন্তু সবাই মানুষ-আকৃতির ছায়া।

ছায়া বলল, “এরা হলো মানুষের ফেলে দেওয়া অনুভূতি। যাদের স্বপ্ন ভেঙে যায়, সেই স্বপ্নের ছায়া এখানে থাকে। যারা একা কাঁদে, তাদের কান্নার ছায়া এখানে বাসা বাঁধে। মানুষ দুঃখ ভুলে যায়, কিন্তু দুঃখ নিজে কখনো মারা যায় না—ওরা এখানে জমে ওঠে।”

আরিজ দেখল, এক ছোট্ট ছায়া মাটিতে বসে খেলছে। মনে হয় সে কোনো শিশুর পুরোনো ভুলে যাওয়া আনন্দ। আরেক পাশে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা এক ছায়া—মনে হয় কারো চাপা ক্ষোভ। বাতাসে শীতের মতো ঠান্ডা, কিন্তু ভেতরে ভীষণ ভারী।

আরিজ জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তোমরা মানুষের ক্ষতি করো কেন?”
ছায়া বলল, “আমরা ক্ষতি করি না। মানুষ নিজের ভিতরের অন্ধকার যত বাড়ায়, আমরা তত শক্ত হই। তারা আমাদের তৈরি করে, আমরা শুধু বেঁচে থাকি।”

এ কথা বলার পর ছায়া হঠাৎ থেমে গেল।
“তোমাদের গ্রামে আজ যে অন্ধকার নেমেছে, সেটা স্রেফ রাত নয়। মানুষের মনে যত রাগ, হিংসা, ভয় জমেছে, সেই কারণেই আকাশ তার আলো হারিয়েছে।”

আরিজ বলল, “এটা কি বদলানো যায়?”

ছায়া বলল, “হ্যাঁ। যদি মানুষ একটু আলো রাখতে শেখে।
একটু ক্ষমা,
একটু ভালোবাসা,
একটু মানবতা—
এই তিনটি জিনিস অন্ধকারকে দুর্বল করে।”

ছায়ার কণ্ঠ নরম হয়ে এল।

“মানুষ ভাবে পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর। কিন্তু সত্যি কথা হলো—মানুষই পৃথিবীকে আলো দেয়। মানুষ ভালো হলে আমরাও মরে যাই।”

আরিজ গভীরভাবে শোনে।
তার মনে হলো—অন্ধকার আসলে খারাপ নয়। অন্ধকার হলো মানুষের ভুলে যাওয়া সত্যের আয়না।

হঠাৎ সেই পুরো অন্ধকার-শহর আলো হতে শুরু করল। ছায়ারা একে একে মিলিয়ে যাচ্ছে।
ছোট শিশুর ছায়া শেষবারের মতো হাসল।
দুঃখের ছায়া নরম হয়ে মাটিতে মিশে গেল।
রাগের ছায়া পেছন ফিরে অদৃশ্য হলো।

মুহূর্তে সব অন্ধকার মিলিয়ে গেল, আর আরিজ নিজেকে পেল বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায়।

ভোরের আলো উঠছে।
দূরে গ্রামের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে।
আকাশে ফিরেছে প্রথম নক্ষত্র।
একটি ছোট আলোর বিন্দু—কিন্তু সেই বিন্দু যেন পুরো রাতের অন্ধকার ভেঙে দিল।

আরিজ বুঝল—পৃথিবীটা অনেক সুন্দর।
মানুষের হৃদয়ে যদি একটু আলো থাকে, যদি ভালোবাসা থাকে, যদি ক্ষমা থাকে, তাহলে কোনো অন্ধকারই মানুষের উপর রাজত্ব করতে পারে না।

সেদিনের পর আরশীনগরের মানুষ বদলে গেল।
মানুষ একে অন্যের প্রতি একটু বেশি নরম হলো, একটু বেশি সহানুভূতিশীল হলো।
নক্ষত্রহীন রাত আর ফিরল না। কারণ মানুষের মনে আর সেই অন্ধকার ছিল না।

আরিজ সেই রাতটাকে জীবনে ভুলতে পারে না।
সে জানে—যতদিন মানুষ মানুষের জন্য আলো হয়ে থাকবে, ততদিন পৃথিবী কখনো অন্ধকার হবে না।

এবং সেই জন্যই আজও রাতের আকাশে নক্ষত্র জ্বলছে।

Comments

    Please login to post comment. Login