Posts

গল্প

ঘুষের রসিদ

November 27, 2025

Md. Lalon Shaikh

18
View

“ঘুষের রসিদ”

জেলার ছোট্ট  শহর মাধবপুরে নতুন অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন আরিফ হাসান। তিনি সৎ, নীতিবান—কিন্তু অভিজ্ঞতাহীন। তাঁর দপ্তর ছিল ভূমি অফিস, যেখানে দীর্ঘদিন ধরেই ঘুষ ছাড়া এক টুকরো কাগজও নাকি নড়াচড়া করত না।

যেদিন আরিফ দায়িত্ব নিলেন, সেদিনই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহব্বত আলী, স্থানীয় এক গরীব কৃষক। তাঁর সাত কাঠা জমির খতিয়ান হারিয়ে গেছে, আর পুনরায় তোলা প্রয়োজন। কিন্তু দালালরা তাকে বলেছে—“পাঁচ হাজার টাকা দিলেই তিন দিনেই কাজ হয়ে যাবে এবং তার হাতে একটা রসিদ দিয়েছে।”

মহব্বত আলীর কাছে টাকা নেই। তাই তিনি সাহস করে সরাসরি আরিফের কক্ষে ঢুকে পড়লেন।

—“স্যার, আমার কাগজটা যদি একটু তাড়াতাড়ি করে দিতেন.…. আমি গরীব মানুষ, সরকারী ফিস ছাড়া আর কোনো টাকা পয়সা (ঘুষ) দিতে পারব না।”

আরিফ বিস্মিত।


—“ঘুষ? কে বলেছে টাকা পয়সা (ঘুষ) লাগবে? আপনি অফিসের নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করুন, আর বাকি কাজ আমার দায়িত্ব।”

আরিফের সৎ মনোভাব অনেককে বিরক্ত করেছিল, বিশেষ করে সেই অফিসের পুরনো কর্মচারীরা—হাবিব, জালাল আর মকবুল—যারা ঘুষের টাকায়ই রাজকীয়ভাবে জীবনযাপন করত।

মহব্বত আলীর কাগজ প্রসেস হওয়ার একদিন আগে, হঠাৎ ফাইলটা গায়েব হয়ে গেল। পুরো অফিসে তোলপাড়। 

আরিফ বুঝলেন—এটি কোনো অদৃশ্য ভুল নয়, পরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃত নাশকতা (Sabotage)।

তিনি সবাইকে ডাকলেন।
—“ফাইল চুরি হয়েছে। যার দায় প্রমাণ হবে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।”

কেউ কিছু বলল না। সবাই নীরব।

পরদিন সকালে অফিসে অভিযোগ এলো—মহব্বত আলীর খতিয়ান নাকি ভুল তথ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল, ফলে পুনরায় যাচাই লাগবে।

আরিফ সরেজমিন তদন্ত করলেন। মাঠে গিয়ে দেখলেন—তথ্য একদম সঠিক।
অফিসে ফিরে তিনি হাবিবকে ডেকে বললেন—
—“আপনি ইচ্ছে করে ভুল দেখিয়েছেন। কেন?”

হাবিব নরম স্বরে হাসল।
—“স্যার, আপনি নতুন। এই শহরের নিয়ম আলাদা। এখানে কাজ করতে হলে ‘মালিকদের’ খুশি রাখতে হয়। না হলে ফাইল তো গায়েব হবেই।”

আরিফ চোখে চোখ রেখে বললেন—
“এ অফিসে এখন থেকে একটাই নিয়ম—আইন মেনে জনগণের সেবা প্রদান করা।”

হাবিব কিছু বলল না, শুধু পেছন ফিরেই বিড়বিড় করে বলল, “দেখি কয়দিন টিকে থাকেন।”

এক সপ্তাহ পরে আরিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল—তিনি নাকি ভূমি মাপজোকের রিপোর্ট বদলে এক ব্যবসায়ীর উপকার করেছেন। কাগজপত্রে আরিফের সই জাল করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক তদন্ত শুরু করলেন।

এবার আরিফ বুঝলেন—এটা শুধু কয়েকজন কর্মচারীর ব্যাপার নয়, বরং একটি পুরো চক্র তাঁকে বহিষ্কার করতে চায়, যাতে আগের নিয়ম ফিরে আসে।

তিনি হার মানলেন না।


ব্যবসায়ীর দেওয়া ক্যামেরা ফুটেজ, জাল সইয়ের নমুনা, অফিসের ফাইলের টাইম লক—সব মিলিয়ে তিনি শক্তিপোক্ত প্রমাণ জোগাড় করলেন। তদন্তে বেরিয়ে এলো—ঘুষের টাকা ভাগাভাগি করত একটি দল, আর সে দলের মূল নিয়ন্ত্রক ছিল হাবিব।

হাবিব ও তার সহযোগীরা সাময়িক বরখাস্ত হলো। আরিফ টেবিলে ফেলে রাখা সেই পুরনো হারানো ফাইলটি খুঁজে পেলেন—এক কোণে ধুলো জমে থাকা আলমারির ভেতর।

তিনি ডেকে পাঠালেন মহব্বত আলীকে।


—“আপনার কাগজ তৈরি হয়েছে। কোনো খরচ লাগবে না। আপনি শুধু দেশের আইন মেনে চলবেন, নিয়ম মোতাবেক কাজ করবেন—আমি তাতেই খুশি।”

মহব্বত আলীর চোখে পানি এসে গেল।


—“স্যার, আপনার মতো সৎ ও সহসী অফিসার থাকলে দেশের মানুষ দুর্নীতি হতে রক্ষা পাবে, দেশ ও জাতির উন্নতি হবে। ” 

আরিফ মনে মনে ভাবলেন— “দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, টিকে থাকা খুবই কঠিন। কিন্তু কেউ না কেউ তো শুরু করতেই হবে।”

Comments

    Please login to post comment. Login

  • ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহ লান’ত।