ভাঙা স্বপ্নের গল্প
শান্ত গ্রামের নাম ছিল নীলডাঙ্গা। সেখানে থাকত একটি মেয়ে—মায়া। নামের মতোই শান্ত, নরম, আর স্বপ্নে ভরা। ছোটবেলা থেকেই তার একটি মাত্র ইচ্ছা—একদিন সে নিজের হাতে একটা স্কুল গড়ে তুলবে, যেখানে গরিব শিশুরা বিনা পয়সায় পড়তে পারবে।
মায়ার বাবা ছিল কৃষক। সংসারে টানাপোড়েন, তবুও বাবা মেয়ের চোখের স্বপ্ন দেখে বলতেন,
“মায়া, তুই একদিন পারবি।”
কিন্তু জীবন তো সবসময় স্বপ্নের মতো চলে না। মায়া যখন কলেজে উঠল, তখনই বাবার হঠাৎ অসুস্থতা ধরা পড়ে। চিকিৎসা, ওষুধ, ভ্যানভাড়া—সব মিলিয়ে বাড়ির অবস্থা আরও খারাপ হয়। মায়া পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাইলেও টাকার অভাবে তাকে থেমে যেতে হয়।
তবুও মায়া হাল ছাড়েনি। রাতে অন্যের বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করত, দিনে বাচ্চাদের পড়াত। স্বপ্নটাকে নিজের ভেতর আগুনের মতো জ্বালিয়ে রাখত।
একদিন গ্রামে আসে শহরের এক সমাজকর্মী—নাম আরিয়ান। সে গরিব শিশুদের নিয়ে কাজ করে। মায়ার পড়ানো দেখে সে অবাক হয়। মেয়েটার চোখে সে দৃঢ়তা খুঁজে পান, যা সব মেয়ের চোখে থাকে না।
আরিয়ান জিজ্ঞেস করল,
“তুমি যদি সুযোগ পাও, কি করতে চাইবে?”
মায়া মুচকি হেসে বলল,
“একটা স্কুল। খুব ছোট হলেও হবে।”
আরিয়ান কথা হারিয়ে ফেলে। এত বড় স্বপ্ন, এত ছোট্ট মেয়ের!
সময়ের সাথে দু’জনের ভাব বাড়ে। তবে ভালোবাসার মতো কোনো সম্পর্ক নয়—এটা ছিল সম্মানের, স্বপ্ন-বোঝার সম্পর্ক।
একদিন রাতে মায়া জানতে পারে, তার বাবা আর বাঁচবেন না। শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার আগে বাবা বলেছিলেন,
“মায়া, তোর স্কুলটা… করে যাইস।”
বাবার কথা মায়ার বুক ভেঙে দেয়। কিন্তু ঠিক সেই ভাঙা জায়গা থেকেই নতুন শক্তি বের হয়।
এদিকে আরিয়ান শহরে ফিরে গিয়ে তার সংগঠনের মাধ্যমে নীলডাঙ্গায় একটি ছোট গ্রাম শিক্ষা প্রকল্প চালু করার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হলে নিজে চাকরির টাকা থেকে জমাতে থাকে।
তিন মাস পর সে আবার গ্রামে আসে।
মায়াকে পাশে ডেকে বলল,
“এবার শুরু করি? ছোট একটা স্কুল?”
মায়ার চোখ ভিজে ওঠে।
“স্বপ্ন তো ভাঙার জন্য আসে না… নতুন করে গড়ার জন্যই আসে।”
গ্রামের খালি চালাঘরটিকে পরিষ্কার করে মায়া আর আরিয়ান শুরু করল “স্বপ্নতারা স্কুল।”
প্রথম দিন মাত্র পাঁচজন বাচ্চা এল। দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশজন। মাস শেষে পঞ্চাশ। মায়ার জীবন বদলে গেল।
কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়।
স্কুল চালু হওয়ার পর অনেকেই মায়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু সে না বলে দেয়। তার মনে একটাই ভয়—কোথাও গিয়ে যেন স্কুল থেমে না যায়। নিজের স্বপ্ন ভেঙে যেতে দিতে চায় না।
কিন্তু আরিয়ান?
সে কখনো কিছু বলেনি। সে শুধু দূর থেকে মায়ার স্বপ্নকে পাহারা দিত।
একদিন সন্ধ্যায় মায়া স্কুলের বাঁশের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ আরিয়ান এসে বলল,
“একটা কথা বলব?”
মায়া তাকাল।
“স্কুলটা শুধু তোমার নয়, আমারও। চাইলে আমরা দু’জন মিলে এটাকে আজীবন চালাতে পারি।”
মায়া বুঝল—এই মানুষটা তার স্বপ্নকে ভাঙা নয়, পূরণ করতে চায়।
মায়া নিচু গলায় বলল,
“স্বপ্ন যখন দু’জনের হয়… তখন আর ভাঙে না।”
বহু বছর পর নীলডাঙ্গার সেই ছোট চালাঘর বড় হয়ে হয় তিন তলা স্কুল ভবন।
সামনে বড় সাইনবোর্ড—
“ভাঙা স্বপ্নের গল্প—স্বপ্নতারা স্কুল।”
আর নিচে লেখা:
“এখানেই একসময় স্বপ্ন ভেঙেছিল। এখন এখানেই সেগুলো পূরণ হয়।”