‘’রহস্যময় রাতের মালগাড়ি''
রাজশাহী রেলস্টেশনের পুরোনো নামফলকের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আরিফ—একজন সাধারণ টিকিট পরীক্ষক।
চাকরি তার খুব বড় কিছু নয়, তবে তার বাবা ছিলেন রেলওয়ের কর্মী; সেই সূত্রে আরিফের রেলে এক ধরনের টান আছে।
রেলকে সে শুধু চাকরি নয়—একটা দায়িত্ব মনে করে।
কিন্তু বছর কয়েক ধরে রেলের অবস্থা দেখে সে কষ্টে ভেঙে পড়ে।
টিকিট বিক্রির অবৈধ ব্যবসা, টেন্ডারে ঘুষ, ভাঙ্গা বগি সারানোর নামে টাকা গায়েব, মালবাহী রেলের লাইন “ভাড়া” দিয়ে রাতের অন্ধকারে অবৈধ পণ্য পরিবহন—সবই তার চোখে পড়ছে প্রতিদিন।
১. রহস্যময় রাতের মালগাড়ি
একদিন গভীর রাতে ডিউটি করতে গিয়ে আরিফ দেখল—একটি মালগাড়ি তালিকায় নেই, তবু প্ল্যাটফর্ম ছাড়া পাচ্ছে।
অফিসার রশিদ সাহেব, যিনি সবসময়ই একটু “বড়” ভাব নিয়ে চলেন, তাকে দেখে বললেন—
—“উটকি পাটকি বেশি দেখিস না। যা, রেজিস্টার আপডেট করে দে।”
আরিফ বুঝল ব্যাপারটা ঠিক নয়।
লোডিং করা মালামালও সন্দেহজনক—গুদামে ঢোকানো হয়নি, আর কাগজপত্রেও মিল নেই।
২. অদৃশ্য চক্র
পরদিন এক প্রবীণ শ্রমিক মুছলিম উদ্দিন আরিফকে চুপিসারে বললেন—
—“বাবা, রশিদ সাহেব আর বাইরের কিছু ব্যবসায়ী মিলে রেলের লাইন রাতের বেলা ভাড়া দেয়। যেদিন মালামাল নামে, সেদিন লোকে বলে ‘শেষ বগির কান্না’—
কারণ এই বগিই বহন করে অবৈধ পণ্য।” আরিফ শুনে স্তব্ধ।
কোথাও অভিযোগ করার কথা ভাবল, কিন্তু জানে—চক্রটা বড়, প্রমাণ ছাড়া কিছু হবে না।
৩. সাহসের শুরু
কদিন পর আবার সেই রাতের মালগাড়ি এল।
এইবার আরিফ দূর থেকে লুকিয়ে ভিডিও করল। ট্রেনের বগিতে ঢোকানো হচ্ছে অবৈধ কয়লা,
এক বগি থেকে অন্য বগিতে বোঝাই করা হচ্ছে চোরাই ওয়ারহাউসের মালামাল।
সে নাম ও সময় লিখে রাখল।
কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে গর্জে উঠল রশিদ সাহেব—
—“কী করছিস?”
চোখেমুখে ভয়, কিন্তু আরিফ দূর থেকে বলল—
—“জনস্বার্থে প্রমাণ রাখছি।”
৪. ঝড়ের আঘাত
পরদিনই আরিফের বদলির আদেশ এলো—দূর এক স্টেশনে, অজ পাড়ায়।
সবার চোখে বোঝা গেল—এটা শাস্তি।
কিন্তু আরিফ ভাঙল না।
বদলির কপি, ভিডিও, সময়সূচি, কাগজ—সব একত্র করে সরাসরি জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিল।
এবার তদন্ত শুরু হলো চুপিসারে।
৫. পর্দা ফাঁস
এক রাতে হঠাৎ রেল নিরাপত্তা বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেট দল নিয়ে স্টেশনে রেইড হলো।
সেই একই মালগাড়ি ঠিক তখনই লাইন ছাড়ার প্রস্তুতিতে।
রশিদ সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল।
অবৈধ মালামালসহ ট্রেন আটকে গেল।
ব্যবসায়ী, দালালসহ কয়েকজন ধরা পড়ল।
আরিফকে ডাকা হলো—
—“তোমার তথ্যেই আমরা আজ হাতেনাতে ধরতে পারলাম।”
৬. রেলের নতুন সকাল
কয়েক মাসের মধ্যে স্টেশনে বড় পরিবর্তন এল।
লাইন ভাড়া দেওয়া বন্ধ, গুদামের হিসাব স্বচ্ছ, বগি মেরামতে খরচ ঠিকমতো দেখানো শুরু হলো।
স্টেশনমাস্টারও বদলালেন, নতুন নীতিমালা এল।
আরিফ উপলব্ধি করল—
রেল শুধু লোহার চাকা নয়, এটা মানুষের ভরসা।
আর ভরসা টিকিয়ে রাখতে একজন সাহসী মানুষেরও প্রয়োজন হয়।
শেষ কথাঃ
দুর্নীতি যখন রেলের বগিতে চুপচাপ ঢুকে পড়ে, তখন রেল তার গতিও হারায়।
কিন্তু যতক্ষণ একজন আরিফ আছে— ততক্ষণ “শেষ বগির কান্না” একদিন থেমে যায়।