আসল হিরো
গ্রামের নাম শান্তিনগর। নাম শান্তিনগর হলেও শান্তি সেখানে খুব কমই ছিল। ঝড়, বন্যা আর নদীর ভাঙনে মানুষ প্রায়ই ভয় আর কষ্টের মধ্যেই দিন কাটাতো। সেই গ্রামের শেষ মাথায় একটি কাঁচা ঘর। সেখানে থাকে রাহাত—চেহারায় লাজুক, কথায় কম, কাজ করে চুপচাপ। লোকজন তাকে প্রায়ই হাসাহাসি করে বলত,
“ও কি পারবে? ওর কাছে কি আশা করবে?”
সবাই ভাবে রাহাত দুর্বল। কিন্তু কেউ জানে না—তার মনটা পাহাড়ের মতো শক্ত।
রাহাতের মা নেই। বাবা অনেক আগেই অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। ছোটবেলা থেকেই সে নিজে নিজে বড় হয়েছে। অন্যেরা যখন খেলাধুলা করত, রাহাত তখন নদীর ধারে বসে বাচ্চাদের সাঁতার শেখাতো, কারো বাইসাইকেল ঠিক করে দিত, কারো ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে নতুন সুতো লাগিয়ে দিত। যে কাজই করুক—তা করত নিঃশব্দে। কখনো নামে প্রচার চাইত না।
এক সন্ধ্যায়…
আকাশ কালো হতে শুরু করল। বাতাস এমন জোরে বইতে লাগল যে গাছের ডালগুলো ভেঙে পড়ছিল। বজ্রপাতের শব্দে মানুষ ঘরে ঢুকে পড়ল। সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ নদীর দিক থেকে চিৎকার—
“বাঁচাও! কেউ বাঁচাও!”
গ্রাম অন্ধকারে ডুবে গেল। সবাই ছুটে গেল পুরনো সেতুর দিকে। দেখা গেল, নদীর মাঝখানে একটি ছোট নৌকা উল্টে গেছে। নৌকার ভিতরে ছিল একজন মহিলা—রোশনি আর তার তিন বছরের ছেলে আদনান। নৌকা ঘুরে পানির ঘূর্ণিতে আটকে পড়েছে। তীব্র স্রোতে একদম কাছে যেতেই লোকজন ভয় পাচ্ছে। সবাই দাঁড়িয়ে শুধু দেখতে লাগল। কারো মুখে কথা নেই, শুধু আতঙ্ক।
রাহাত তখন ঘরে বসে একটি ভাঙা টর্চ ঠিক করছিল। চিৎকার শুনে টর্চ হাতে দৌড়ে গেল সেতুর দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখল সবাই শুধু তাকিয়ে আছে। কেউ পানিতে নামছে না।
একজন বলল, “ও ভাই, আজ নামলে জীবনটাই শেষ।”
আরেকজন বলল, “স্রোত খুব বেশি। কেউ কিছু করতে পারবে না।”
রাহাত এক সেকেন্ডও দেরি করল না। সে জুতো খুলে নদীর কিনারায় দাঁড়াল। লোকেরা চিৎকার করে উঠল,
“না নামিস! তুই পারবি না!”
কিন্তু রাহাতের চোখে তখন শুধু রোশনি আর ছোট্ট আদনানের মুখ।
ঝাঁপ…
রাহাত নদীতে লাফ দিল। সাথে সাথে স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। পানি ঘোলা, চোখ জ্বালা করছে, কিছু দেখা যাচ্ছে না। সাঁতার কাটতে কাটতে সে হাত বাড়িয়ে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ তার হাত মহিলার শাড়ির ছেঁড়া অংশ ছুঁয়ে গেল। রাহাত জোরে ধরে ফেলল।
রোশনি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বাচ্চাটাকে বাঁচান! ও ডুবে যাবে!”
রাহাত এক হাত দিয়ে মহিলাকে, আরেক হাত দিয়ে বাচ্চাকে ধরে টেনে উপরে তুলতে লাগল। স্রোত তাকে ধাক্কা দিচ্ছিল, ঘূর্ণি তার পা টেনে নিচ্ছিল। একবার মনে হল—এবার আর উঠতে পারবে না।
কিন্তু সে নিজের মনে বলল,
“হিরো হওয়া শক্তির ব্যাপার না… এটা ইচ্ছার ব্যাপার।”
শেষ পর্যন্ত…
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর রাহাত সেতুর নিচের একটি ভাঙা দাঁড় ধরতে পারল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে সবাই মিলে তাদের ওপরে উঠাল। রাহাত শ্বাস নিতে পারছিল না, পুরো দম ফুরিয়ে গিয়েছিল। গ্রামবাসী দৌড়ে এসে গরম পানি দিল, কম্বল দিল। রোশনি শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
সে বলল,
“আজ আপনি না থাকলে আমরা বাঁচতাম না!”
গ্রামবাসীরা হতবাক। তারা জীবনে কোনোদিন রাহাতকে গুরুত্ব দেয়নি। আজ সেই ছেলেটিই দুইটি প্রাণ বাঁচিয়ে দেখিয়ে দিল—হিরো কাকে বলে।
পরদিন সকাল…
সূর্য উঠতেই সবাই রাহাতের বাড়িতে গেল। যারা আগে তাকে নিয়ে হাসত তারা গিয়ে বলল—
“রাহাত, আমরা ভুল করেছি। তুমি আমাদের গর্ব।”
গ্রামের মোড়ল মাইক নিয়ে ঘোষণা দিল,
“আজ থেকে রাহাত শান্তিনগরের হিরো। বিপদে-আপদে সে-ই আমাদের ভরসা।”
রাহাত মাথা নিচু করে শান্তভাবে বলল,
“আমি হিরো নই। আমি শুধু আমার দায়িত্ব করেছি। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোই বড় কাজ।”
তারপর…
সেদিন থেকে গ্রামের যে কোনো সমস্যা—আগুন লাগা, কারো হারিয়ে যাওয়া, কারো ঝগড়া—সব জায়গায় সবার আগে পৌঁছে যায় রাহাত। মানুষ তাকে ভালোবাসতে শুরু করল। শিশুরা তাকে দেখে হাত নাড়ে, বলে—
“হিরো ভাই এসেছে!”
রাহাতের কাজ একটাই—মানুষকে সাহায্য করা। নিজের নাম কখনো সামনে আনে না, কখনো গর্ব করে না। সে জানে—হিরো হওয়া মানে লোক দেখানো নয়…
হিরো হওয়া মানে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
গ্রাম আজও বলে—
“আমাদের শান্তিনগরে একজন সত্যিকারের হিরো আছে… তার নাম রাহাত।”
— শেষ —