[প্রচলিত অর্থে এটি একটি ফরমায়েশী রচনা। গল্পই। তবে গল্পে যে শৈলী আমার আসার কথা, তা আসেনি। কারণ এটা একটা ‘রূপরেখা’ বা সিনপসিস ছিল। ২০০২ সালে কোনো এক সময় নৃবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী, হয়তো তখন সাবেক তিনি, বা সিনিয়র ক্লাসে, ছায়াছবির জন্য একটা গল্প চাইলেন। ছায়াছবি বলতে টিভির জন্যও হতে পারে। অত স্পষ্ট মনে নেই। আমি একটা রূপরেখা/সিনপসিস দিতে চাইলাম। প্রথম কারণ আমি চিত্রনাট্য লিখতে জানি না। দ্বিতীয় কারণ কাজটা না হলে বেগার-খাটা মনে হবে। কাজটা হয়নি কখনো। অন্যান্য জিনিস খুঁজতে গিয়ে ২০২০তে ফাইলটা চোখে পড়ে। তারপর আবার ভুলে গেছিলাম। আজকেও অন্য একটা জিনিস খুঁজতে গিয়ে এটা পাই। - মাচৌ/০৪ জুন ২০২৪]
১১ই সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে আত্মঘাতী বিমান হামলার খবর আচমকা টেলিভিশনে প্রচারিত হ’ল। সারা ঢাকা শহরের মানুষ উৎকণ্ঠা, ভয় আর বিস্ময় নিয়ে এই খবর দেখছে আর আলোচনা করছে। এরই মধ্যে ধানমণ্ডির একটা বাড়ি, আর বাড়িতে থাকা লোকজন চরম আতঙ্ক নিয়ে, অস্থিরভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগাযোগের চেষ্টা করছে–টেলিফোনে, অনলাইনে। এই বাড়ির বড় ছেলে সাগর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি করত একটা মিডিয়া ফার্মে আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে। ওর অফিস ছিল টুইন টাওয়ারে।
বাসায় বড় চাচা এবং চাচি এসেছেন। টিভিতে সিএনএন ঘটনাস্থল দেখাচ্ছে, আর উদ্ধারকর্মী, আর সাংবাদিক দেখাচ্ছে। আশপাশের মানুষজনের ভয়ার্ত সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। আর দেখাচ্ছে মার্কিন প্রশাসনের মানুষজন আর বুশকে। মা আর টেলিভিশনের সামনে বসতে চাইছেন না। কাঁদতে কাঁদতে অন্য ঘরে গেছেন, চাচি সেখানে। টিভির সামনে থাকেন বাবা, চাচা, সাগরের ছোটভাই সোহাগ–সকলেই স্তম্ভিত। তারমধ্যেই কখনো বাবা কখনো সোহাগ টেলিফোনে কল লাগানোর চেষ্টা করেন। কম্পিউটারে অনলাইনে বসেছে পাশের ঘরে সুমি–সাগরের পিঠাপিঠি বড় বোন। একবার সুমির ঘরে, একবার আম্মার ঘরে, একবার ড্রইংরুমে টেলিভিশনের সামনে আসা যাওয়া করছে কিশোর, সাগরের বন্ধু। এখন সুমির আরও নিকট বন্ধু।
এই বাড়ির লোকজনের মধ্যে সোহাগই প্রথম জানতে পারে হামলার ঘটনা। সোহাগ চাকরি করত একটা ওষুধ কোম্পনির মার্কেটিং বিভাগে। সাগর ওকে মার্কিনে নিয়ে যাবার পাকা বন্দোবস্ত করবার পর ও চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল। একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির কাগজপত্র চালাচালি চলছিল। টোফেল ইত্যাদি দিয়ে আগামী এপ্রিলের মধ্যে চলে যাবার কথা ছিল। আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখার ইচ্ছাটা ওর জন্য উপরি। বাড়ির লোকজন আমেরিকা যেতে পারলেই খুশি। পড়ালেখা না হলে ওখানে কাজবাজ করে থেকে যাবে আমেরিকায়। সকালে বাইরে গিয়ে লোকজনের হৈ চৈ-এ সোহাগ ঘটনা জানে। যখন পুরোটা জানল দিশেহারা হয়ে সুমির অফিসে ফোন করে। সুমি একটা আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার পার্সোনেল-এ বড় চাকরি করে। সোহাগের ফোন পাবার আগেই কিশোর ফোন করেছে ওকে। তখনই কিশোরের সঙ্গে ঠিক করেছে বাসায় একসঙ্গে ফিরবে। কিশোরের অফিস থেকে বেরিয়ে সুমির অফিসে যায়, সোহাগ বাসায় নিজের ঘরে অস্থিরভাবে অপেক্ষা করে যখন, দরজায় ঘণ্টা বাজে। কিশোরকে নিয়ে সুমি বাসায় আসে। পরপর বাসায় সবাই ফেরাতে মা কিছু অবাক হয়। ঠিক হয় টেলিভিশন চালাবে ওরা, কিশোর গিয়ে ওদের বাবা-মাকে জানাবে, টেলিভিশনের সামনে আনবে। টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা অবস্থায় সকলেই জানতে পারেন।
ক্রমে এটা স্পষ্ট হয় যে, সাগর মারা গেছে, আর হয়ত লাশ ওর পাওয়া যাবে না। সাগর মার্কিনে যাবার পর থেকেই সুমিকে নিয়ে যেতে চায়, সুমি চায়নি। কিশোরকেও পড়ালেখা করতে যাবার ব্যবস্থা খুঁজবার প্রস্তাব দিয়েছে সাগর। কিশোরও চায়নি। সুমি আর কিশোরকে সাগর ‘অফ ট্র্যাক’ মনে করেছে। কিন্তু সাগরের এও মনে হয়, সুমি আগে এতটা এরকম ছিল না। দুটো ঘটনার মধ্যে সুমি এরকম হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে শেষের দিকে ওর একটা প্রেমজ সম্পর্ক। সাগর ভাবত ওরা বিয়ে করবে, যদিও সুমি বিয়ে নিয়ে তেমন ভাবেনি। কীভাবে যেন সম্পর্কটা দাঁড়ায় না। সুমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে এইসব ঘন সম্পর্ক নিয়ে। আর দ্বিতীয়টা হ’ল: কিশোরের সঙ্গে সুমির পরিচয়। সাগরই কিশোরকে বাসায় নিয়ে আসে। সাগর যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিতর্কের তুখোড় বক্তা বলে পরিচয় ছিল। তখনই খণ্ডকালীন সাংবাদিক, সাংবাদিকতার ছাত্র কিশোরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সাগরের এই ভাবনা ছিল সুমির সঙ্গে কিশোরের বন্ধুত্ব হবে। সুমি তখনই চাকরি করে। সাগর ভাবতো সুমি দেয়াল তুলে দিয়েছে নিজের জীবনে কাউকে অনুপ্রবেশ করতে, বিশেষ করে পরিবারের লোকদের। যদিও সুমি ভারী মিশুক। কিন্তু কিশোর আর সুমি যত বন্ধু হয়েছে তত সাগর বিরক্ত হয়েছে। ও নিজেও বুঝতো না কেন এরকম হচ্ছে। মাঝে মাঝে ওর নিজেকে সংকীর্ণও মনে হ’ত। কিন্তু কিশোর কিংবা সুমি এত শান্ত যে সাগরের প্রতিক্রিয়ায় কখনো বিচলিত হয়নি। এভাবেই ওদের পরিবারের একজন বন্ধু হয়ে পড়ে কিশোর। কিন্তু সাগরের বাবা-মা এবং সোহাগ সবসময়ে বিচলিত ছিল। সাগর যখন মার্কিনে যায় তখন ওর বাবা-মা সুমিকে পাঠাতে পারত, এক আধবার সে কথা তুলেছেও। কিন্তু সুমি উৎসাহ দেখায়নি। কিশোরের রেজাল্ট ছিল ভাল। সাগর কিশোরকেও যেতে বলেছে। কিশোর কখনোই যেতে চায়নি। সাগর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওরা দুজনই বাস্তবতাবিবর্জিত আর মার্কিনবিদ্বেষী।
সাগরের মৃত্যু যত নিশ্চিত হয়ে উঠল ততই এই পরিবারে শোকের বদলে উৎকণ্ঠা, বেদনার জায়গায় অনিশ্চয়তা দেখা দিতে থাকল–কী হবে! সাগরের বউয়েরই বা কী হবে। সাগর এক প্রবাসী বাঙালী পরিবারের মেয়ে বিয়ে করেছিল, আর ওর থাকা আরও পাকাপোক্ত করেছে। ওদের বাচ্চা দু’বছর বয়েস। সাগরের পরিবারের এই অনুভূতি জগতের সবচেয়ে বড় সাক্ষী হতে থাকল কিশোর। এতদিনের বন্ধুর এরকম মৃত্যুতে, নানান ভিন্নতা সত্ত্বেও, কিশোরের মন ভারী করে দিয়েছে। কিন্তু তার থেকে বড় ব্যাপার হয়ে গেল অন্য একটি বিষয়।
হামলার পর সাগরের বাবা অন্য অনেকের মত সম্ভাব্য হামলাকারীদের গালমন্দ করছিলেন, তারা যে গণতন্ত্রের শত্রু সেটা জোর দিয়ে বলছিলেন। কিশোর সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। কিশোরের স্বভাবই এমন, এই ভাবনা তার লুকোতে পারার কথা নয়। সে যখন মার্কিনের নীতি নিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করেছে, এক সন্ধ্যায়, বাসার সকলের সামনেই সাগরের বাবা ইঙ্গিত করলেন এই হামলাতে কিশোর খুশি হয়েছে। এতদিনের বিচলিত সম্পর্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপান্তরিত হয়। এভাবে একটা বহির্জাগতিক হামলা একটা পরিবারের সম্পর্কের মধ্যে, আবেগ-অনুভূতির মধ্যে, মূল্যবোধের মধ্যে এসে পড়ে। কিশোর খুবই কষ্ট পায়, বিযুক্ত বোধ করে। কিশোরের মার্কিন বিরোধী অবস্থান আর প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বিরোধী অবস্থান সমরূপ পায় সাগরের পরিবারের কাছে। পরিবারের লোকজন অন্যান্য কিছুর পাশাপাশি সুমি এবং কিশোরের কল্প-সম্পর্ককে ইঙ্গিত করে। সুমির সাময়িক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিশোরের বিযুক্তিবোধকে গাঢ় করে।
এই অনুভূতি বাড়বার অনেক কারণ তৈরি হয়েছে। কিশোর ছোট শহরে বড় হয়েছে। ঢাকার সঙ্গে তার সম্পর্ক পেশাগত। তার অন্য বন্ধু খুব অল্প, সকলেই সাহিত্য পাড়ার। তারা মার্কিনের বিরোধী হোক বা না হোক, ইসলামপন্থী অবস্থানের বিরাট সমালোচক। তাদের মধ্যে গত দুবছর একজন বন্ধু শায়লাকেই কিশোর সবচেয়ে বেশি বোঝে, শায়লাও কিশোরকে। সে আর্কিটেক্ট আবার কবি। সাহিত্যপাড়ায় আসতো, কমিয়ে দিয়েছিল পুরুষ বন্ধুদের আলাপ-আচরণের কারণে, আবার কিশোরের সঙ্গে বন্ধুত্বের পর অল্প-বিস্তর আসে। কিশোরও খুব অনিয়মিত। কিশোর লক্ষ্য করেছে এখানকার মানুষজনের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই শত্রু, কিন্তু হালকা চালে। আর ইসলাম আরও বড় শত্রু। কিশোরের এই পর্যবেক্ষণ ওর বন্ধুদের কাছে ঠাট্টার বিষয়। উপরন্তু তারা শায়লাকে নারীবাদী খোঁচা দিয়ে আর কিশোরকে তালিবান খোঁচা দিয়ে ওদের কোণঠাসা করবার চেষ্টা করেছে। অফিসে এর থেকেও নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া দেখেছে কিশোর।
এমনিতেই কিশোর এই নাগরিক জীবন, এর হালচাল আর আলাপ-জগত নিয়ে ক্লান্ত বোধ করত, অর্থ খুঁজে পেত না। এ নিয়ে তার শায়লার সঙ্গে সুমির সঙ্গে কথা হ’ত। শায়লা সুমির তেমন পরিচয় কখনো হয়ে ওঠেনি, হয়নি তেমন কারণ নেই। শায়লা প্রথম সুমিদের বাসায় যায় এই ঘটনার পর কিশোরের সাথে।
সাগরের বাসায় ধাক্কা খাওয়ায় কিশোর আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই প্রথম ওর স্পষ্ট মনে হয় ঢাকাতে ওর মন বসছে না। কোথায় যাবে এবং কেন, সেটা ও জানে না। কিন্তু এই নগর ওর মার্কিনের এক কলোনি মনে হতে থাকে। ওর কানে বাজে সহকর্মী, বন্ধু আর চাচার কথাগুলো–সাগরের মুখ ওর মনে পড়ে। ছোট্ট ঘরের মধ্যকার জমিয়ে রাখা নগর-জীবনের সেতুবন্ধ উপাদানগুলোকে পোকার মত মনে হয় ওর। এই কলোনি থেকে পালাতে ইচ্ছে করে ওর। অফিসে একটা পদত্যাগ পত্র লেখে ও। ভাববার চেষ্টা করে সুমির প্রতি কোন অভিমান জন্মেছে কিনা। কিশোর বুঝতে পারে, সাগরের মৃত্যু সুমিকে কর্তব্য থেকে টলিয়ে দিয়েছে। নইলে বাবাকে প্রতিরোধ করতে জানে সুমি। পরদিন ঢাকা থেকে চলে যাবে বলে সুমিকে চিঠি লিখতে বসে।
সুমির যখন মনে হয়, কিশোর কষ্টে আছে তখন ওর অফিসের তাড়া। অফিস থেকে বেরিয়ে ও কিশোরের খোঁজে বেরোয়। সাহিত্যপাড়ার আড্ডায় গিয়ে শায়লার দেখা মেলে। বন্ধুরা চোখে চোখে তামাশার ইঙ্গিত দেয়–সুমি আর শায়লা। শায়লা লক্ষ্য করে, পাত্তা দেয় না। ও জানায় কিশোরের অপেক্ষাতেই আছে। ক’দিন খুব ঠাণ্ডা মেরে আছে কিশোর–পরশুর পর আর দেখা নেই। আজ না এলে ভাবছে কিশোরের বাসায় খোঁজ নেবে। সুমি জানতে চায় এখন যাবে কিনা। শায়লা রাজি হয়। দুজনে রিকশায় যেতে যেতে আলাপ করে কেমন লাগছে ওদের–এই উত্তাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে, এই শীতল ঢাকার নগরে। বাসায় পৌঁছে জমির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। কিশোরদের বিল্ডিং-এ দারোয়ান। মুখে একগাল হাসি আর দুশ্চিন্তা। জানায় যে, সকালে একটা ব্যাগ নিয়ে চলে গেছে। সুমি আর শায়লাকে বিষন্ন দেখায়। জমির ভাই কিশোরের বাসায় বসতে বলে, চা আনাবে। শায়লা জানায় কিশোরের বাসার চাবি সাথে নেই। সুমির কাছে ছিল, তাই দিয়ে ঘরে ঢোকে ওরা।
ঘরের ভেতরে টেবিলে দুটি খাম রাখা। সুমিকে আর শায়লাকে। শায়লাকে লিখেছে ‘সাহিত্য পাড়ায় তোমার ভাল লাগার কথা না, আমার আশঙ্কা একসময়ে তোমার লিখতেও ভাল লাগবে না হয়তো। কিন্তু এই মুহূর্তে হয়তো নির্বান্ধব হয়ে পড়ার একটা কারণ আমি হয়ে গেলাম। কখনো ইচ্ছে করলে আবার ঢাকায় আসবো। ভাল থেকো।’ সুমির চিঠি দীর্ঘ। অনেক কথা লেখা তাতে–যুদ্ধ, সাম্রাজ্য, পরিবার, অনুভূতি, সম্পর্ক, বিযুক্তি আর শায়লা। শায়লার হঠাৎ মনে পড়ে কিশোরের হাসান চাচার কথা। নেত্রকোনায় থাকেন, গ্রামে, একা, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সুমি জিজ্ঞেস করে সুমি সেখানে গেলে শায়লা যাবে কিনা। ঠিক হয় দুজনেই একত্রে যাবে, সামনের শুক্রবার। অনেকদিন ট্রেনে চড়া হয় না। শুক্রবার দুজনেই ট্রেনে উঠে বসে।
(২০০২?)
262
View