মাস তিনেক পরে একদিন গুরুচরণ ম্লান মুখে নবীন রায়ের ঘরে ঢুকিয়া ফরাসের উপর বসিবার উপক্রম করিতেই, তিনি চিৎকার করিয়া নিষেধ করিলেন, না না না, এখানে নয় ওই চৌকির উপর বস গিয়ে। আমি অসময়ে আবার স্নান করতে পারব না বলি জাত দিয়েছে নাকি হে?
গুরুচরণ দূরে একটা চৌকির উপর বসিয়া পড়িয়া মাথা হেট করিয়া রহিল।
দিন চারেক পূর্বে সে যথারীতি দীক্ষা গ্রহণ করিয়া ব্রাহ্ম হইয়াছিল। আজ সেই সংবাদটা নানা বর্ণে বিচিত্র হইয়া গোঁড়া হিন্দু নবিনের শ্রুতিগচর হইয়াছে।
নবীনের চোখ দিয়া অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে লাগিল কিন্তু গুরুচরণ তেমনি মৌন নতমুখে বসিয়া রহিল সে কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া কাজটা করিয়া অব্দি বাড়িতে কান্নাকাটি এবং অশান্তির পরিসীমা ছিল না।
নবীন পুনরায় তর্জন করিয়া উঠিলেন বলো না হে, সত্যি কিনা?
গুরু চরণ জল-ভারাক্রান্ত দুই চক্ষু তুলিয়া বলিল আগে সত্যি। কেন এমন কাজ করলে? তোমার মাইনে তো মোটে ষাটটি টাকা তুমি - ক্রোধে নবীন রায়ের মুখ দিয়ে কথা বাহির হইল না।
গুরু চরণ চোখিয়া রুদ্ধ কন্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিল , জ্ঞান ছিল না দাদা।
দুঃখের জ্বালায় গলাতেই দড়ি দিব কি ব্রাহ্ম জ্ঞানী হব কিছুই ঠাওড়াতে পাচ্ছিলুম না শেষে ভাবলুম আত্মঘাতী না হয়ে ব্রহ্ম জ্ঞানী হই, তাই ব্রহ্ম জ্ঞানীই হয়ে গেলুম।
গুরু চরণ চোখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া গেল।
নবীন চিৎকার করিয়া বলিলেন বেশ করেছ নিজের গলায় দড়ি না দিতে পেরে জাতির গলায় দড়ি টাঙিয়ে দিয়েছো ,- আচ্ছা যাও আর আমাদের সামনে কালা মুখ বার করো না ,এখন যারা সব মন্ত্রী হয়েছেন তাদের সঙ্গেই থাকোগে মেয়েদের হাড়ি মুচির ঘরে দাও গে যাও ,বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়া তিনি মুখ ফিরাইয়া বসিলেন।
নবীন রাগে অভিমানে কি যে করিবেন প্রথমটা কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না। গুরু চরণ হাতের ভিতর হইতে সম্পূর্ণ বাহির হইয়া গিয়াছে, আর শীঘ্রই মুঠোর মধ্যে আসিবে এ সম্ভাবনাও নাই তাই নিষ্ফল আক্রোশে ছটফট করিয়া আপাতত জব্দ করিবার আর কোন ফন্দি খুঁজিয়া না পাইয়া সেই দিনেই মিস্ত্রী ডাকিয়া ছাদের যাতায়াতের পথটা বন্ধ করিয়া একটা মস্ত প্রাচীর তুলিয়া দিলেন।
এ সংবাদ বহুদূর প্রবাসে বসিয়া ভুবেনেশ্বরী শেখরের মুখে শুনিয়া কাদিয়ে ফেলিলেন শেখর এ মতিবুদ্দি কে দিলে তাকে?
মতিবুদ্ধি কে দিয়েছিল শেখর তাহা নিশ্চয়ই অনুমান করিয়াছিল, সে উল্লেখ না করিয়া বলিল, কিন্তু মা দুদিন পরে তোমারই তো তাকে এক ঘরে করে রাখতে এতগুলি মেয়ের বিয়ে তিনি কি করে দিতেন, আমি তো ভেবে পাইনে।
ভুবনেশ্বরী ঘাড় নারিয়া বলিলেন, কিছুই আটকে থাকে না শেখর, আর সেজন্য আগে থেকে জাত দিতে হলে অনেকেই দিতে হয়, ভগবান যাদের সংসারে পাঠিয়েছেন তিনি তাদের ভার নিতেন।
শেখর চুপ করিয়া রহিল ।
ভুবেনেশ্বরি চোখ মুছিয়া বলিলেন আমার ললিতা মেয়েটা কে যদি সঙ্গে আনতুম তাহলে যা হয় একটা উপায় আমাকেই করে দিতে হতো, আমি তো জানিনে গুরুচরণ এই সব মতলব করেই পাঠিয়ে দিলেনা ,আমি মনে করেছিলুম বুঝি সত্যিই তার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে।
শেখর মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া, একটুখানি লজ্জিত ভাবে বলিল, বেশ তো মা এখন বাড়ি গিয়ে তাই করো না কেন , সে তো আর ব্রাহ্ম হয়নি তার মামাই হয়েছে আর তিনিও কিছু তার যথার্থ আপনার কেউ নন , ললিতার কেউ নেই বলেই তার ঘরে মানুষ হচ্ছে।
ভুবেনশ্বরী ভাবিয়া বলিলেন তা বটে কিন্তু কর্তা এক রকমের মানুষ ,তিনি কিছুতেই রাজি হবেন না, হয়তো তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে দিবেন না।
শেখরের নিজের মনেও এই আশঙ্কা যথেষ্ট ছিল, সে আর কিছু না বলি আর চলিয়া গেল।
ইহার পরে আর এক মিনিটেও তাহার বিদেশে থাকিতে ইচ্ছা রহিল না। দু-তিন দিন চিন্তিত অপ্রসন্ন মুখে এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে বেড়াইয়া একদিন সন্ধ্যার সময় আসিয়া বলিল আর ভালো লাগছে না মা চলো বাড়ি যাই!
ভুবেনেশ্বরী তৎক্ষণাৎস সম্মত হইয়া বলিলেন, তাই চল শেখর আমারও কিছু ভালো লাগচে না।
বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া মাতা পুত্র উভয়েই দেখিলেন ছাদের সেই যাতায়াতের পথটা বন্ধ করিয়া প্রাচীর উঠিয়াছে। গুরু চরণের সহিত আর কোন সম্পর্ক রাখা , এমনকি মুখের আলাপ রাখাও যে কর্তার অভিপ্রেত নয় তাহা কাহাকেও না জিজ্ঞাসা কোরিয়াই উভয়েই বুঝিলেন।
রাত্রে শেখরের আহারের সময় মা উপস্থিত ছিলেন দু- একটা কথার পরে বলিলেন , ওদের গিরিন বাবুর সঙ্গে ললিতার বিয়ে দেবার কথাবার্তা হচ্ছে আমি তা আগেই বুঝেছিলাম।
শেখর মুখ না তুলিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, কে বললে?
ওর মামি দুপুরবেলা কর্তা ঘুমালে আমি নিজেই গিয়ে দেখা করে এসেচি। সেই বোধি কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেললে। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া তিনি নিজের চোখ দুটি আঁচলে মুছিয়ে ফেলিয়া বলিলেন , কপাল শেখর ,কপাল ।এই কপালের লেখা কেউ খন্ডাতে পারে না -কার আর দোষ দেই বল! যাই হোক গিরিন ছেলেটি ভালো, তার কষ্ট হবে না -বলিয়া চুপ করিলেন।
প্রত্যুত্তরে শেখর কোন কথাই বলিলো না মুখ নিচু করিয়া খাবারগুলো হাত দিয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিল খানিক পরে মা উঠিয়া গেলে সেও উঠিয়া হাতমুখ ধুইয়া বিছানায় শুইয়া পরিল।
পরদিন সন্ধ্যার পর একটুখানি ঘুরিয়ে আসিবার জন্য সে পথে বাহির হইয়াছিল। তখন গুরু চরণের বাহিরের ঘরে প্রাত্যহিক চা-পানের সভা বসিয়া ছিল এবং যথেষ্ট উৎসাহের শহীদ হাসি এবং কথাবার্তা চলিতেছিল । তথাকার কোলাহল শেখরের কানে যাইবা মাত্র সে একবার স্থির হইয়া কি ভাবিয়া লইল তারপর ধীরে ধীরে বাড়ি ঢুকিয়া সেই শব্দ অনুসরণ করিয়া গুরু চরণের বাহিরের ঘরে আসিয়া দাঁড়াইলো এবং সকলের ঐ মুখের ভাব পরিবর্তিত হইয়া গেল।
শেখর ফিরিয়া আসিয়া ছিল এর সংবাদ ললিতা ছাড়া আর কেহ জানিতো না।
আজ গিরীন্দ্র এবং আরো একজন ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন তিনি বিস্মিত মুখে শেখরের প্রতি চাহিয়া রহিলেন এবং গিরিন মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া দেওয়ালের দিকে তাকাইয়া রহিল।
সর্বাপেক্ষা অধিক চেচাইতে ছিলেন গুরুচরণ নিজে তাহার মুখ একেবারে পান্ডুর হইয়া গেল তাহার হাতের কাছে বসিয়া ললিতা তখনও চা তৈরি করিতেছিল, একবার মুখ তুলিয়া চাহিয়া মাথা হেট করিল।
শেখর সরিয়ে আসিয়া তক্তপোষের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল এবং একধারে বসিয়া পরিয়া হাসিয়া বলিল, একি, একেবারে সমস্ত নিবে গেল যে!
গুরুচরণ মৃদু কন্ঠে বোধ করি আশীর্বাদ করিলেন কিন্তু কি বলিলেন বোঝা গেল না,
তাহার মনের ভাব শেখর বুঝিল তাই সময় দিবার জন্য নিজেই কথা পাড়িল।কাল সকালের গাড়িতে ফিরিয়ে আসিবার কথা জননীর রোগ উপশম হইবার কথা ,পশ্চিমের কথা আরো কত কি সংবাদ অনর্গল বকিয়া শেষে সেই অপরিচিত যুবকটির মুখের দিকে চাহিল।
গুরুচরণ এতক্ষণে নিজেকে কতটা সামলাইয়া লইয়াছিলেন ছেলেটির পরিচয় দিয়া বলিলেন , ইনি আমাদের গিরিনের বন্ধু।
এক জায়গায় বাড়ি ,একত্রে লেখাপড়া শেখা ,অতি সৎ ছেলে শ্যামবাজারে থাকেন ,তবু আমার সঙ্গে আলাপ হওয়া পর্যন্ত প্রায়ই এসে দেখা-সাক্ষাৎ করে যান।
শেখর ঘাড় নারীয়া মনে মনে বলিলো হা খুব ভালো ছেলে। কতক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল ,কাকা আর সব খবর ভালো তো?
গুরু চরণ জবাব দিলেন না মাথা হেট করিয়া রহিলেন ।
শেখর উঠিবার উপক্রম করিতেই হঠাৎ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলিয়া উঠিলেন মাঝে মাঝে এসো বাবা ,একেবারে যেন ত্যাগ করো না, এসব কথা শুনেচ তো?
শুনেছি বৈ কি !বলিয়া শেখর অন্দরের দিকে চলিয়া গেল।
তারপরেই ভিতরে গৃহিনীর কান্নার শব্দ উঠিল ,বাহিরে বসিয়া গুরু চরণ হেট মুখে গোচার খুট দিয়া নিজের চোখের জল মুছিতে লাগিলেন এবং গিরিন অপরাধীর মতো মুখ করিয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল ললিতা পূর্বে উঠিয়া গিয়াছিল।
কিছুক্ষণ পরে শেখর রান্নাঘর হইতে বাহির হইয়া বারান্দা পার হইয়া উঠানে নামিতে গিয়া দেখিল, অন্ধকার কপাটের আড়ালে ললিতা দাঁড়াইয়া আছে। সে ভুমিষ্ট হইয়া প্রণাম করিল এবং দাঁড়াইয়া উঠিয়া বুকের একান্ত সন্নিকটে সরিয়ে আসিয়া মুখ তুলিয়া মুহূর্তকাল নিঃশব্দে কি যেন আশা করিয়া রহিল , তারপর পিছাইয়া গিয়া চুপিচুপি বলিল আমার চিঠির জবাব দিলে না কেন?
কৈ আমি তো চিঠি পায়নি কি লিখেছিলে?
ললিতা বলিল, অনেক কথা সে যাক সব শুনেছো তো এখন তোমার কি হুকুম তাই বল।
শেখর বিস্ময়েরসরে কহিল আমার হুকুম! আমার হুকুমে কি হবে?
ললিতা শংকিত হইয়া , মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল কেন?
তা বৈ কি ললিতা ,আমি কার উপর হুকুম দেব?
আমার ওপর , আর কার ওপর দিতে পারো?
তোমার ওপরেই বা দিব কেন? আর দিলেই বা তুমি শুনবে কেন? শেখরের কণ্ঠস্বর গম্ভীর ইষৎ করুন।
এবার ললিতা মনে মনে অত্যন্ত ভয় পাইয়া আর একবার কাছে সরিয়া আসিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলিল যাও, এখনো আমার তামাশা ভালো লাগছে না, পায়ে পরি কি হবে বলো, ভয়ে রাত্তিরে আমার ঘুম হয় না।
ভয় কিসের?
বেশ যাহোক ভয় হবে না, তুমি কাছে নেই, মা কাছে নেই মাঝে থেকে মাম কি সব কাণ্ড করে বসলেন - এখন মা যদি আমাকে ঘরে নিতে না চান?
শেখর কোনকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল সে সত্যি মা নিতে চাইবেন না , তোমার মামা অপরের কাছে অনেক টাকা নিয়েচেন সে কথা তিনি শুনেছেন তাছাড়া এখন তোমরা ব্রাহ্ম, আমরা হিন্দু।
আন্নাকালী এ সময়ে রান্নাঘর হইতে ডাক দিল সেজদি , মা ডাকছেন।
ললিতা চেতাইয়া বলিল যাচ্ছি, তারপর গলা খাটো করিয়া বলিল, মামা যাই হোন তুমি যা, আমিও তাই মা তোমাকে যদি ফেলতে না পারেন আমাকেও ফেলবেন না । আর গিরিন বাবুর কাছে টাকা নেবার কথা বলছ? তা সে আমি ফিরিয়ে দেব, আর ঋনের টাকা দুদিন আগেই হোক পেছনেই হোক দিতেই তো হবে।
শেখর প্রশ্ন করিল, অত টাকা পাবে কোথায়?
ললিতা শেখরের মুখের পানে একটিবার চোখ তুলিয়া মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া বলিল জানো না মেয়ে মানুষের কোথায় টাকা পায়? আমিও সেইখানে পাবো।
এতক্ষণ শেখর সংযত হইয়া কথা কহিতে থাকিলেও ভিতরে পুড়িতেছিল এবার বিদ্রুপ করিয়া বলিল কিন্তু তোমার মামা তোমাকে বিক্রি করে ফেলেছেন যে?
ললিতা অন্ধকারে শেখরের মুখের ভাব দেখিতে পাইল না ।কিন্তু কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন টের পাইল। সে দৃঢ় স্বরে জবাব দিল ও সব মিছে কথা । আমার মামার মত মানুষ সংসারে নেই তাকে তুমি ঠাট্টা করোনা।
তার দুঃখ কষ্ট তুমি না জানতে পারো কিন্তু পৃথিবী শুদ্ধ লোক জানে বলি একবার ঢোক নিয়ে গিলিয়াএকবার ইতস্তত করিয়া শেষে বলিল, তাছাড়া তিনি টাকা নিয়েছেন আমার বিয়ে হবার পরে, সুতরাং আমাকে বিক্রি করবার অধিকার তার নেই বিক্রিও করেননি ,এ অধিকার আছে শুধু তোমারই ,তুমি ইচ্ছে করলে টাকা দেবার ভয়ে আমাকে বিক্রি করে ফেলতে পারো বটে !বলিয়া উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই দ্রুত পদে চলিয়া গেল।