Posts

চিন্তা

খালেদা জিয়া পুড়েছেন, কিন্তু নিভেননি- রাষ্ট্রের কল্যাণে তাঁর বেঁচে থাকা আজও অপরিহার্য

December 2, 2025

ওসমান এহতেসাম

32
View

লেখক : ওসমান এহতেসাম 
আমার জন্ম ২০০১ সালে। ইতিহাসের বই তখনো আমার হাতে আসেনি, কিন্তু রাষ্ট্রের বড় নাটক আমি টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি। আমার বড় হওয়ার এই পৃথিবীতে তিনি ছিলেন একটাই পরিচয়ে-‘বেগম খালেদা জিয়া’। রাজনীতির শীতল মর্যাদাসম্পন্ন মঞ্চে তিনি শুধু একজন নেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন পথ তৈরি করা মানুষ। ক্ষমতার চূড়ায় থেকেও যার চোখ ছিল সাধারণ মানুষের স্বপ্নে, শোষিতের কান্নায়, পরাজিতের প্রতিরোধে।

তাঁর জীবনটাকে এখন মনে হয়- এ যেন একটি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা মশাল। তীব্র বাতাস, দুঃসহ অন্ধকার, অত্যাচারী ঝড়- সব কিছুই তাকে নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিয়তির পরিহাস—সত্যিকারের আগুন জ্বলে ওঠে সহায়তা বা আলোতে নয়, প্রতিবাদে। তিনি সেই আগুন। যিনি নানা ষড়যন্ত্রে পুড়েছেন, কিন্তু নিভেনি।


সেই দিন: যখন ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি কেঁদেছিল

২০০৮ সালের পর। সেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সড়ক-২ নম্বর বাড়িটি—যেন রাষ্ট্রীয় স্মৃতিস্তম্ভ। এই বাড়ির দেয়ালে শুধু হাসি-খুশির স্মৃতি ছিল না, ছিল যুদ্ধোত্তর একটা পরিবারের সংগ্রাম। সে দিন টেলিভিশনে আমি দেখেছিলাম—ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়া এক নারীকে নয়, রাষ্ট্রকে দেখা গেছে এক নারীকে ভয় পেতে।

এ কথা কেন বলছি? কারণ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেই বাড়িটি ঘিরে শুরু হয় আইনি লড়াই। সরকারি দাবি ছিল এটি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। আমি তখন ছোট, কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় সেই দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে, একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, একজন মা, তাঁর সারা জীবনের স্মৃতিবিজড়িত ঘর থেকে বের হয়ে আসছেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোয় তাঁর চোখে কি একফোঁটা জল ঝলসে উঠেছিল? নাকি তা ছিল আমারই চোখের জল? সেই দিন তিনি একা কাঁদছিলেন না, সমস্ত বাংলাদেশ সেদিন তাঁর সঙ্গে কেঁদেছিল।

প্রশ্ন করো নিজের মনে, এই নেত্রী যদি তৎকালীন সরকারের সঙ্গে আপোষ করতেন? যদি মাথা নত করতেন? যদি ভাঙা দেশের ওপর ভাঙা সমঝোতার সাইন দিতেন? তাহলে সেই বাড়িটি কি আজও তাঁরই থাকত না? অবশ্যই থাকতো। তখন তিনি রাষ্ট্রপতি থাকার মতো সম্মান নিয়ে হাঁটার সুযোগ পেতেন। তাঁর সন্তানদের নির্বাসনে যেতে হতো না।

কিন্তু একজন সত্যিকারের নেত্রী বলেই তিনি নিজের বাড়ি ও আদরের দুই সন্তানদের রক্ষা করতে দেশকে ত্যাগ করলেন না। তিনি বেছে নিলেন মানুষের জন্য পতন, দেশের জন্য নিঃসঙ্গতা, গণতন্ত্রের জন্য সিঁড়ি বেয়ে নামা কারাগারের পথ। সেই দিনই প্রথম আমি বুঝলাম, উঠে দাঁড়ানো সহজ, দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে কঠিন।

কোকো ভাইয়ার কথা: একটি মায়ের চিরস্থায়ী বেদনা
২৪ জানুয়ারি ২০১৫। ইতিহাসে কিছু দিনকে রাষ্ট্রীয় শোকের দিন বলা হয়। আমি ওই দিন দেখেছিলাম এক দেশ নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া আর এক মায়ের তীব্রতম বেদনা। আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবর এলো। দেশ তখন রাজনীতির বিষাক্ত সময়। শোকও তখন রাজনৈতিক হয়। কিন্তু একজন মায়ের শোক কখনো রাজনৈতিক হয় না। সেটি হয় এমন এক তীব্র আর্তনাদ, যা শোনার জন্য কোনো মাইকের দরকার হয় না। এ দেশের রাজনীতি তাঁকে তাঁর সন্তানদের কাছে থাকতে দেয়নি। থাকতেও দেয়নি, রাখতে দেয়নি।

একজন মা যখন নিজের সন্তানের লাশের খবর টেলিভিশনে জানতে পারে, তখন রাষ্ট্রের ইতিহাস তাকে সম্মান দেয় না, শুধু চাবুক মারার মতো চিহ্ন রেখে যায়। এটি ছিল আমার প্রথমবারের মতো একটি রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি এত কাছ থেকে দেখা। এটি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ক্ষমতার চেয়ে বড় হয়েও কিছু থাকে – একটি মায়ের হৃদয়। তিনি যদি স্বার্থপর হতেন, শুধু নিজের সন্তান ও পরিবারের মঙ্গল চাইতেন, তাহলে হয়তো আজ আরাফাত ভাইয়া বেঁচে থাকতেন, হয়তো তিনি দেশের বাইরে না থেকেও নিরাপদে থাকতে পারতেন।

কারাগারের পথ: একজন নেত্রীকে বন্দি করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁর বিশ্বাসকে নয়
২০১৮। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে আমি দেখেছিলাম এক দৃশ্য, যা একজন লেখকের কলম দিয়ে আঁকা সম্ভব নয়। সোশ্যাল মিডিয়া, নিউজ চ্যানেল – সবখানে সেই ইমেজ: সাদা শাড়ি পরিহিত, মুখে মাস্ক, কিন্তু চোখে সেই অপরাজেয় দৃঢ়তা। মানুষ তাঁকে জেলে নিয়ে গেল। কিন্তু তারা নিয়ে যেতে পারেনি তাঁর দৃঢ়তা, তাঁর ইতিহাস, তাঁর প্রতিরোধ।

একজন নেত্রী, যিনি তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁকে কারাগারে যেতে দেখছি। কেন? কারণ তিনি তাঁর নীতির সঙ্গে আপোষ করতে রাজি হননি।

আমাদের মনে রাখা উচিত, কারাগার যদি কোনো মানুষকে ছোট করতে পারত, তাহলে ম্যান্ডেলা, সু চি, ফিদেল, কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপ্লবীরা পৃথিবীর সবচেয়ে অখ্যাত মানুষ হতো। কিন্তু কারাগার ক্ষমতাবানদের পরীক্ষার চুল্লি। খালেদা জিয়া সেই পরীক্ষা পেরিয়ে গেছেন আগুনে গড়া ইস্পাত হয়ে।

তাঁর আপোষহীনতার রাজনৈতিক মূল্য
আপনি ভাবতে পারেন, তিনি কেন এত কষ্ট সহ্য করলেন? হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সাহেবের মতো তিনি কেন রাজকীয় জীবনযাপন করলেন না? উত্তরটি আমার মনে হয় খুব সহজ: ১৮ কোটি মানুষ।

কেউ কেউ বলে, তিনি আপোষ না করে ভুল করেছেন। সত্যিই কি ভুল? তাহলে কি গণতন্ত্র শুধু ক্ষমতাধারীদের খেলার মাঠ? তাহলে কি বিরোধী দলের প্রয়োজন নেই? ক্ষমতাবানদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?

তিনি না থাকলে, ভোটের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠত? বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ নিয়ে কেউ বলত? সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে কেউ কথা বলত?

একটি সত্য রাজনৈতিক কাঠামোতে, বিরোধী দল সরকারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ভুল করলে, তার সামনে দাঁড়ানো কেউ থাকে না, রাষ্ট্র তখন স্বৈরতান্ত্রিক টানেলে ঢুকে পড়ে। খালেদা জিয়া সেই দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এই দাঁড়ানো ছিল দেশের জন্য।

অন্যদিকে, খালেদা জিয়া যদি সরকারের সঙ্গে আপোষ করে নেতৃত্ব ছেড়ে দিতেন, তাহলে তিনি হয়তো আজও ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে থাকতেন, তাঁর ছেলে দেশে থাকতেন, তাঁর জেলে যেতে হতো না। তিনি হয়তো রাষ্ট্রপতির মর্যাদাও পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ তিনি জানতেন, তিনি যদি আপোষ করেন, বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী, সংগঠিত বিরোধী দলের অভাব হবে।

তাঁর নিজের দলের ব্যর্থতা :
তিনি বিএনপি গড়েছিলেন ইট দিয়ে ইট জুড়ে, রক্ত-মাংস দিয়ে, নেতৃত্ব দিয়ে। কিন্তু তাঁর দল তাঁর মতো নেত্রী তৈরি করতে পারেনি। তাঁর চোখের আগুন, তাঁর সিদ্ধান্ত, তাঁর সাহস- এগুলো তারা শুধু দেখেছে, শেখেনি। দলটি তাঁর কাঁধে ওঠে পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু সেই পর্বতের শিকড় তৈরি হয়নি।

আমার প্রজন্মের চোখে একজন খালেদা জিয়া।

আমি তাঁকে কখনও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখিনি। আমি তাঁকে দেখেছি একজন সংগ্রামী নারী, একজন শোকাহত মা, একজন কারাবন্দী নেত্রী এবং একজন আপোষহীন লড়াকু ব্যক্তিত্ব হিসেবে। আমার প্রজন্মের অনেকের কাছেই তিনি একটি প্রতীক - যিনি শিখিয়েছেন, নীতি ও স্বার্থের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব হয়, তখন নীতির পথেই হাঁটতে হয়, ব্যক্তিগত মূল্য যাই হোক না কেন।

তাঁর জীবন আমাদের জন্য একটি জীবন্ত পাঠ - যে সত্য ও ন্যায়ের পথ কখনও সহজ না, কিন্তু সেটিই একমাত্র পথ যা চিরস্থায়ী মর্যাদার দিকে নিয়ে যায়।

তিনি হয়তো আজ শারীরিকভাবে অসুস্থ, রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু আমার এবং আমার প্রজন্মের লক্ষ-কোটি তরুণের হৃদয়ে, তিনি চিরজীবী একজন 'বেগম খালেদা জিয়া' - যে নারী শিখিয়েছেন, কীভাবে নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হয়। শিখিয়েছেন, ক্ষমতা ফুরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বিশ্বাসের মৃত্যু নেই। বেগম খালেদা জিয়া পুড়েছেন, কিন্তু নিভেননি।

আজ এই আপোষহীন নেত্রী ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তারদের মতে, তাঁর লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিসসহ একাধিক জটিল রোগ রয়েছে, শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এবং নিয়মিত চিকিৎসার প্রয়োজন। দেশের কোটি মানুষ আজ তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছেন। কারণ তিনি শুধু একজন নেতা নন, তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক জীবন্ত প্রতীক, যার সংগ্রাম, দৃঢ়তা ও নৈতিক সাহস প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দেয়।

আল্লাহর নিকট অগণিত দোয়া এই নেত্রীর জন্য; যেন তিনি আবার সুস্থ হয়ে দেশের জনগণের মধ্যে ফিরে আসেন এবং সেই অম্লান শক্তিকে প্রতিফলিত করতে পারেন। আমিন।

লেখক : ওসমান এহতেসাম 

গণমাধ্যম কর্মী ও কলাম লেখক

Comments

    Please login to post comment. Login