গল্পের নাম: আগুনে লেখা দোয়া
সামিউল ছিল গ্রামের সবচেয়ে নীরব শিশু। শান্ত, ভদ্র—কিন্তু কথা বলতে পারত না। সবাই ভাবত, যে শিশু কথা বলে না, সে নাকি অদ্ভুত, অমঙ্গল। তাই তাকে কেউ ভালোবাসত না, আদর করত না। মাঠের খেলায় তাকে ডাকা হতো না, মসজিদের আঙিনায় তাকে ঠেলে সরিয়ে রাখা হতো।
শিশুটি শুধু তাকিয়ে থাকত—নিঃশব্দ, কষ্ট পাওয়া চোখে।
একদিন সকালে এক দল বয়স্ক লোক তাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“এই বোবা ছেলেটা আবার এখানে কেন?”
অকারণে চড় থাপ্পড়, ধাক্কাধাক্কি—সব সামিউলের নীরব জীবনের নিয়ম হয়ে গেল।
এমনকি তার নিজের মা–ও তাকে দূরে রাখতে শুরু করল।
“চুপচাপ ছেলেটা ঘরে থাকলে অপয়া লাগে”—এমন কথা ঘুরত চারদিকে।
সময়ের সাথে ঘৃণার আগুন বাড়তে থাকল।
কিন্তু সামিউল কখনো কারো বিরুদ্ধে রাগ দেখায়নি।
তার হৃদয় ছিল সমুদ্রের মতো শান্ত, আঘাতে আঘাতে ভাঙা, কিন্তু ক্রোধহীন।
একদিন বিকেলে গ্রামের কিছু ছেলে তাকে টেনে নিয়ে গেল পুকুরপাড়ে।
তারা বলল,
“বোকার রাজা! পানি ছুঁলেই কি কথা বলতে শিখবি?”
এবং তাকে ঠেলে ফেলে দিল কাদামাটির পানি ভরা ধারে।
ভেজা কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে সামিউল আকাশের দিকে তাকাল।
সেদিন প্রথমবার সে মনে মনে আর্তনাদ করল।
কথা বলতে পারে না—কিন্তু তার দোয়া আকাশে উঠে গেল নিঃশব্দ আগুন হয়ে।
রাতে সে চাঁদের আলোয় হাত তুলে আল্লাহর কাছে বলল—
“হে আল্লাহ, আমার উপর যারা অত্যাচার করে, যাদের হৃদয় অন্ধ হয়ে গেছে—তাদের তুমি দেখিয়ে দাও সত্য কী।
তাদের তুমি করুণা না দিলে তারা আরও অন্ধ হবে…
আর যারা নির্দোষকে কষ্ট দেয়, তাদের তুমি আগুনের তাপে সত্যের মুখোমুখি করো।”
এ দোয়া ছিল আগুনে লেখা—কঠিন, গভীর, আর্তনাদময়।
পরদিন ভোরে গ্রামে অদ্ভুত ঘটনা শুরু হল।
যে লোক সামিউলকে অকারণে মেরেছিল, সে ঘুম থেকে উঠে দেখল তার কণ্ঠ সম্পূর্ণ বন্ধ।
যে ছেলেরা তাকে পানিতে ফেলেছিল, তারা সেই রাতে দুঃস্বপ্নে ডুবে যায়—ঠিক সেই পরিস্থিতিতে, যেখানে তারা নিজে অসহায় আর একাকী।
গোটা গ্রাম আতঙ্কে ভরে উঠল।
মসজিদের ইমাম বললেন,
“অত্যাচারীর ওপর আল্লাহর বিচার আসে নীরবে, কিন্তু শক্তভাবে।
যাকে তোমরা ঘৃণা করলে, সে তোমাদের চেয়ে বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিল।”
মানুষের হৃদয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে লাগল।
তারা সামিউলের কাছে এসে ক্ষমা চাইতে লাগল।
ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমরা ভুল করেছি।”
কিন্তু সামিউল তখনো নীরব।
তার নীরবতাই ছিল আগুনের মতো—যা মানুষকে পুড়িয়ে আবার শুদ্ধ করে ফেলল।
শেষে গোটা গ্রাম বুঝল,
যার দোয়া গ্রহণ হয়, সে কখনো দুর্বল নয়।
নিঃশব্দ শিশুর দোয়াও পাহাড় উল্টে দিতে পারে, যদি তা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আগুন হয়ে ওঠে।