সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি কার ফেস আগে দেখেন? আপনার পার্টনারের, নাকি আপনার প্রিয় ভ্লগারের? রাতে ঘুমানোর আগে কার কথা শোনেন? পরিবারের, নাকি কোনো পডকাস্ট হোস্টের?

আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলো গড়ে উঠেছে এমন মানুষের সাথে যারা জানেও না যে আমরা পৃথিবীতে এক্সিস্ট করি। এটার একটা গালভরা নাম হইতেছে Parasocial Relationship। সোজা বাংলায় যদি বলি তাইলে এটা হইলো একতরফা ভালোবাসা। যেখানে আপনি ইনভেস্ট করছেন আপনার সময়, ইমোশন এবং লয়্যালটি। আর উল্টো পাশে যারা আছে তারা ইনভেস্ট করতেছে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, সুন্দর এডিটিং এবং স্ক্রিপ্ট।
কিন্তু কেন আমরা জেনেশুনে এই ইলিউশনে পড়ি? এবং এর পেছনের Multi-Billion Dollar Business Model টা আসলে কী? আসেন হালকা একটু ভিতরে গিয়ে আলাপ দেই।
আমাদের মস্তিষ্ক হাজার বছরের ইভোলিউশনে তৈরি। আদিম যুগ থেকে এখনও পর্যন্ত যখন কেউ আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে আই কন্টাক্ট করে পজেটিভলি হাসে কিংবা কথা বলে, তাইলে আমাদের ব্রেইন সিগন্যাল দেয় লোকটা সেফ, কিংবা ফ্রেন্ডলি। মজার ব্যপার হইতেছে এটা যেকোনো ক্ষেত্রে, মানে ভার্চুয়ালি হইলেও। আমাদের ব্রেইন সাধারণত বাস্তব মানুষ এবং স্ক্রিনের মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে না।
যখন কোনো কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ক্যামেরার লেন্সে তাকিয়ে একটা রিলেটেবল কন্টেন্টএর মাধ্যমে আলাপ দেয়া স্টার্ট করে আপনার সাবকনশাস মাইন্ড সাথে সাথে অক্সিটোসিন মানে বন্ডিং হরমোন রিলিজ করে। ঠিক ওই মুহুর্ত থেকে আপনি তখন আর একজন সাধারণ ভিউয়ার না, আপনি ইমোশনালি তার জন্যে আপনার বন্ডিং হরমোন রিলিজ করে ফ্রেন্ড হয়ে গেছেন। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এইটারে বলে সিমুলেটেড ইন্টিমেসি, পুরো পর্ন ইন্ডাস্ট্রি এই ফান্ডামেন্টালের উপর দাড়ায়ে আছে। এবং এইটারে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাগ বলা যাইতে পারে।
ধরেন আমার সাথে আপনি একমত হইলেন না এই পর্যন্ত পড়ার পরেও। ভাবছেন এটা শুধু টিনেজার কিংবা আরেক্টু কমবুদ্ধিওয়ালা মানুষদের সমস্যা।
এইক্ষেত্রে কিন্তু ডাটা অন্য কথা বলতেছে। আমেরিকান বিজনেস ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি Morning Consult এর রিপোর্ট অনুযায়ী, Gen Z এবং Millennials দের ৫০% কোনো সেলিব্রিটির চেয়ে তাদের প্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারের রেকমেন্ডেশন বেশি বিশ্বাস করে। শুধু ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রি এখন $২১ বিলিয়ন ডলারের (২০২৪ এস্টিমেট)।
কেন?
কারণ ট্রেডিশনাল অ্যাড আপনাকে পণ্য দেখায়, আর ইনফ্লুয়েন্সাররা আপনাকে লাইফস্টাইল দেখায়। হার্ভার্ডের স্টাডি বলছে, ৩৬% মানুষ এখন সিরিয়াস লোনলিনেসএ ভুগতেছে। আমরা যত একা হচ্ছি, ডিজিটাল বন্ধুদের ওপর আমাদের নির্ভরতা তত বাড়ছে।
আসল আলাপ হইতেছে প্যারাসোশ্যাল রিলেশনশিপ মার্কেটারদের জন্য সোনার খনি। কারণ এইখানে ফ্রেন্ডশিপ ইকুইটিকে ক্যাশ ইন করা হয়। মেকানিজমটা খুব সিম্পল: যেমন ধরেন কোন ভ্লগার প্রথমে দেখাবে তারা আপনার মতোই সাধারণ (ভ্লগে অগোছালো ঘর, মেকআপ ছাড়া ফেস)। তারপর তারা নিজেদের দুর্বলতা শেয়ার করবে আজ খুব ডিপ্রেশনে আছি, হাবি যাবি ইত্যাদি ইত্যাদি মানে যেসব কথাবার্তা বললে আপনি নিজের সাথে রিলেট করা স্টার্ট করবেন। এতে আপনার ট্রাস্ট লেভেল ১০০% এ পৌঁছাবে।সবশেষে আসবে সেলস পিচ। আমি ডিপ্রেশনে এই চা-টা খাই, তোমরাও ট্রাই করতে পারো। কিংবা এই লুঙ্গি পরলে আমার ঘুম ভালো হয়।
খেয়াল করে দেখবেন, আপনি তখন আর চা কিনছেন না। আপনি কিনছেন সেই কমিউনিটির অংশ হওয়ার অনুভূতি।
আপনি কিনছেন Belongingness। ২০০ টাকার কফি বা ২০০০ টাকার হুডি তখন আর খরচ মনে হয় না, মনে হয় এরা এ তো আমার ভাই বন্ধু, বন্ধুর বিজনেসে সাপোর্ট দেওয়াই যায়। পুরো জিনিসটা যারা কোর্স সেল করে কিংবা মোটিভেশনাল মেন্টরদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, ফর্মুলা সেম। একে বলা হয় The Lonely Economy আপনার একাকীত্বই এখানে কারেন্সি।
কিন্তু ঝামেলাটা কোথায়? কাউকে আইডল মানা বা মেন্টর হিসেবে ফলো করা খারাপ কিছু না। সমস্যা শুরু হয় যখন এই ভার্চুয়াল সম্পর্ক আপনার রিয়েল লাইফ রিপ্লেস করে ফেলে। আপনি যখন কমেন্ট সেকশনে ঝগড়া করেন আপনার প্রিয় মেন্টর, ইনফ্লুইয়েন্সারের হয়ে। যখন তাদের সমালোচনা শুনলে আপনার ব্যক্তিগতভাবে গায়ে লাগে। যখন নিজের বাজেট ফেল করে তাদের লাক্সারি লাইফস্টাইল কপি করতে যান।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যা দেখি, তা রিয়েলিটি নয়, এইগুলো হইলো কিউরেটেড রিয়েলিটি। মানে আপনার বেডশীটটা সবসময় কিন্তু টানটান থাকে না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে যদি এই ছবিটা যায় তাহলে সেটা টানটান ফিটফাট করে সমান করে এরপর ছবিটা তুলা হয়। এইটাই কিউরেটেড রিয়েলিটি।
তাইলে কি আমরা সবাইকে আনফলো করবো ইনফ্লুয়েন্সারদের? অবশ্যই না কন্টেন্ট কনজিউম করবো, শিখব, ইন্সপায়ার্ড হবো কিন্তু Aware থাকবো একইসাথে। বুঝুতে হবে কখন আপনাকে ভ্যালু দেওয়া হচ্ছে, আর কখন আপনার ইমোশন হারভেস্ট করা হইতেছে। ইন্টারনেটে যেকোন কানেকশনই ট্রানসেকশনাল এইটা মাথায় রাখলেই চলবে।