আমাদের ব্রেইন খুবই চালাক। সে সব সময় তার কগনিটিভ ক্যালোরি বাঁচিয়ে চলতে চায়। এটি খুবই সাধারণ সার্ভাইভাল মেকানিজম। তাই মস্তিষ্কের কাজই হলো শক্তি বা ‘কগনিটিভ ক্যালোরি’ বাঁচানো। সামনে যা কিছু অপ্রয়োজনীয় বা বিরক্তিকর মনে হয়, মস্তিষ্ক তা এড়িয়ে চলে।
ঠিক এই জন্যেই ব্র্যান্ড কিংবা বিজনেসগুলি ক্লায়েন্ট/কাস্টমারদের মনোযোগের মধ্যে ঢোকার জন্য সবসময় স্টোরি বানানোর চেষ্টা করে প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিস বেচার চেষ্টা করে। কারণ আমাদের ব্রেইন যখন কোনো স্টোরির সামনে পড়ে যায় তখন বাধ্য হয় এটার সাথে এনগেজ করতে, মনোযোগ দিতে।
এখন পৃথিবীতে বিশাল সংখ্যক প্রোডাক্ট, সার্ভিস কিংবা পার্সোনাল ব্র্যান্ড আছে। পার্সোনাল ব্র্যান্ডের জন্যেও স্টোরিটেলিং ইক্যুয়ালি গুরুত্বপূর্ণ। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অন্য ধরনের ব্র্যান্ডের থেকেও বেশি সাহায্য করে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ডিজিটাল স্পেকট্রামে একটা বিশাল সংখ্যক পার্সোনাল ব্র্যান্ড রয়েছে কিংবা তাদের স্টোরি বলার জন্যে যথেষ্ট অ্যাসেট থাকার পরেও প্রপার গাইডলাইন, সুযোগ কিংবা সদিচ্ছার অভাবে এরা ব্র্যান্ড হতে পারছে না কিংবা ব্যাপক স্ট্রাগল করছে। এই মার্কেটটা একদম ক্লোজ টু ভয়েড কিংবা আনটাচড বলা যায়। এর পেছনে রিজনেবল কারণও রয়েছে। সে প্রসঙ্গে একদমই যাচ্ছি না।
এরা সবাই পটেনশিয়াল পলিটিক্যাল ব্যক্তি এবং দল।
বাংলাদেশের মতো একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর বর্তমান প্রেক্ষাপটে পলিটিক্যাল লোকেরা যদি ব্র্যান্ড বিল্ডিং নিয়ে চিন্তা করতে চায়, এই মুহূর্তে ইলেক্টোরাল ভোটের আগে এটা স্টার্ট করার জন্যে একটা চমৎকার সময়। যদিও ব্র্যান্ড বিল্ডিং একটা সময়ব্যাপী প্রক্রিয়া, কিন্তু এটাই সঠিক সময়। এবং বাংলাদেশের পলিটিক্যাল সিনারিওতে এটা শুরু করার জন্য একদম ম্যাচিউর টাইম।
এটা বলার কারণ হইতেছে বাংলাদেশের পলিটিশিয়ানরা একদম অর্গানিক ব্র্যান্ড বিল্ডিং প্রসেসের একদম কাঁচামালের খনির ওপর বসে আছেন, অথচ তারা নিজেরাই সেটা জানেন না।
রাজনীতি আসলে কী? এটার নানান ডায়নামিক পার্সপেকটিভ আছে কিন্তু ব্র্যান্ড এবং স্টোরিটেলিং ওরিয়েন্টেড পাঠকের সুবিধার্তে বলি রাজনীতি হলো সংঘাত, চ্যালেঞ্জ, উত্থান-পতন এবং মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা।
লক্ষ্য করে দেখুন, একটি ভালো গল্পের উপাদানেও ঠিক এগুলোই থাকে। একজন পলিটিশিয়ানের জীবন মানেই হলো প্রতিদিন নতুন নতুন ‘হিরো ইন আ হোল’ মোমেন্ট। তারা প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করছেন এবং মানুষের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ, ‘অর্গানিক স্টোরি’ তাদের জীবনে বিল্ট-ইন বা আগে থেকেই আছে। তাদের কষ্ট করে ব্র্যান্ডগুলোর মতো গল্প বানাতে হবে না, শুধু জীবনটাকে গল্পের ফ্রেমে ফেলে উপস্থাপন করতে হবে।
কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের দেশের পলিটিক্যাল ব্র্যান্ডিং এখনো সেই পুরোনো হিরো সাজার চেষ্টাতেই আটকে আছে যেখানে নেতা শুধুই মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত নাড়বে আর গপ্প মারবে, পাওয়ার প্র্যাকটিস করে বুঝাবে যে তিনি কত বড় লিডার। অথচ মানুষের ব্রেইনের কগনিটিভ এ্যাটেনশন পলিটিশিয়ানদের এই সুপারম্যান ইমেজের সাথে কানেক্ট করে না, কারণ সেখানে কোনো স্ট্রাগল বা রিলেটেবল গল্প নেই যা অডিয়েন্স তার নিজের সাথে কানেক্ট করতে পারে।
এখানেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুল হয়, যা পলিটিশিয়ানদের অবশ্যই ব্র্যান্ডের মতো করে রিথিংক করতে হবে। তাদের ক্লায়েন্ট/কাস্টমার হলো তার ভোটাররা। এবং মূলমন্ত্র হলো: ভোটদাতাকে হিরো বানাতে হবে, নিজেকে নয়।
আমার খুব পছন্দের একজন রাইটার ডোনাল্ড মিলারের একটা পডকাস্টের থেকে এখানে একটা উদাহরণ দিতেছি: হিলারি ক্লিনটন সর্বশেষ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফেভারিট থাকা সত্ত্বেও পরাজিত হন। কারণ তার পলিটিক্যাল ক্যাম্পেইনে তাঁর ট্যাগলাইন ছিল #I’m with her। এই ট্যাগলাইনটি স্বয়ং হিলারিকেই তার গল্পের দুর্বল হিরো বানিয়ে দেয়, যিনি সমর্থন পাওয়ার জন্য পারফেক্ট ছিলেন, তবুও।
তিনি যদি বলতেন #She’s with us কিংবা এই ধরনের পার্সপেকটিভ, তবে ভোটাররাই হিরো হতেন এবং হিলারি হতেন তাদের একজন পথপ্রদর্শক বা গাইড। ভালো ব্র্যান্ড যেভাবে প্রোডাক্ট বিক্রির জন্যে কাস্টোমারকে হিরো বানায় এবং তাদের প্রোডাক্ট/সার্ভিসকে গাইড/সলুশ্যন হিসেবে উপস্থাপন করে একই প্রসেসে আর কি। কিন্তু তার ক্ষেত্রে যেই ফেনোমেনা তৈরি হয়েছিলো তা হলো, মানুষ দুর্বল হিরোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায় না কিন্তু নিজের হিরোকে সাহায্য করার জন্য সবাই প্রস্তুত থাকে।
তাই এই পলিটিক্যাল দল বা ব্যক্তিরা যদি এখনই তাদের কমিউনিকেশন স্টাইলে পরিবর্তন আনেন যদি শুধুই উন্নয়নের ফালতু বয়ান না দিয়ে, সেই উন্নয়নের কিংবা তাদের চমৎকার ভিশনের পেছনের স্ট্রাগলের কিংবা নিজের ব্যক্তিগত ভিশনের পেছনের ইমোশনটা শেয়ার করেন তবে ভোটারদের ব্রেইন তাদের ইগনোর করতে পারবে না।
কারণ এখন বাংলাদেশের ডিজিটাল স্পেকট্রামের মানুষের উপস্থিতি/আলাপ নন-বায়াসভাবে হিসেব করলে (বটগুলোর হিসেব বাদ দিলে) খেয়াল করবেন যেসব পলিটিক্যাল লিডাররা তাদের বস্তাপচা স্টাইল এখনও বাদ দিতে পারতেছেন না, তাদের কমিউনিকেশনকে মানুষ জাঙ্ক/নয়েজ মনে করে। তাদের কোনো স্টোরি নেই যেটার সাথে মানুষ কানেক্ট করতে পারে।
সামনে যেহেতু নির্বাচনের মৌসুম, ডিজিটাল স্পেকট্রামের এই বিশাল ফাঁকা ভয়েডে যেই পলিটিশিয়ানরা সবার আগে নিজেদের স্টোরি ক্রাফট করে মানুষের অবচেতন মনে জায়গা করে নিতে পারবেন, দিনশেষে মানুষ তার গুরুত্বপূর্ণ কগনিটিভ ক্যালোরি খরচ করে তাকে মনে রাখবে, তাকেই বেছে নেবে। ব্র্যান্ডিংয়ের ভাষায় যদিও এটা খুবই সাধারণ টপ অব মাইন্ড অ্যাওয়ারনেস (Top of Mind Awareness)। তবে পলিটিক্সে, এই অ্যাওয়ারনেসই হতে পারে আসল গেমচেঞ্জার।
সামনের ইলেকশনে একটা দারুণ ক্যাম্পেইনও অনেক পলিটিশিয়ান তার সোশ্যাল কারেন্সিকে পজিটিভলিই ওলট পালট করে নিতে পারে। তাই ক্রিয়েটিভ স্পেয়ারের মানুষ এবং পলিটিক্যালি এনথুসিয়াসস্ট হিসেবে আমি ঐসকল ভিশনারি পলিটিশিয়ানদেরকেই আমার অ্যাটেনশন দিয়ে সাবস্ক্রাইব করতে চাই।