আজ আপনাদের সাথে এমন একজন সি’রি’য়াল কি’লারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব, যার নাম শুনলে গা শিউরে ওঠে। সে নিজের হাতে ১৭ জন যুবককে খু’ন করে, তাদের শ’রীরে’র অংশ কে’টে সংরক্ষণ করত, এমনকি ন’র’মাংস ভ’ক্ষণও করত। আমেরিকার ইতিহাসে "মিলওয়াকির ন’রখাদ’ক" নামে পরিচিত এই ব্যক্তি তার নৃ’শংস’তার মাধ্যমে যে ভয়ংকর জগৎটি তৈরি করেছিল, চলুন আজ আমরা সেই জগৎটি ঘুরে আসি।

১৯৬০ সালে জন্ম নেওয়া জেফরি ডাহমারের শৈশব ছিল পারিবারিক অস্থিরতায় ভরা। তার মা জয়েস ডাহমার মানসিকভাবে অসুস্থতায় ভুগতেন এবং বাবা লিওনেল ডাহমার কর্মজীবনের চাপে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন। জেফরি তার কৈশোরেই তীব্র একাকীত্বে ভুগতে শুরু করেন এবং সামাজিক মেলামেশা থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নেন।
১৯৬০ সালের ২১শে মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের মিলওয়াকিতে জন্মগ্রহণ করেন জেফ্রি ডাহমার। তিনি যে জীবনের শুরুটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেন না, তা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় তার অপরাধকাণ্ডের মাধ্যমে। একজন সি’রি’য়াল কি’লার হিসেবে তিনি ইতিহাসে কলঙ্কজনক নাম করে যান, যিনি ১৭ জন যুবককে হ’ত্যা করেন। তার অপরাধ শুধু হ’ত্যা’য় সীমাবদ্ধ ছিল না, সেখানে ছিল নর’মাং’সহরণ এবং নেক্রোফিলিয়ার মতো অমানবিক কাজের চিহ্নও।
যেভাবে অপরাধের সূত্রপাত ঘটে:
জেফ্রির প্রথম হ’ত্যা’কাণ্ড ঘটে ১৯৭৮ সালে ওহাইওর বাথ টাউনশিপে, মাত্র ১৮ বছর বয়সে। এরপর সারা দশকে, বিশেষ করে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে তিনি উইসকনসিনের মিলওয়াকি শহরে ১৫ জন বিশেষত দরিদ্র এবং বর্ণবাদে প্রান্তিকীকৃত আফ্রিকান আমেরিকান, এশিয়ান ও ল্যাটিনো তরুণদের হ’ত্যা করেন। তার অপরাধের ধরণ এতটাই নৃ’শং’স ছিল যে, পুলিশ ও সাধারণ জনসাধারণ উভয়েই তার পেছনে জোরালো সন্দেহ পোষণ করছিল।
ভিক্টিম ও হ’ত্যার পদ্ধতি :
ডাহমারের হ’ত্যা’র প্রধান পদ্ধতি ছিল শিকারকে ফ্ল্যাটে ডেকে আনা, নে’শাদ্রব্য বা ম’দ খাইয়ে দুর্বল করে দেওয়া এবং তারপর শ্বা’স’রোধ (গ’লা টি’পে) করে হ’ত্যা করা। এরপর সে মৃ’তদে’হের সাথে বিকৃত কাজ করত এবং দে’হাং’শ সংরক্ষণ করে রাখতো।
১. স্টিভেন হিকস
(১৮ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯৭৮ সালের ১৮ জুন।
পদ্ধতি: ফ্ল্যাটে ডেকে এনে শ্বা’স’রোধ করে হ’ত্যা করা হয়। এটি ছিল তার প্রথম শিকার, যার দে’হ সে টুক’রো করে জঙ্গলে পুঁতে ফেলে।
২. স্টিভেন টুওমি
(২৪ বছর): হ’ত্যা’র সময়: ১৯৮৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।
দীর্ঘ বিরতির পর দ্বিতীয় শিকার। এই সময় থেকেই ডাহমার মৃতদেহের সাথে বিকৃত কাজ শুরু করেন।
৩. জেইমি ডক্সটেটর (১৪ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯৮৮ সালের ১৬ জানুয়ারি।
৪. রিচার্ড গুয়েরেরো (২৫ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯৮৮ সালের ২৪ মার্চ।
৫. অ্যান্টনি সিয়ার্স (২৬ বছর):হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯৮৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।
৬. এডি স্মিথ (৩২ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯৯০ সালের ১৪ জুন।
৭. রিকি বিকস (২৭ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯৯০ সালের ১৮ জুলাই।
৮. ম্যাট টার্নার (২০ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯৯০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।
৯. ডোনাল্ড ফ্রিস্কে (২৩ বছর):হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯৯১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি।
১০. এর্নেস্ট মিলার (২২ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: এপ্রিল, ১৯৯১।
১১. ডেভিড টমাস (২৩ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: মে, ১৯৯১।
১২. অ্যান্টনি হিউজেস (৩১ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ২৪ মে, ১৯৯১।
তিনি ছিলেন একজন শ্রবণ ও বাক-প্রতিবন্ধী যুবক।
১৩. কোনেরাক সিন্থাসোমফোন (১৪ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ২৭ মে, ১৯৯১।
১৪. জোসেফ ব্রাডহফট (২৫ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯ জুন, ১৯৯১।
১৫. অলিভার লেসি (২৩ বছর):হ’ত্যা’র সময়কাল: ১২ জুলাই, ১৯৯১।
১৬. এরল লিন্ডসে (২৫ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯ জুলাই, ১৯৯১।
১৭. কার্টিস স্ট্রটার (১৮ বছর): হ’ত্যা’র সময়কাল: ১৯ জুলাই, ১৯৯১।
ডাহমারের হাতে খু’ন হওয়া সর্বশেষ ভিকটিম।
প্রত্যেকজনকে হ’ত্যা’কা’ণ্ডের পরই ডাহমার মৃ’ত মা’নুষ’দের সাথে নোংরা কাজ করতেন, তাদের শ’রী’র কে’টে টুক’রো টুক’রো করতেন এবং মাং’স রান্না করে খেতেন। সে চাইত শিকারের দে’হাংশগুলো ফ্রিজে বা অন্য কোথাও জমিয়ে রাখতে।
গ্রেপ্তার এবং তদন্ত:
১৯৯১ সালের জুলাই মাসে শেষমেশ এমন একটা ঘটনা ঘটল, যার ফলে ডাহমারের সব কাণ্ডকারখানা ফাঁস হয়ে গেল। ট্রেসি এডওয়ার্ডস নামে একজন শিকার কোনোমতে ডাহমারের ফ্ল্যাট থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন । তার হাতে তখনও হাতকড়া লাগানো ছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় দুই পুলিশ অফিসারকে থামিয়ে জানান যে, জেফ্রি ডাহমার তাকে খু’ন করার জন্য চেষ্টা করেছে। পুলিশ তখন ডাহমারের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ।ভিযান চালায় এবং ফ্রিজ খুলে দেখল সেখানে মানুষের টু’করো টু’করো করা মাং’স, ক’ঙ্কাল এবং মাথা রাখা আছে। এই ভয়ানক জিনিসগুলো আবিষ্কার হওয়ার পর ডাহমারের অপরাধের তথ্য বাইরে বেরিয়ে আসে, যা জানার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়।
ডাহমার শুধু একজন খু’নিই ছিলেন না, সে ছিল নে’ক্রো’ফি’লিয়া (অর্থাৎ মৃ’ত মানুষের সঙ্গে নোংরা কাজ) এবং ন’র’মাং’স ভক্ষণের (মা’নু’ষের মাং’স খাওয়ার) মতো ভয়ানক অপরাধের এক জঘন্য চরিত্র। সে ভিকটিমদের মে’রে তাদের শরী’র কে’টে টু’ক’রো টুক’রো করত। তার এই কাজগুলো সমাজে এক চরম বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দেয়। ডাহমারের অপরাধের এই ভয়াবহতা পুলিশ, বিচারক এবং সাধারণ মানুষ সবার চোখ খুলে দিয়েছিল যে স ‘রি’য়াল কি’লা’রদের প্রকৃত রূপরেখা এবং তাদের নৃ’শংস’তা আসলে কতটা ভয়ংকর হতে পারে।
ডাহমারের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া নিয়ে কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে। তদন্তকারী এবং সাধারণ মানুষ মনে করেন, পুলিশ যদি আরও দ্রুত সচেতন হত এবং ভালোভাবে ব্যাপারটা দেখত, তাহলে হয়তো আরও অনেক মানুষের জীবন বাঁচানো যেত। মিলওয়াকির সমাজ এ ব্যাপারে পুলিশের দুর্বল ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছিল। ডাহমারের অপরাধের তীব্রতা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, সিরিয়াল কিলিং-এর ইতিহাসে এটি এক গভীর দাগ কেটে দিয়েছে।
বিচারকাজ:
গ্রেফতারের পর ডাহমার প্রথম দিকে নিজের দোষ স্বীকার করতে চাননি, কিন্তু পরে তিনি সব স্বীকার করেন। ১৯৯২ সালে তার বিচার শুরু হয়। আদালতে দীর্ঘ শুনানি শেষে তাকে পরপর ১৫টি কেসে ১৫ বার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর, তার প্রথম হ’ত্যা’কাণ্ডটির জন্য আরও একটিসহ, অর্থাৎ মোট ১৬তম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যোগ করা হয়।
এই পুরো সময়টায় বিচার প্রক্রিয়া এবং স্থানীয় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিশাল সমালোচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ডাহমার এত বছর ধরে এতগুলো খু’ন করে গেল, অথচ পুলিশ কেন সময়মতো ধরতে পারল না? সাধারণ মানুষের মনে হচ্ছিল, যদি পুলিশ আরও দ্রুত এবং ভালোভাবে কাজ করত, তাহলে হয়তো এতগুলো তরতাজা প্রাণ বাঁচানো যেত।
কারাগারের দিনগুলো:
ডাহমারকে পোর্টেজের কলম্বিয়া সংশোধনাগারে রাখা হতো যেখানে তাকে অন্যান্য বন্দীদের থেকে আলাদা করা হয়েছিল। প্রতিনিয়ত তাকেও নিরাপত্তা দেওয়া হতো। কিন্তু তিনি এতটাই অনধিকার চরম অপরাধী ছিলেন যে, তাঁর সঙ্গেই বন্দীদের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি হত।
মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণ:
জেফ্রি ডাহমারের অপরাধগুলো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তার মানসিক অবস্থায় অনেক সমস্যা ছিল। বিভিন্ন মানসিক পরীক্ষা থেকে প্রমাণ হয় যে, তার মধ্যে নে’ক্রো’ফি’লিয়া (মৃ’ত’দে’হের প্রতি আকর্ষণ) এবং সাইকোপ্যাথিক এর প্রবণতা ছিল। এই কারণেই তার করা খু’নগুলো এত ভয়াবহ আর নৃ’শং’সে রূপ নিয়েছিল। তবে, ১৯৯২ সালে যখন তার বিচার হয়, তখন বিচারক এবং জুরি কিন্তু তাকে মোটেই পাগল বলে স্বীকৃতি দেননি। তারা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ডাহমার সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন এবং পরিকল্পনা করেই অপরাধগুলো সংঘঠিত করেছেন। তাই তাকে মানসিক রোগী হিসেবে না দেখে, একজন সম্পূর্ণ সচেতন অপরাধী হিসেবেই শা’স্তি দেওয়া হয়।
শেষ পরিনতি:
১৯৯৪ সালের ২৮শে নভেম্বর কারাগারে একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। জেফ্রি ডাহমার সেদিন কারাগারের জিমনেসিয়ামের বাথরুম পরিষ্কার করছিলেন। তার সাথে ছিল আরও দুই বন্দী, যাদের মধ্যে একজন ছিল ক্রিস্টোফার স্কারভার। স্কারভার ডাহমারের নৃ’শংস অপরাধগুলোকে মোটেও মেনে নিতে পারত না, বরং সে প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল।
কাজ করার সময় স্কারভার ডাহমারের ওপর নিষ্ঠুরভাবে হা’মলা চালায়। ভয়াবহ আঘাতের কারণে ৩৪ বছর বয়সী ডাহমার কয়েক ঘণ্টা পর মা’রা যান। একই আক্রমণে স্কারভার জেসি অ্যান্ডারসন নামে অন্য একজন বন্দীকেও মে’রে ফেলে। এই হ’ত্যা’র কারণে স্কারভারকে আরও একবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ডাহমারের জীবন আমাদের শেখায়, কখনও কখনও অন্ধকার আমাদের চারপাশে এত গভীর হয় যে, সেখান থেকে বের হওয়া এক বিশাল যুদ্ধের মতোই কঠিন। ডাহমারের মতো অতর্কিত স’ন্ত্রাসী’রা যেভাবে সমাজের নিরাপত্তা ও মূল্যবোধকে ব্যাহত করে, তা থেকে সতর্ক থাকা জরুরি।
ডাহমারের মৃ’ত্যুর পরও কিন্তু তার অপরাধ নিয়ে আলোচনা থামেনি। তিনি যেন একটি কালো অধ্যায় হয়ে থেকে গেছেন আমেরিকান সমাজ এবং সি’রি’য়াল কি’লিং ইতিহাসে। তার জীবন নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি ও বই লেখা হয়েছে যা মানুষের মনে প্রশ্ন তোলে অপ’রাধের কারণ ও সামাজিক পরিবেশ নিয়ে।
ডাহমারের এই অপরাধ এবং তার গ্রে’ফতারের পর সি’রি’য়াল কি’লিং-এর মতো ঘটনার দিকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ ও সচেতনতা অনেক বেড়ে যায়। তার এই পুরো ঘটনা নিয়ে অনেক অনেক গবেষণা হয়েছে, এবং বেশ কিছু বই ও ডকুমেন্টারিও তৈরি হয়েছিল।
পাঠক, এই ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে নিচের বইগুলো পড়তে পারেন।
অ্যান ই. শোয়ার্জের লেখা "দ্য ম্যান হু কুড নট কিল এনাফ: দ্য সিক্রেট মার্ডারস অফ মিলওয়াকির জেফ্রি ডাহমার" বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বইটি প্রথম ১৯৯২ সালে বের হয়েছিল এবং পরে ২০১১ সালেও আবার প্রকাশিত হয়। এই বইগুলো সি’রি’য়াল কি’লার’দের নিয়ে মানুষের আগ্রহ ও আলোচনা আরও বাড়িয়ে দেয়।
আরও একটি আলোচিত বই হলো "এ ফাদারস স্টোরি", যা তার বাবা লিওনেল ডাহমার লিখেছিলেন। এই বইটিতে তিনি একজন বাবা হিসেবে তার ছেলের অপরাধের মোকাবিলা কীভাবে করেছিলেন, সেই কঠিন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ডাহমারের মানসিক দিকগুলো নিয়ে আরও বিশ্লেষণমূলক বই লিখেছেন ক্যাথারিন এম. রামল্যান্ড, যার লেখা বইটির নাম "ডাহমার কনফেশনস"। এর পাশাপাশি ডোনা এল. হার্টিং-এর "দ্য সাইলেন্ট ভয়েসেস" এবং জেরোম পি. মারিনোর লেখা "ডাহমার, ম্যানস্টার" বইগুলোও এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছে।