Posts

গল্প

আলো খোঁজার যাত্রা

December 6, 2025

RBD MOTIVATION

Original Author Humayun Ahmed

Translated by Not translated

21
View

মেঘলা বিকেল। হালকা বাতাস বইছে ইউনিস্কুলের মাঠে। মাঠের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে নবম শ্রেণির ছাত্র রাফিন। তার বইগুলো খোলা, কিন্তু চোখ যেন শব্দের ওপর আটকে নেই। দূরে ফুটবল খেলছে কিছু সহপাঠী। হাসির শব্দ ভেসে আসছে, কিন্তু সেই আনন্দ যেন আজ রাফিনকে ছুঁতে পারছে না। আগামী মাসে তার বার্ষিক পরীক্ষা। বারোটা বিষয়। পড়া অনেক বাকি। বাবা–মা আশা করে সে ভালো রেজাল্ট করবে, কিন্তু সে মনে মনে ভয় পাচ্ছে—পারবে তো?

রাফিন এমন ছাত্র না যে মনোযোগী নয়। সে চায় ভালো করতে, চায় নিজের পরিবারকে খুশি করতে, কিন্তু মাঝে মাঝে তার মনে হয় যে সে অন্যদের মতো বুদ্ধিমান নয়। ক্লাসে কিছু বন্ধু যখন সহজেই সব বোঝে, রাফিন তখন বারবার আটকে যায়। এতে তার মনে একধরনের আত্মবিশ্বাসহীনতা কাজ করে। আজকেও গণিতের ক্লাস টেস্টে সে উনিশের মধ্যে মাত্র আট পেয়েছে। বন্ধুদের সামনে মানসম্মান রক্ষা করতে সে হেসে বলেছে—“যাক গে, পরের বার ভালো হবে।” কিন্তু মনের ভেতরটা যেন পাথরের মতো ভারী।

স্কুল ছুটির পর ধীর পায়ে বাড়ি ফেরার সময় রাফিনের পাশে এসে হাঁটতে শুরু করল তার সহপাঠী লায়লা। লায়লা ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্রী। চুপচাপ, শান্ত, কিন্তু খুব সাহায্যকারী। সে বুঝতে পারছিল রাফিনের মন খারাপ।

লায়লা ধীরে বলল, “তুই খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিস।”

রাফিন একটু হাসার চেষ্টা করল, “আরে না, কিছু না।”

লায়লা বলল, “আমি কি বোকা নাকি? দেখি তো রাফিন ভাইয়ের চোখের নিচে পুরো হতাশার ছাপ। কী হয়েছে বল।”

রাফিন প্রথমে বলতে চাইছিল না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেমন যেন সাহস নিয়ে সব খুলে বলল। তার ভয়, তার দুর্বলতা, তার ফলাফলের দুশ্চিন্তা—সবই। লায়লা মন দিয়ে শুনল।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে লায়লা বলল, “শোন, তোর একটা সমস্যা আছে—তুই নিজের ওপর বিশ্বাস করিস না। বই কঠিন না রাফিন, মনটাই কঠিন। তুই যদি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখিস, তুইও পারবি।”

রাফিন হেসে বলল, “বিশ্বাস দিয়ে কি গণিতের অংক সমাধান হয়?”

লায়লা বলল, “বিশ্বাস দিয়ে প্রচেষ্টা জন্মায়। আর প্রচেষ্টাই অংক সমাধান করায়।”

রাফিন কিছু বলল না। তবে কথাগুলো গভীরভাবে তার মনে জায়গা করে নিল। বাড়ি ফিরে খেতে বসার সময়ও তার মাথায় লায়লার কথাগুলো ঘুরতে থাকল।

পরদিন বিকেলে রাফিন সিদ্ধান্ত নিল—সে এবার সত্যিই চেষ্টা করবে। সে একটা বড় খাতা বের করে প্রথম পাতায় লিখল—“আজ থেকে শুরু। আমি পারব।”

এরপর সে নিজের সব বিষয়গুলো আলাদা করে ভাগ করে নিল। প্রথম লক্ষ্য স্থির করল সাহিত্য পড়া। বাংলা তার সবচেয়ে শক্তিশালী বিষয়। সে পড়তে পড়তে বুঝতে পারল—যে বই আগে বিরক্তিকর মনে হতো, সেই বই এখন তাকে আকর্ষণ করছে। কারণ সে এবার পড়ছে নতুন মানসিকতা নিয়ে।

কয়েকদিন পর রাফিন বুঝতে পারল যে পরিবর্তনটা শুধু পড়ায় নয়, তার অভ্যাসেও হয়েছে। সে আগের মতো আর মোবাইলের স্ক্রিনে ঘন্টার পর ঘন্টা ডুবে থাকে না। পড়ার টেবিল পরিষ্কার রাখে, ব্যাগ গুছিয়ে রাখে, ঘুম-জাগার সময় ঠিক রাখে। সে যেন নতুন এক রাফিন।

কিন্তু সবকিছু এত সহজে এগোয়নি। গণিতের একটা অধ্যায় তাকে খুব বিভ্রান্ত করল। প্রশ্নগুলো তাকে আবারো মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলতে লাগল। সেদিন রাতে রাফিন ভাবল—তার এত চেষ্টা কি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে?

পরদিন স্কুলে লায়লা লক্ষ্য করল রাফিনের মন খারাপ। সে কিছু না বলেই রাফিনকে লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল। সেখানে একটা খাতা বের করে বলল, “দেখ, এটার নাম আমার ‘ধৈর্যের খাতা’। যখনই কোনো কঠিন সমস্যা পাই, এখানে একবার চেষ্টা লিখে রাখি। পরে আবার চেষ্টা করি। মানুষ একবারেই পারে না—এটাই স্বাভাবিক।”

রাফিন অবাক হয়ে বলল, “তুই তো সবসময়ই প্রথম হোস। তোর কি দুর্বলতা থাকে?”

লায়লা একটু হাসল, “তুই কি মনে করিস আমি সব পারি? আমি কঠিন প্রশ্নে আটকে যাই না? পার্থক্য শুধু এটা—আমি হাল ছাড়ি না।”

এই কথাগুলো রাফিনের মনে আগুন ধরিয়ে দিল। এবার সে গণিতে হাল ছাড়বে না। লায়লা তাকে একেবারে শুরু থেকে সব বোঝাতে লাগল। দু’জন প্রতিদিন স্কুলের পরে এক ঘণ্টা করে পড়ত।

বাড়িতে এসে রাফিন নতুনভাবে অনুশীলন শুরু করল। প্রথম দিনই সে আট-দশটা অংক ভুল করল। দ্বিতীয় দিনও ভুল করল। কিন্তু তৃতীয় দিনে সে দেখল—কিছু সহজ প্রশ্ন আর তাকে ভয় দেখাচ্ছে না। সপ্তম দিনের শেষে সে এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল যে আগের টেস্টের কঠিন প্রশ্নগুলো আবার সমাধান করতে পারল।

তার পরিবর্তন শুধু পড়ায় নয়, চরিত্রেও ফুটে উঠল। সে এখন ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে শোনে। আগের মতো আর ভয় পায় না। শিক্ষকরা দেখতে পেল—রাফিন বদলে গেছে। সে এখন প্রশ্ন করে, বোঝে, চেষ্টা করে।

পরীক্ষার তারিখ আসতে আর বেশি দেরি নেই। সবাই তৈরি হচ্ছে। সেইদিন রাফিন বাড়িতে বসে পড়ছিল, হঠাৎ তার ছোট ভাই এসে বলল, “ভাইয়া, খেলবি? সবাই মাঠে খেলছে।”

রাফিন তাকে বলল, “আজকে পারব না। আজ আমার আরেকটা লড়াই আছে।”

ছোট ভাই একটু মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল, কিন্তু তার কথাটা রাফিনের মনে খোদাই হয়ে রইল। সত্যিই, আজ তার লড়াই নিজেকে নিয়ে। ভয়কে জিতে তোলা। ব্যর্থতাকে জয় করা।

পরীক্ষার প্রথম দিন বাংলা। প্রশ্নপত্র দেখে সে হাসল—সবই সে পড়েছে। শান্তভাবে লিখল। দ্বিতীয় দিনে ইংরেজি। এটাও ভালো হলো। তৃতীয় দিনে গণিত। সে জানল—এটাই তার আসল পরীক্ষা। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়েই তার হাত একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই সে চোখ বন্ধ করে লায়লার কথা মনে করল—“হাল ছাড়া মানে হার মেনে নেওয়া।”

আর সে হার মানতে চায়নি।

প্রশ্নগুলো কঠিন ছিল, কিন্তু তাকে পরাস্ত করতে পারেনি। রাফিন ধীরে ধীরে ধৈর্য নিয়ে প্রতিটি প্রশ্ন সমাধান করল। পুরো সময় মনোযোগ ধরে রাখল। পরীক্ষার শেষে সে অনুভব করল—সে চেষ্টা করেছে, আর সেটাই জয়।

পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন স্কুলে একটা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ। সবাই উদ্বিগ্ন। রাফিনের হৃদস্পন্দন যেন বাইরে থেকেও শোনা যায়। ফলাফল হাতে পাওয়ার পর তার চোখ বিশ্বাস করতে পারছিল না—সব বিষয়ে সে পাশ করেছে, আর গণিতে তার নম্বর আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

রাফিন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার হাত কাঁপছে, কিন্তু তা দুঃখে নয়—গর্বে। নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার আনন্দে।

লায়লা দূর থেকে দৌড়ে এসে বলল, “কেমন হলো?”

রাফিন হাসল, “আমি পেরেছি!”

লায়লা বলল, “আমি তো জানতাম তুই পারবি। কারণ তুই চেষ্টা করেছিস।”

এই কথাগুলো শুনে রাফিন বুঝল—মানুষের প্রকৃত শক্তি তার নম্বরে নয়, তার অধ্যবসায়ে। মানুষ যখন নিজের দুর্বলতাকে জয় করে, তখনই সে সত্যিকারের সফল হয়।

সেই দিন থেকে রাফিন প্রতিজ্ঞা করল—সে আর কখনো নিজের ওপর সন্দেহ করবে না। কারো সাফল্য দেখলে নিজেকে ছোট ভাববে না। বরং সে ভাববে—প্রচেষ্টা হলে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।

আর সে প্রতিজ্ঞা করল অন্যদেরও সাহায্য করবে, ঠিক যেমন লায়লা তাকে সাহায্য করেছিল। কারণ যে আলো তার জীবনে নতুন পথ দেখিয়েছে, সে আলো সে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চায়।

বছরজুড়ে রাফিন শুধু পড়াশোনায় না, বরং আচরণেও একজন রোল মডেল হয়ে উঠল। শিক্ষকরা তাকে পছন্দ করল, সহপাঠীরা তাকে সম্মান করতে লাগল। কারণ রাফিন জানত—সফল মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়, আশেপাশের সবার জন্য ভালো কাজ করে।

যখনই কোনো ছোট ছাত্র ভয় পেত, রাফিন তাকে বলত—“সমস্যা যত বড়ই হোক, ভয় পেলে হবে না। চেষ্টা করলেই হবে। একটু ধৈর্য, একটু মনোযোগ, আর একটু বিশ্বাস—এই তিনটাই যথেষ্ট।”

রাফিনের জীবন বদলে গেল। তার মধ্যে এমন আত্মবিশ্বাস জন্ম নিল যা কখনো তাকে ছাড়েনি। সে বুঝল—পরীক্ষায় ভালো করা শুধু লক্ষ্য নয়। আসল শিক্ষা হলো—নিজের সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করা।

এভাবেই রাফিনের নতুন পথচলা শুরু হয়। তার জীবন একটাই শিক্ষা দিয়ে যায়—
মানুষ যদি নিজের সামনে আলো খুঁজতে চায়, তাকে নিজের ভেতর থেকেই সেই আলো তৈরি করতে হয়। আর সেই আলো তৈরি হয় ধৈর্য, অধ্যবসায় আর নিজের প্রতি বিশ্বাস থেকে।

কারণ কখনো কখনো সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় নিজের মনকে নিয়ে। আর যে এই যুদ্ধ জিতে যায়, তার কাছে পৃথিবীর কোনো বাধা অসম্ভব থাকে না।

Comments

    Please login to post comment. Login