ক্যাম্পাস- প্রেম
হুমায়ূন কবীর
তুষার- পরিচিত কেউ আছে? মানে নোটপাতি ম্যানেজ করা যায় কিনা।
রাশমিন- হ্যাঁ, আপনি আসেন।
তুষার-সে না হয়ে যাওয়া যাবে।কিন্তু তুমি এই দুপুর বেলা চলে যাচ্ছ। আমার হলে চলো খেয়েদেয়ে ধীরেসুস্থে যেতে পারবে।
রাশমিন - আজ না অন্য একদিন।
আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম। এ শুধু পিছলে পিছলে যাচ্ছে। ধরি মাছ না ছুই পানি অবস্থা তবু শত হতাশার মাঝে ও আশার ক্ষীণ আলো মিটিমিটি জ্বলছে। এখনো সঙ্গ পাচ্ছি, অন্ততঃ আরো কিছুক্ষণ তো পাওয়া যাবে। এইভাবে পথ চেনাতে চেনাতে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছে। হয়তো এই পথ চলা পথেই শেষ হবে। হোক ক্ষতি কি?
কথা বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলাম। তাকে বাসে তুলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।
পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা থাকলে সিগারেট যে কি বিস্বাদ লাগে সে বলার না। একেবারে বিশ্রী লাগছে কিন্তু সাম্প্রতিক বিচ্ছেদ তার চেয়েও বেশি বিস্বাদ এবং যন্ত্রণাদায়ক। সিগারেট টেনে টেনে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।আর হেঁটে যাওয়া সম্ভব না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ২:৩০ বাজে। ডাইনিংএ খাওয়ার সময় চলে যাচ্ছে। আর দেরি হলে ভাত পাওয়া যাবে না । আগে থেকেই বলে রাখলে অবশ্য ভাত রেখে দেয়।কিন্তু তা তো বলা হয়নি। অগত্য রিক্সা নিলাম। যে পথে আমরা দুজন হেটে এসেছি রিক্সা সেই পথ দিয়ে চলেছে। আসলে এই পথেও রিকশা চলে, তবে কম। রাশমিন জানেনা। জানলে তো সে রিক্সায় উঠে চলে যেত। চলে গেলে তার সাথে এই হাঁটা হতো না। এই বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত সঙ্গ দেওয়া যেত না। এই সময়ের জন্য, এই সঙ্গের জন্য আমি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। বলেছি এই পথে রিক্সা চলে না।
এমনও হতে পারে, সে সব জানে। সেও হয়তো এই সঙ্গটা চেয়েছিল। হয়তো সে আমাকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েছে । হয়তো সে আমার দৌড় কতদূর তা দেখতে চেয়েছে। কতসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে হলে চলে এলাম। রিক্সার ভাড়া মেটাতে যে দেখলাম, পকেট প্রায় শূন্য। টাকার প্রয়োজন অতএব বাড়িতে যেতে হবে।
রাশমিন হীন সবকিছু শূন্য শূন্য লাগছে। এই প্রথম অনুভব করলাম আমি বড় একা। আমার চারপাশে যে কোলাহল তা আসলে কিছুই না। এই যে এত বন্ধু, এত মিছিল মিটিং এত হইচই, এত কিছুর ভেতর আমার আপন কই? এ এক অন্য আপন। যে আপনের কাছে হৃদয়ের গোপন কথাগুলো একান্ত নিজস্ব কথাগুলো বলা যায়। বলে তৃপ্তি পাওয়া যায়। সেই আপন কই? মনে হচ্ছে, সেই আপন শুধু একমাত্র রাশমিন। আমি কি প্রেমে পড়েছি? তা না হলে অন্তরে এত শূন্যতা কেন? রাশমিনের জন্য এত কেন টান অনুভব করছি? মনে হচ্ছে এখনই ছুটে খুলনায় চলে যাই।
রুমে ঢুকে দেখি, আমার রুমমেট শাহানুর গিটারে দারুন একটা হিন্দি গান বাজাচ্ছে। আমার অন্য রুমমেটরাও তার চারপাশে জড়ো হয়ে সেই গান শুনছে।মাঝে মাঝে তালে তালে চিৎকার করছে। শাহানুরের গিটারের হাত ভালো। সে সহজ ভঙ্গিতে দারুন দারুন সুর তোলে।দেখে মনে হয় গিটার বাজানো খুব সহজ। কিন্তু না। আমরা অনেকে অনেক সময় চেষ্টা করেছি কিন্তু বিফল হয়েছি। বৈচিত্রহীন একঘেয়েমি হল জীবনে এই গিটারটি আমাদের মাঝে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে । এই নতুন মাত্রার জন্য মাসুলও দিতে হয়। শাহনুর হর হামেশা গিটার কোলে বিপুল উৎসাহে যখন তখন বসে পড়ছে। রুমে কেউ পড়ছে, কি কেউ ঘুমাচ্ছে তাতে ওর কোন তোয়াক্কা নেই। আমরা ব্যাপারটিতে অস্বস্তি বোধ করলেও তা সহ্য করছি এবং তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি । শুধু প্রশ্রয় না তার আনন্দে দলীয়ভাবে অংশ নিচ্ছি।কিন্তু এখন আমি কিছুতেই রুমের এই হুল্লোড়ে মন বসাতে পারছি না। মনটা কোথায় পড়ে আছে। কোন এক অজানা পথের পাশে। অনিশ্চিত তার ভবিষ্যৎ। মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম, রাশমিনকে আমার চাইচাই।যে কোন মূল্যে।এর জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে রাজি আছি। জানি এ সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা ১০০%। কিন্তু মন কোন যুক্তি মানে না।
যুক্তিহীন মন কিছুতেই স্থির করতে পারছি না। কোন কিছু ভালো লাগছে না। হলে আর মন টিকছে না। চারদিকে সব প্রাণহীন প্রেত পুরি মনে হচ্ছে।
একটা সিগারেট ধরালাম। কানতে টানতে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাড়ি যাবো। অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি। বাড়ি গেলে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে। কয়েকটা দিন থেকে আসি । ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের তো দেরি আছে। এর মাঝেই রাশমিনের সাথে দেখা হওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই।
গতকাল বাড়ি এসেছি। খুব ভোরে মেয়েলি কান্নাকাটির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মেজাজ এত খারাপ লাগছে সে আর বলার না। কোন বিপদ টিপদ হলো না তো? বিরক্ত হয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। এ কার কন্ঠ? এ তো আমাদের বাড়ির কারোর না। তাহলে? বুকের ভিতর হঠাৎ যেন বজ্রপাত হল। তবে কি ছেলেটা মারা গেছে?ইস বাচ্চা ছেলে! একেবারে কচি মুখ।
গত রাতের ঘটনা। শুয়ে আছি গভীর ঘুমে।একটার মত বাজে। অনেক লোকের চেঁচামেচি কান্নাকাটির হট্টগোলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, আমাদের বাড়ির উঠানে লোকে লোকারণ্য।মেয়ে মানুষ, পুরুষ মানুষ, বাচ্চা ছেলে- মেয়ে। উঠান গমগম করছে। এক নজর দেখেই বুঝে গেছি কোন সাংঘাতিক ব্যাপার। একটা বাচ্চা ছেলের উরুর উপরে মোটা মোটা দড়ির শক্ত গিট। হাঁটুর নিচে তোয়ালের শক্ত গিট।সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।এ দৃশ্য আমাদের বাড়ির খুবই পরিচিত। খুব বেশি অবাক হলাম না। আমাদের শওকতের ছেলে সোহাগ, ক্লাস ফাইভে পড়ে।খুব মেধাবী। তাকে সাপে কেটেছে। ঝড় ফুকের জন্য আমার মায়ের কাছে নিয়ে এসেছে। আমার মাও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। দুর্বল মানুষ। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছে। ডাকলে উঠবে কিন্তু পরে তার আবার চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। মাথায় তেল পানি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ বাতাস করতে হবে। মা অল্পতেই দুর্বল হয়ে পড়ে, ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
যাহোক মা উঠল। ঝড় ফুক করলো। সোহাগ ভালো হয়ে বাড়ি চলে গেল। তাহলে সকালে আবার এত কান্নাকাটি কিসের? আমার বুদ্ধি জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি এই গ্রামের সমস্ত সাপে কাটা রোগী মার কাছে আসে। মা ঝাড়ফুঁক করে। পায়ের একটি বিশেষ আঙ্গুলের মাথা আচ্ছা করে দড়ি দিয়ে বেঁধে মন্ত্র পড়ে পড়ে টানে। এক সময় আঙুলের মাথা জমাট কালো হয়ে ফুলে ওঠ। একটা সুচ আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধ করে খ্যাচ করে আঙুলের মাথায় ফুটিয়ে দেয়।তীর বেগে কালো বিষাক্ত রক্ত ছুটে বেরিয়ে আসে। মাটিতে কলার পাতায় লবণ রাখা থাকে। রক্তাক্ত ফটো আঙ্গুলটি সেই লবণের ভিতরে ঠেসে ধরা হয়। ঠেসেঠেসে বিষাক্ত রক্ত বের করা হয়। এক সময় দেহ বিষমুক্ত হয়। মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যায়। এভাবেই বছর পর বছর চলে আসছে এর কোন ব্যতিক্রম কখনো ঘটেনি। এ পর্যন্ত কেউ মারাও যায়নি। তবে কি এত দিনের নিয়মের ব্যতিক্রম হলো? সোহাগ মারা গেল? আমি আতঙ্কিত হয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দেখি জলিলের মা আমার আব্বার পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করছে।
জলিলের মাকে দেখেই মেজাজটাই বিগড়ে গেল। আমি অনেকবার এই মহিলার সালিশ করেছি। একটা ফালতু মহিলা। কথায় কথায় শুধু শালীস ডাকে। আজকেও হয়তো কোন সামান্য ব্যাপার নিয়ে এসেছে। আমি পুনরায় ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ফালতু মহিলার প্যাচাল শোনার সময় নেই। বউ শাশুড়ির ঝগড়া তাই নিয়ে আবার শালিস। কিন্তু জলিলের মার কান্না থামলো না। তার চিকন নাকি কান্নার সুর একসময় বিকট আকার ধারণ করল। আর ঘুমানো হলো না। বাইরে বেরিয়ে এলাম।
সে আমার বাপের পায়ে পড়ে কেঁদে কেঁটে অস্থির। আগে কখনো এতটা দেখিনি। ব্যাপার নিশ্চয়ই গুরুতর। সে বারবার আব্বার পায়ের উপর আছড়ে আছড়ে পড়ছে- ও মামু তুমি আমার বাঁচাও।দুনিয়ায় তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই । ও মামু ওরা আমার সব লিখে নেবে। আমাকে রাস্তার ফকির বানাবে। আল্লাহ তুমি এর বিচার কর।
তার কথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। শেষমেষ জলিলের বউয়ের জন্য জলিলের মাকে ভিটা ছাড়তে হবে? এ হতে পারে না। কিছু একটা করতেই হয়। আমি তার সমস্ত কথাগুলি শুনলাম। মানুষ যে এত বড় হৃদয়হীন হতে পারে তা না শুনলে বোঝা যাবে না।
ডিপজল বাহিনীর প্রধান ডিপজল জলিলের মাকে সময় বেঁধে দিয়েছে। হয় এক সপ্তাহের ভিতরে জলিলকে দুবাই থেকে দেশে আনতে হবে, না হয় জলিলের বউয়ের নামের সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিতে হবে। ডিপজল গতরাতে সালিশ করে এই রায় দিয়েছে।এই অঞ্চলের তার রায় অমান্য করা সাধ্য কারো নেই।