Posts

চিন্তা

আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন?

December 7, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

45
View

তুই আমারে চিনস? এই বাক্যটি উঁচু-নিচু কিংবা অক্ষম-সক্ষম নির্বিশেষে বাঙালির খুবই প্রিয়। অন্যকে অধস্তন ঠাওরে হেনস্থা করবার মতো আনন্দ যেন আর কিছুতেই নেই। অন্যকে খাটো করতে নিজের শ্রেষ্ঠতর অবস্থানের কথাও মানুষ নিমিষে ভুলে যায়। ঠিক এমনটিই ঘটেছে ময়মনসিংহে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিদর্শনে আসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আবু জাফরের সঙ্গে তর্কে জড়ানো চিকিৎসক ধনদেব চন্দ্র বর্মণকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, যার জবাব ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিতে হবে। শনিবার বিকেলে হাসপাতাল প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত জানায়। বিকেল চারটার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. গোলাম ফেরদৌস নোটিশটি জারি করেন।

দিনের পূর্বনির্ধারিত এক সেমিনারে যোগ দেওয়ার আগে ডিজি যখন ক্যাজুয়ালটি অপারেশন থিয়েটার পরিদর্শন করছিলেন, তখন কক্ষে টেবিল থাকার কারণ জানতে চান তিনি। এ সময় ক্যাজুয়ালটি ইনচার্জ ধনদেব চন্দ্র বর্মণ তাঁর সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন।

গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিবেশিত ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. আবু জাফর তাঁর সিনিয়র সহকর্মী ডা. ধনদেব বর্মণের দিকে আঙুল তুলে কথা বলছেন। প্রথমে তিনি বলেন, 'আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন?'

এক পর্যায়ে ডা. বর্মণকে চুপ করাতে গিয়ে ডিজি ভুল ইংরেজিতে বলেন, Control your mouth. রাগান্বিত তিনি হয়ত Watch your mouth ফ্রেইজটা ব্যবহার করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেলেছেন।

তারপর হঠাৎ অপেশাদারভাবে তুমি সম্বোধনে চলে যান ডিজি। কথা বলবার বাচনভঙ্গি যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই অপমানজনক হয়ে উঠে। এর জবাবে ডা. ধনদেব বর্মণ বহু দিনের চেপে রাখা ক্ষোভ ও অসহায়ত্ব থেকে বলে ফেলেন, 'আমাকে সাসপেন্ড করেন স্যার। আমি এই চাকরি আর করতে চাই না। অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে চলেছে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা!'

ধনদেব চন্দ্র বর্মণ ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট থেকে হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ সার্ভিসের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চলতি বছরের জুলাইয়ে তিনি আবাসিক সার্জন থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বাস্থ্যের ডিজি তাঁর সাথে তর্কে জড়ানোয় ওই চিকিৎসককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে শোকজ করেন।

এরপর আমরা ধনদেব চন্দ্র বর্মণের মুখে স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্দশার যে ফিরিস্তি শুনলাম -সেটি রীতিমতো ভয়াবহ। মিস্টার বর্মণের চাকরি আছে মাত্র একবছর অথচ এখনো তিনি পড়ে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক পদে। এমন নয় যে, এমএস ডিগ্রিধারী তাঁর কাম্য যোগ্যতা নেই। বস্তুত তিনি জায়গামতো অর্থ ব্যয় ও উপযুক্ত লোক ধরাধরি করতে পারেন নি বলে বন্ধুরা অধ্যাপক হলেও তাঁর কপালে সহযোগী অধ্যাপকের পদও জোটেনি। দেশের চিকিৎসাখাতে কোনো গবেষণা নেই এবং যেটুকু রিসার্চ নামের গবেষণাপত্র তৈরি হয় -সেটি নীলক্ষেত থেকে টুকলিফাই করা; এমন গুরুতর অভিযোগ করেছেন ডা. বর্মণ। এছাড়া কোনো প্রশিক্ষণ, উচ্চতর শিক্ষা, বদলি-পদায়ন -কোনোকিছুই ঘুষ ও তদবির ছাড়া হয় না বলে জানান তিনি। সরকারি ওষুধ জায়গামতো পৌঁছানোর আগেই চুরি হয়ে যায় বলেও তিনি অভিযোগ করেন। মোদ্দাকথা দেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো চিকিৎসা খাতও সিন্ডিকেটেড হয়ে উচ্ছন্নে গেছে।

আমরা মনে করি ডা. বর্মণের হেলথ ডিজির সাথে তর্কে জড়ানোর শোকজের জবাবের চেয়ে অধিকতর জরুরি হলো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তাঁর অভিযোগের জবাবদিহি আগে করা।

তর্কে জড়ানো যদি ডা. বর্মণের অপরাধ বলে গণ্য হয়, তার আগে প্রাধিকারের বাইরে গিয়ে অধস্তন কর্মীর সাথে অসদাচরণের জন্য সরকারি কর্মচারি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ বিধি ২(ছ) এর নিরিখে ডিজির নিজেকেই যাচাই করতে হবে। সরকারি কর্মচারী চাইলেই নিজের খেয়াল খুশিমতো কাজ করতে পারেন না। অফিসে কথা-বার্তা, হাঁটা-চলা, বসার মধ্যে পরিশীলতা ও সংযমবোধ বজায় না রেখে পারেন না।

হেলথের ডিজি যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ এবং শীর্ষ কর্মকর্তা। অপারেশন থিয়েটারের টেবিল নিয়ে সেখানকার ইনচার্জের সাথে কেন বচসায় জড়াবেন? চিকিৎসক তিনবার নিজের নাম বলবার পরও কেন তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন এবং ভুলভাল ইংরেজিতে চুপ থাকতে বলবেন? অপারেশন থিয়েটারে দলবল, ক্যামেরা, সাংবাদিক নিয়ে ঢুকে পড়বার প্রাধিকার কি ডিজির থাকা উচিত? Operating Room Security Protocols, OT Access Control, Infection Prevention and Control (IPC) and Viral Disease Management -এই মেডিকেল টার্মগুলো স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের বেশি জানা থাকার কথা, কিন্তু তিনি এসবের কোনোটারই তোয়াক্কা করেন নি। অথচ নিজের দায় ও কর্তব্য ভুলে যিনি চাকরিজীবনের পুরোটাই অবহেলার শিকার হয়েছেন, পিআরএল-এ যাওয়ার আগ মুহূর্তে পড়ে রয়েছেন সবার নিচের পদে -সেই মানুষটিকেই সর্বহারা করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এটিকে হীনমন্যতা, সংকীর্ণতা বা মানসিক দৈন্যতা ছাড়া -আর কোন শব্দ দিয়েই বা যুক্তিসঙ্গত প্রতিপন্ন করা যায়?

বাংলাদেশে বড় আধিকারিকরা নিজেদেরকে মনে করেন সর্বগুণে গুণান্বিত ভগবান, আর অধস্তন কর্মীদের মনে করেন দাসানুদাস চাকর। এ কারণেই এদেশের কর্মপরিবেশ সুশৃঙ্খল ও সুশোভন হয়ে উঠে না। আমজনতাও তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে যুগের পর যুগ বঞ্চিত হতে থাকে।

অনেক সংস্কারের কথা আমরা শুনলাম। শিষ্টাচার, আদব, রুচিবোধ, সংস্কৃতি, শ্রেয়বোধ অর্জন করবার শিক্ষা সংস্কার সবার আগে জরুরি। অন্যথায় কোথাও কেওয়াজ, ক্যাচাল ও বচসা রোধ করা যাবে না। সভ্যতার জমিনে আমাদের নামনিশানাও কখনোই অঙ্কিত হবে না।

লেখক: সাংবাদিক 
৭ ডিসেম্বর ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login