ক্যাম্পাস-প্রেম(পর্ব-৮)
হুমায়ূন কবীর
সে যা বলেছে তা অক্ষর অক্ষরে করেও ছাড়বে- অর্থের লোভে ক্ষমতার দাপটে। আমার বাপ এখানে কিছুই করতে পারবে না। তার সময় শেষ। সে অনেকদিন ধরে এই অঞ্চলে এককভাবে মাতব্বরি করে আসছে তার সততার জোরে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরাই তার শক্তি। সবার অবিচল বিশ্বাস, আমার বাপই একমাত্র ব্যক্তি, যে সঠিক কথা বলে। ফলে গ্রামের সমস্ত মানুষ শেষ পর্যন্ত তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
দিন বদলেছে । খারাপভাবে বদলেছে। দেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। দেশ আগে বারান্দায় পায়খানা করতো, এখন ঘরে বিছানায়।এই হলো বদল। এখন আর আমার আব্বার মতো সৎ সাহসী লোককে কেউ শালিস-বিচারে ডাকে না। এখন শালিস হয় টাকায়।শুয়োরের পালের মতো দল বেঁধে ঘোঁতঘোঁত করে বেড়ায় চাঁদাবাজ, দখলবাজের দল। সবকিছু শালিস- বিচার হয় দলীয়ভাবে।সত্যিকার যারা ত্যগি রাজপথের লড়াকু সৈনিক তারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।কারণ, যতো অন্যায় অপকর্ম হয় স্থানীয় এমপির ছত্রছায়ায়। আর এমপি মানে,এলাকার অঘোষিত ইশ্বর।তার কথা নিয়তির মতো।আর সে এই ঐশ্বরিক শক্তি পায় সেদিন, যেদিন সে অনেক টাকার বিনিময়ে নমিনেশন কিনে আনে।আর তার ঈশরত্ম ফাইনালি পাকাপোক্ত হয় অনেক অনেক টাকার বিনিময়ে যখন সে এমপি হয়ে যায়।এমপি মানে এলাকার সেই সব।পাঁচ বছরের জন্য সে তার এলাকার মানুষের জান মাল, মান ইজ্জত সব কিনে নেয়।এলাকার মানুষ হয়ে যায় তার ক্রীতদাস। অতএব ক্রীতদাসদের সাথে যাখুশি সব করা যায়।আর এমপির পিছন পিছন যারা রাতদিন কুকুরের মতো লেগে থাকে তারা গ্রামঘাটে আরও আরও কুকুর পোষে।এই কুকুরগুলো অধিকাংশই ননপলিটিক্যাল লোক।যেখানে এমপি নিজেই ননপলিটিক্যাল লোক। টাকার বিনিময়ে যে এমপি, সে কি পলটিক্যাল লোক সহ্য করবে? করবে না। রাজনীতি, এমপিত্ব তার কাছে একটা ব্যবসা।এইভাবে দিনিদিন রাজনীতি চলে যাচ্ছে অরাজনৈতিক লোকের হাতে, অসৎ লোকের হাতে।আমার বাপের মতো সৎ লোক এখন বড় অসহায়।
কী করা যায়?
কিছুতো একটা করতেই হবে। কিন্তু আমার দল তো ক্ষমতায় নেই। তাহলে কি এই অন্যায় পার পেয়ে যাবে? আমি সকাল সকাল দুটো খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার দলের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করলাম। যদিও রহিমের ফ্যামিলির বিষয কারো অজানা নয়। তবু বিস্তারিত সত্য জানা দরকার। ব্যাপারটা হচ্ছে, এই ডিপজল বাহিনীর এক সদস্য কামাল। তার বউ বাচ্চা সব আছে। সে কাজ কাম করে না। সারাদিন জুয়া খেলে, আর ডিপজল বাহিনীর সাথে ঘোরাঘুরি করে। বিভিন্ন চাঁদার থেকে সামান্য ভাগ বটোরা পায়, মঙ্গলগতি বাজার থেকে চাল ডাল বাকি নেয়। টাকা দেয় না। এভাবেই তার সংসার চলে। তার সাথে জলিলের বউয়ের গোপন অবৈধ সম্পর্ক। আর গোলমাল এর শুরু সেখান থেকে। এ নিয়ে বহুবার সালিশ হয়েছে। আমি নিজেও সেই সমস্ত সালিশ করেছি। কিন্তু ব্যাপারটা এর পূর্বে এত মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। ৫-৭ দিন পূর্বে জলিলের মা তখন এশার নামাজ পড়ছিল- এই সময়, জলিলের বউ কামাল কে নিয়ে ঘরে দরজা দেয়। নামাজের মাঝেও জলিলের মা ব্যাপারটা খেয়াল করে। সে তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করে ওদের ডেকে তোলে। এবং কামালকে তাড়িয়ে দেয়। সেই রাতেই প্রবাসী জলিলকে মোবাইলে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। এই হচ্ছে জলিলের মার অপরাধ। এখন জলিলের বউয়ের নামে সব সম্পত্তি লিখে দিতে হবে। আর লিখে দিলে কামাল জলিলের বউকে বিয়ে করবে। সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ পাবে ডিপজল। এই সত্যটা এই এলাকার কারো অজানা নয়। কিন্তু কারোর সাহস নেই ভয়াবহ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার। আমার দলের স্থানীয় নেতাদের নামে অনেক কেস আছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে যে কোন সময় আমার নামেও কেস হতে পারে। তবু আমরা পরপর দু'রাত এলাকার দলীয় লোকজন নিয়ে গোপন মিটিং করলাম। একটা জনমত তৈরি হলো। যদিও জনমত সব সময় ডিপজল বাহিনীর বিপক্ষে। কিন্তু তা মনে মনে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এই অন্যায় প্রতিহত করতেই হবে। কৌশল হিসেবে পরের দিন সন্ধ্যায় দলীয় মিটিং কল করা হলো। হাই কমান্ড বিষয়টির সাথে একমত পোষণ করলো। কি হবে বলা যায় না। খুন খারাপিও হয়ে যেতে পারে।কে মরবে কে বাঁচবে একমাত্র আল্লাহই জানে। জীবনের রিক্স ষোল আনা। এখানে জলিল বা জলিলের মা বিষয় না, আবার বিষয় । বিষয় হলো , ন্যায় আর অন্যায়।কিন্তু সামাজিক স্বার্থপর মানুষ যারা তারা সব কিছু দেখেও অমানুষের মতো চুপ করে থাকতে পারে । কিন্তু যারা রাজনীতি করে , রাজনীত সচেতন যারা তারা চুপ করে থাকতে পারে না। প্রতিবাদ তারাই করে। সবকিছু তারাই ঘাড়ে তুলে নেয়।ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য,অত্যাচারিত মানুষের দুর্ভোগ লাগবের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করে। অথচ দিনশেষে জানবাজ সংগ্রামীরাই পড়ে থাকে পিছনে। অবহেলার শিকার হয়। আর ধান্দাবাজ স্বার্থপর চুপ করে থাকা মানুষগুলো টাকার বিনিময়ে বড় বড় চেয়ারে বসে।ভাবতে ভাবতে বেলা গড়িয়ে যায়।
আসরের আযান শেষ হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আমাদের মিটিং শুরু হবে। আশেপাশের গ্রাম থেকে দু একজন করে নেতা কর্মি আসতে শুরু করেছে।
আমি বসে আছি কাজল বৈরাগীর ঘড়ি মেরামতের দোকানে।নিজের শার্টের নিচে চেক করলাম। হ্যাঁ আত্মরক্ষার অস্ত্রটি ঠিক আছে। রাস্তার ওপাশে পশ্চিম আকাশে সূর্য হলুদ রোদ ছড়াচ্ছে। তার তেজ কমে আসছে। বাতাসে কাঁকুড় গাছের পাতায় সাঁই সাঁই শব্দ হচ্ছে। বট গাছে শালিকের কিচির মিচির। মায়াময় একটি পরিবেশ। আমাদের গ্রামের হাটের এই দৃশ্য সত্যিই একটা ছবির মত। হাটের মাঝখানে একটা বিরাট বকুল গাছ, একটা পাকড় গাছ, বাজারের পশ্চিম পাশে খাল ভরা পানি। উত্তর পাশে চিত্রা নদী। নদীর ব্রিজ পার হয়ে বর্ধিষ্ণু বাজার দুপাশের গ্রামের বসতির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে ক্রমশঃ। শুক্রবার এখানে হাট বসে। এই ছবির মত সুন্দর সবুজ বাজারে দানবের ছায়া পড়েছে। আজ সেই দানবের বিরুদ্ধে আমাদের মোকাবেলা।
হাটুরে বেপারী, অস্থায়ী দোকানদার, স্থায়ী ব্যবসায়ী লোকজন কারো মনে শান্তি নেই। প্রত্যেককে চাঁদা দিতে হয়। তারপরও নিস্তার নেই। ডিপজল বাহিনী যখন যাকে খুশি মারধর করে। তার লোকজন বিনা পয়সায় বাজার করে। ভালো ভালো জিনিস ফ্রি নিয়ে যায়। ডিপজল প্রতিদিন পাঁচটি মোটরসাইকেলে লোক নিয়ে আসে। তাদের সবাইকে নিয়ে বাজারের হোটেলে নাস্তা করে। কোন টাকা দেয় না। টাকা চাওয়ার মত সাহসও কোন হোটেল ওয়ালার নেই। এরপর ডিপজল বাহিনী বের হয় বিভিন্ন গ্রামে। বিভিন্ন শালিশ, জমি দখল ইত্যাদি মিশনে। ন্যায় অন্যায় বলে কোন কথা নেই সব আসল ধান্দা টাকা। এলাকায় সে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। কারো মনে কোন শান্তি নেই।
আমাদের মিটিং হবে কিনা কোন ঠিক নেই। লোকজন উপস্থিতির হার খুব কম। আমি বসে বসে গান শুনছি। দলের কয়েকজন আঞ্চলিক নেতা রাস্তার ঐপাশে কানে কানে শলাপরামর্শ চালাচ্ছে। কাজল বৈরাগীর ঘড়ি মেরামতের দোকানে গান হচ্ছে, তোমার পত্র এসে পৌছলো যখন, রাতের আমন্ত্রিত আমি অতিথি। শুভ হোক, শুভ হোক।শুভ হোক তোমার জীবন সাথী। শুভ হোক শুভ হোক।
আমার অন্তর কেঁপে উঠলো। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি,রাশমিনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত অতিথি। অনুষ্ঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, যন্ত্রণা বিদগ্ধ বুক চিরে , গলা উপচে বেরিয়ে আসছে এই গানের ধ্বনি। আমি যেন পাগলের মত চিৎকার করে গাইছি এই গান। রাসমিন লাল শাড়িতে, আধো ঘোমটার ফাঁকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আমাকে। তার সমস্ত শরীর স্বর্ণের অলংকারী ঝলমল করছে। আগুনের মতো রূপ তার সোনার মত জ্বলজ্বল করছে।
বুঝলাম, রাশমিন আমার মনের চেতনে,অবচেতনে - সমস্ত খানে দাপটে বেড়াচ্ছে।তাকে পাওয়ার চেষ্টাও বৃথা ভোলার চেষ্টাও বৃথা। আবার না ভুললেও জীবন হবে সর্বনাশা। কারন, আমি তাকে কখনোই পাব না। কেননা, যখনই সে আমার রাজনৈতিক পূর্ণ পরিচয় পাবে, তখনই সে এক ঝটকায় দশ হাত পিছিয়ে কথা বলবে। এটাই দেখে আসছি। সে সরে যাবে। আর আমি তার জন্য সারা জীবন অপেক্ষায় থাকবো।কেঁদে কেটে বুক ভাসাবো। ডিপজলের সাথে আমাদের এই যুদ্ধ হয়তো শেষ হবে, কিন্তু প্রেম বনাম রাজনীতি, এই যুদ্ধ হয়তো কখনোই শেষ হবে না। অথচ রাজনীতি ছাড়া প্রেম নেই, প্রেম ছাড়া রাজনীতিও নেই। ফিলিস্তিনের গাজার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সেখানকার মানুষের রাজনীতি ছাড়া কোন উপায় নেই। রাজনীতি মানে কিন্তু যুদ্ধ। সেখানকার পরাধীন মানুষের জীবনে আনন্দ আহ্লাদ, প্রেম ভালোবাসা বলে কিছু কি আছে ? যতদিন না ওই জনপদ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হচ্ছে ততদিন তাদের মনে সত্যিকারের প্রেম ভালোবাসা, আনন্দ আহ্লাদ বলে কিছু জন্মাবে না।আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য যারা লড়ছে তারাই রাজনীতিক তারাই যোদ্ধা।অথচ দিন শেষে স্বার্থপর শান্তি প্রিয় চুপচাপ ঘাপটি মেরে থাকা লোকগুলো রাজনীতিকদেরই ঘৃণা করে।
সবাই যখন ঘৃণা করে। হয়তো রাশমিনও করে।আজ হোক কাল হোক আমার এই পরিচয় তার সামনে উন্মোচিত হবে। সে না হয় হবে। কিন্তু এখন তো ভীষণভাবে মনে পড়ছে তাকে। এইতো জামার পকেটে ছোট্ট নোট বকে, তার মোবাইল এবং টেলিফোন নাম্বার দুটোই আছে।
কল করব?
কল করে কি বলবো?
এখনো তো ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়নি।তাহলে কিভাবে কথা শুরু করা যায়?
এত কিছু ভেবে কিছু করা যায় না। যাহোক একটা কিছু বলা যাবে। আগে শুরু তো করি। বিসমিল্লাহ বলে বুকে সাহস সঞ্চয় করে মোবাইলে নাম্বার ঢুকিয়ে দিলাম।
ওপাশের মোবাইলে রিং হচ্ছে । আমার বুকের ভিতরে হার্টবিট দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। শরীর দিয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
কে যেন পিছন থেকে ধাক্কা লাগালো।বলল, পালাও।ডিপজল বাহিনী এসে গেছে।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, একেবারে রণসজ্জা। সাজোয়া বাহিনী।
মাইক্রো,প্রাইভেট, পিকআপ, মোটরসাইকেল। বাজারের উপরে সমস্ত পাকা রাস্তা তারা দখল করে বসে আছে মুহূর্তে। বিশাল এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ তারা তৈরি করে ফেলেছে। ধারালো অস্ত্র। অস্ত্র উঁচিয়ে উচিয়ে এককেজন লাফিয়ে লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামছে। কারো হাতে পেট্রোলের ঢম।পেট্রোলের আগুন দিয়ে সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। ভয়ে আমার গলা বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ঝেড়ে দৌড় লাগালাম। বাজারের ভিতরে আশ্রয় নিলাম। পিছনে এখন হুড়মুড় করে দোকানপাট বন্ধ হওয়ার শব্দ ভেসে আসছে।