ক্যাম্পাস প্রেম(পর্ব ৯)
হুমায়ূন কবীর
মানুষ যে যেদিকে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। সবাই বুঝে ফেলেছে, আজ ভয়াবহ কিছু একটা হবে।
দৌড়ে এসে এক দোকানের পেছনে গলির ভেতর নিজেকে লুকালাম। দেখি , এখানে আমাদের আরো দু চারজন ইতিমধ্যে লুকিয়েছে। এখানে আমাদের তরুণ যুব নেতা রফিক রয়েছে। সে খুব লাফালাফি করছে। বলছে,চল যায় ধরি। এখনি গ্রাম থেকে লোকজন এসে যাবে।
শেষে তার সাহস দেখে বা দুঃসাহস দেখে আমরা কিভাবে জানি ঢোক চিপতে চিপতে অনুপ্রাণিত হলাম। আমি আজও ভেবে অবাক হয়ে যাই, কিভাবে ওই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম? আসলেই নেতৃত্ব যে কি তা ওই তরুণ নেতাকে দেখেই জেনেছি। আমরা ৪-৫ জন ঘুরে দাঁড়ালাম। রাস্তার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি, তখনও আমরা খালি হাতে। আমাদের প্রতিপক্ষ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। অথচ আমরা শুধু বুকে অদম্য সাহস নিয়ে কী করতে যাচ্ছি এক দানবের বিরুদ্ধে? রাস্তার কাছাকাছি পৌঁছে আমাদের হুশ হল। আমরা তো একদম খালি হাত। কি এক মহা ভুল করতে যাচ্ছি।
যুবনেতা রফিক আবারো বলল, ওরে লাঠি ধর।
কিন্তু লাঠি কোথায়? কোথাও একটা খড়কুটো খুঁজে পাচ্ছি না। শেষে এক মোটা কলার কাঁদি বাগিয়ে ধরল রফিক।সে কাদির শরীর থেকে ব্যাপারী কলা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে বিক্রি করে শেষে ন্যাংটো করে ফেলে রেখে গেছে। সেই কলাহীন কাঁদিটি এমনভাবে ধরেছে, মনে হচ্ছে- এমন কিছু একটা দখল করে বসেছে এর এক আঘাতে পুরো ডিপজল বাহিনী উড়ে যাবে।সে আবার তাগাদা দিতে লাগলো, ওরে লাঠি ধর।
আমরা দু একজন কঞ্চির মত শুকনো দু একটা দুর্বল বটের ডাল কুড়িয়ে পেলাম। এবার তাই নিয়েই মোকাবেলা করতে যাচ্ছি। দুই দোকানের ফাক দিয়ে তাকিয়ে দেখি, আমাদের দলের হাসেম ভাই ডিপজলের হাতে ধরা পড়েছে। ডিপজল তার কলার ধরে বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিচ্ছে, আর লাথি চড় কিল সমানে চালিয়ে যাচ্ছে।একজন লম্বা কালো লোক হাসেম ভাইকে বারবার গুলি করতে যাচ্ছে কিন্তু ডিপজল তাকে বারবার বাধা দিচ্ছে। কারণ হাশেম ভাই ডিপজলের সম্পর্কে চাচাতো শালা। তাই তাকে প্রাণে মারতে চাচ্ছে না। কিন্তু আমরা তো তার ওই জাতীয় কোন আত্মীয় না। আমাদের কাউকে ধরতে পারলে ঠিকই গুলি করে দেবে। অবস্থা দেখে কলার কাদিটাদি বিসর্জন দিয়ে যে যেদিকে পারলাম, দৌড় লাগালাম। এবার বাজার টাজার নয় একেবারে জঙ্গল। প্রবীণ নেতা মিলন বিশ্বাস আমাকে বলল, ওরে গ্রামে যেয়েপড়ে লোক ডেকে আন।
আমি গ্রামে এসে যাকেই বলি, ডিপজল বাহিনী বাজারে লোকজন মারছে- চলো।
সবাই আমাকে বলে, মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার? ঘরে বসে থাকো।
আমি দিশেহারা হয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছি। হঠাৎ দেখতে পেলাম, অল্প বয়স্ক ছেলে পুলে খেলা করছে। তাদের কাছে যেয়ে বললাম, এই তোরা খেলা করছিস? মারামারি দেখবি? চল বাজারে মারামারি বেঁধেছে।
যেই না বলা অমনি ছেলেপুলে মারামারি দেখতে যাওয়ার আনন্দে হাত তালি দিয়ে হল্লা করে উঠলো। আমি বললাম, ধর।
ওরা দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বলল, ধর।
আমরা দৌড়াচ্ছি আর চিৎকার করছি, ধর ধর ধর।
পথে আরো কিছু লোক আমাদের সাথে যোগ দিলো। সবাই দৌড়াচ্ছি আর চিৎকার করছি ধর ধর ধর।
চিৎকার যারা করছে তারা কেউ জানে না কাকে ধরতে তারা চিৎকার করছে। আমি বলছি ধর। সবাই বলছে ধর । এই হল লিড। এই হলো নেতৃত্ব। সবকিছু সব সময় সাজানো গোছানো পাওয়া যায় না। এলোমেলো বিশৃঙ্খলা পরিবেশের ভিতর থেকেই নেতৃত্বের সুশৃংখল সূত্রটি আবিষ্কার করে নিতে হয়।
নদীর ওপারের গ্রাম থেকেও আমাদের চিৎকার শুনে লোকে ধর ধর বলে চিৎকার করছে। খালের ওপার থেকেও একই অবস্থা। শেষে ডিপজল বাহিনীর লোকজন দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাতে লাগলো। আমরা তাদের যানবাহনগুলোর উপর আক্রমণ করলাম। গাড়িতে ড্রাইভার ছিল, সাথে সাথে তারা গাড়িগুলো নিয়ে সরে পড়লো। ডিপজলের লোকজন সব পালিয়ে গেছে। বাজারে এখন ডিপজল একা। শুরু হলো গণপিটুনি। এলাকার বহু লোকের ক্ষোভ ছিল তার ওপর। গণপিটুনির চোটে তার মাথা ফাতা ফেটে গেল। তার দলের লোকের অনেকের হাত পা ভাঙ্গা পড়ল। পতন। আহ! কি মহা পতন। ডিপজল স্বপ্নেও ভাবেনি তার এই মহাপতন হতে পারে। এতবড় যে মহাপ্রতাপশালী শেষে তাকে বোন বাদাড় দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে হাসপাতাল যেতে হয়েছিল।
কিন্তু এরপরই এলাকার লোকের উপর নেমে এলো গজব। সন্ধ্যা হতে না হতে ট্রাক ভর্তি করে ডিপজলের লোকজন আসতে লাগলো। ছোট্ট মঙ্গলগাতি বাজার লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল।পুলিশ এলো, তার ভেতর ডিপজলের দলের লোক ফাঁকা গুলি ছুড়ে মিছিল শুরু করল, সন্ত্রাসীরে কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও।
তারমানে তারা আমাদেরকে সন্ত্রাসী বলে স্লোগান দিচ্ছে। অথচ ডিপজলের লোকজনই তো প্রকৃত সন্ত্রাসী।
মিছিলে আশেপাশের গ্রামের লোকজন এসে যোগ দিচ্ছে। ওরা ডিপজলের দলের সমর্থক। মিছিলের ভেতর থেকে বাজারে বোমা ছুড়ে মারা হচ্ছে। বোমার আওয়াজে ছোট্ট বাজারটি এবং আশেপাশে গ্রাম কেপে কেঁপে উঠছে। মিছিল শেষে তারা আশেপাশের গ্রামের ৫০ /৬০ টি বাড়ি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিল। পুলিশ তাদের পাহারা দিল। পুলিশ তো কলের পুতুল কারণ ডিপজলের দল ক্ষমতায়। পুলিশের কিছু করার নেই।
আমরা নদীর ধারে নাসির মন্ডলের বাগানের ভেতর লুকিয়ে থেকে অসহায়ের মত সব চুপচাপ দেখলাম। আশেপাশের গ্রাম থেকে আগুনের ধোয়ায় তখন আকাশ বাতাস একাকার। আর চিৎকার চেঁচামেচি, গুলির আওয়াজ,বোম এর বিকট শব্দে পুরো এলাকা তখন রণক্ষেত্র।
রাত যত গভীর হলো পরিবেশ ততো শান্ত হলো। রাত প্রায় তিনটার দিকে আমরা ২০-২৫ জন জঙ্গল থেকে বের হয়ে নদীর ধারে মিটিং করে, সবাইকে গ্রামে অবস্থান করার জন্য বলে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা চিহ্নিত চার-পাঁচজন গ্রাম ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু তখন ক্ষুধায় পেটের এত খারাপ অবস্থা যে এক পাও এগুতে কষ্ট হচ্ছে। শেষে সাব্বির মুন্সির বাড়িতে এসে হাজির হলাম। সাব্বির মুন্সি আমাদের দলের লোক এবং ইউপি মেম্বার। তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। দলের প্রতি তার প্রচন্ড ভালবাসা আছে। সাব্বির মুন্সির বাড়ির লোকজন আমাদের পেয়ে যেন হাতে ঈদের চাঁদ পেল। সেখানে যেন বিপ্লবের জোয়ার বয়ে গেল। এবাড়িতেও একটি ঘর পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু সেটি এদের কাছে এখন কোন বিষয়ই না। আমরা বেঁচে আছি ভালো আছি সেজন্যই তারা মহা খুশি। তারা রাতেই মুরগি জবাই করে আমাদের খেতে দিতে চাইলো। আমরা বললাম, সময় নেই। রাত থাকতে থাকতেই এলাকা ছাড়তে হবে।
অগত্য পান্তা ভাত আর ডাল খেয়ে বিদায় হলাম। ডিপজল বাহিনী আমার বাড়িতেও চড়া হয়েছিল। ঘরে পেট্রোল ও ঢেলেছিলো। কিন্তু আগুন লাগাতে সাহস পায়নি। কারণ ডিপজলের দলে আমাদের এক আত্মীয় বড় মাপের নেতা। শেষমেষ তারা কিছু গালিগালাজ করে ফিরে গেল। সুখের কথা হল তারপর থেকে ডিপজল বাহিনীর অত্যাচার বন্ধ হয়ে গেল। মার খেয়ে ডিপজলের চৈতন্য উদয় হল। আসলে মাইরের উপর কোন ওষুধ নাই। মাইরের শিক্ষা স্থায়ী হয়।
কিন্তু যে জলিলের মাকে উপলক্ষ করে এত কিছু করলাম তাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।কোথায় গেল জলিলের মা?
দুইদিন পরের ঘটনা। পেপারে নিজের নাম দেখে চমকে উঠলাম। সেদিনের সেই ঘটনা নিউজ হয়ে গেছে। আর সেখানে সন্ত্রাসী হিসেবে আমার নাম লেখা হয়েছে। ডিপজলরা যেহেতু সরকারি দলের লোক, তাদের নাম দলীয় নেতাকর্মী হিসেবে দেখানো হয়েছে। সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করে শেষমেষে আমরাই সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছি।অবশ্য তাতে সমস্যা নেই। আমি যে হলে থাকি এখানে সবাই আমার দলের লোক।
সেদিন রাতে শরীরের উপর দিয়ে খুব ধকল গেছে। সকালে ঘুম ভেঙেছে সাড়ে নয়টায়। শরীর ব্যথা ব্যাথা হয়ে আছে। সেদিন রাতে কমসেকম দশমাইল হাঁটতে হয়েছে। সারারাত নির্ঘুম। দিনের বেলায় এমপি সাহেবের সাথে দেখা করে সোজা হোস্টেলে। তারপর থেকে ঘুম আর ঘুম। ঘুম আর কিছুতেই ছুটতে চায় না। এদিকে প্রচন্ড ক্ষুধাও লেগেছে। শরীর খুব দুর্বল। কোনোমতে ঘুম থেকে জেগে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট খেয়ে শরীর আরো দুর্বল হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি গামছা লুঙ্গি নিয়ে নিচে নেমে এলাম।
ঘুম ভাঙতে দেরি হলে কি হবে এরমধ্যেই কলেজ ক্যাম্পাস জমজমাট হয়ে উঠেছে। অবশ্য তখনও রোদ্রে ঘাসের উপরকার শিশির ঠিকমতো শুকায়নি। সেই ভিজে ভিজে ঘাসের উপরেই রোমিও জুলিয়েটরা জোড়ায় জোড়ায় বসে গেছে। একটা জুটি আমাদের হোস্টেলের সামনে পুকুরের পানির উপরে গাছের শেকড়ে বসে বাদাম চিবুচ্ছে। গাছটা অনেকদিন ধরেই পুকুরের দিকে ঝুঁকে আছে। পড়েও পড়ে না। তার অনেকগুলি শেকড় পানির উপর ঝুঁকে আছে। শেকড়গুলি জুলিয়েটদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। আমি দাঁত ব্রাশ করতে করতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি। আজ এতগুলি বছর এই ক্যাম্পাসে। সেই ইন্টারমিডিয়েট থেকে শুরু করে কতগুলো বছর পার করলাম। তবু আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে নিয়ে এই ক্যাম্পাসের নরম ঘাসে বসতে পারলাম না। জানিনা কেন? হয়তো আমার চেহারাটা খুব খারাপ। মেয়েরা পছন্দ করে না।