Posts

গল্প

পরিনীতা -নবম পরিচ্ছেদ

December 12, 2025

Rezwana Roji

Original Author শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

Translated by রেজওয়ানা প্রধান

12
View

সে রাত্রে বহুক্ষণ পর্যন্ত শেখর বিহবলের মত পথে পথে ঘুরিয়া ঘরে ফিরিয়া আসিয়া ভাবিতেছিল সেদিনকার এক ফোটা ললিতা এত কথা শিখিলো কিরূপে? এমন নির্লজ্জ তাহার মুখের উপর কথা কহিল কি করিয়া?

আজ সে ললিতার ব্যবহারে সত্যই অত্যন্ত বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হইয়াছিল। 

কিন্তু এই ক্রোধের যথার্থ হেতুটা কি এ যদি শান্ত হইয়া ভাবিয়া দেখিতো, দেখিতে পাইতো রাগ ললিতার উপরে নহে তাহা সম্পূর্ণ নিজের উপরেই।

ললিতা কে ছারিয়া এই কয়টা মাসে প্রবাস বাসকালে সে নিজের কল্পনায় নিজেকে আবদ্ধ করিয়া শুধু কাল্পনিক সুখ-দুঃখ লাভ ক্ষতি খতাইয়া দেখিতো । কিন্তু ললিতা আজ যে তাহার জীবনের কতখানি, ভবিষ্যতের সহিত কিরূপ বন্ধনে গ্রথিত তাহার অবর্তমানে বাঁচিয়া থাকা কত কঠিন কত দুঃখকর বিছানায় শুইয়া এই কথাই সে বারবার আলোচনা করিতে লাগিল।

ললিতা শিশুকাল হইতে নিজেদের সংসারে মেশিয়া ছিল বলিয়াই তাহাকে বিশেষ করিয়া আর সে সংসারের ভিতরে বাপ- মা ভাই বোনের মাঝখানে নামাইয়া আনিয়া দেখে নাই, দেখিবার সম্মতি দিবেন না। হয়তো সে অপর কাহারো হইবে দুশ্চিন্তা তাহার বারবার এই ধার বহিয়ায় চলিয়াছিল তাই বিদেশ যাইবার পূর্বের রাত্রে জোর করিয়া গলায় মালা পরাইয়া দিয়া সে এইদিকের ভাঙ্গনটার মুখেই বাঁধিয়া দিয়াছিল।

প্রবাসে থাকিয়া গুরুচরণের ধর্মমত পরিবর্তনের সংবাদ পাইয়া শুনিয়া, সে ব্যাকুল হইয়া অহর্নিশি এই চিন্তায় করিয়া ছিল পাছে ললিতাকে হারাইতে হয় ।সুখের হোক দুঃখের হোক ভাবনার এই দিকটাই তাহার পরিচিত ছিল । এই দিক বন্ধ করিয়ে দিয়া ভাবনার ধারা একেবারে উল্টা স্রোতে বহাইয়া দিয়া গেল তখন চিন্তা ছিল পাচ্ছে না পাওয়া যায় ,এখন ভাবনা হইলো পাছে না ছাড়া যায়।

শ্যামবাজারের সমন্ধ টা ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল । তাহারাও অত টাকা দিতে শেষ পর্যন্ত পিছাইয়া দাঁড়াইলেন । শেখরের জননীর ও মেয়েটি মনপুত হইল না। সুতরাং এই দায় হইতে শেখর আপাতত অব্যাহতি লাভ করিয়াছিল, বটে কিন্তু নবীন রায় দশ - বিশ হাজারের কথা বিস্তৃত হন নাই এবং সে পক্ষে নিশ্চেষ্ট হইয়াও ছিলেন না।

শেখর ভাবিতেছিল কি করা যায় সেই রাত্রি সেই কাজটা যে এত বড় গুরুতর হইয়া উঠিবে ললিতা যে এমন অসংশয়ে বিশ্বাস করিয়া লইবে তাহার সত্যিই বিবাহ হইয়া গিয়াছে এবং ধর্ম তো কোন কারণেই ইহার আর অন্যথা হইতে পারে না, সেদিন এত কথা শেখর ভাবিয়া দেখে নাই। যদিও নিজের মুখেই উচ্চারণ করিয়া ছিল যা হইবার হইয়াছে, এখন তুমিও ফিরাইতে পারো না, আমিও না। কিন্তু তখন আজ যেমন করিয়া সে সমস্তটা ভাবিয়া দেখিতেছে তেমন করিয়া ভাবিয়া দেখিবার শক্তিও ছিল না বোধকরি অবসর ও ছিল না।

তখন মাথার উপর চাঁদ উঠেছিল জোৎস্নায় চারিদিক ভাসিয়ে গিয়েছিল, গলায় মালা দুলিয়াছিল, প্রিয়তমার বক্ষ-স্পন্দন নিজের বুক পাতিয়া প্রথম অনুভবের মোহ ছিল এবং প্রণয়ীরা যাহাকে অধর সুধা বলিয়াছেন তাহাই পান করার অতি তীব্র নেশা ছিল । তখন স্বার্থ এবং সংসারিক ভালো-মন্দ মনে পড়ে নাই, অর্থ লোলুপ পিতার রুদ্র মূর্তি চোখের উপর জাগিয়া উঠে নাই। ভাবিয়াছিল মা তো ললিতা কে স্নেহ করেন তখন তাহাকে সম্মত করা নো কঠিন হইবে না এবং দাদাকে দিয়া পিতাকে কোনমতে কোমল করিয়া নিতে পারিলে শেষ পর্যন্ত হয়তো কাজটা হয়েই যাইবে । তাছাড়া গুরুচরণ এইভাবে তখন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহাদের আসার পথটা পাথর দিয়ে এমন ভাবে আটিয়া বন্ধ করেন নাই ।এখন যে বিধাতা পুরুষ নিজে মুখ ফিরাইয়া বসিয়াছেন।

বস্তু তো শেখরের চিন্তা করিবার বিষয় বিশেষ কিছু ছিল না ।সে নিশ্চয়ই বুঝিতে ছিল পিতা কে সম্মত করানো তো ঢের দূরের কথা জননীকে সম্মত করানো সম্ভব নহে, একথা যে আর মুখে আনিবারও পথ নাই।


 

শেখর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া আর একবার অস্ফুটে আবৃত করিল কি করা যায়। 

সে ললিতাকে বেশ চিনিত , তাকে নিজের হাতে মানুষ করিয়াছে একবার যাহা সে নিজের ধর্ম বলিয়া বুঝিয়াছে কোনমতেই তাহাকে ত্যাগ করিবে না ।সে জানিয়াছে সে শেখরের ধর্ম পত্নি তাই আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে অসংকোচে বুকের কাছে আসিয়া মুখের কাছে মুখ তুলিয়া অমন করিয়া দাঁড়াইতে পারিয়াছিল।


 

গিরিনের সহিত তাহার বিবাহের কথাবার্তা শুরু হইয়াছে। কিন্তু কেহ তাহাকে তো সম্মত করাইতে পারিবে না ,আর তো সে কোনমতে চুপ করিয়া থাকিবে না, এখন সমস্ত প্রকাশ করিয়া দিবে, শেখরের চোখ মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল সত্যই তো !সে ত শুধু মালাবদল করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই তাহাকে বুকের উপর টানিয়া লইয়া তাহার মুখচুম্বন করিয়াছিল ।ললিতা বাধা দেয় নাই দোষ নাই বলিয়াই দেয় নাই , ইহাতে তাহার অধিকার আছে বলিয়াই দেয় নাই ,এখন এই ব্যবহারের জবাব সে কার কাছে দিবে ?

 পিতা-মাতার অমতে ললিতার সহিত বিবাহ হইতে পারে না ,তাহা নিশ্চয়ই, কিন্তু গিরিনের সহিত ললিতার বিবাহ না হইবার হেতু প্রকাশ পাইবার পর ঘরে বাহিরে সে মুখ দেখাবে কি করিয়া?

Comments

    Please login to post comment. Login