দীর্ঘদিন রাজনৈতিক সহাবস্থানে থাকা বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দৃশ্যমান দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এটি আদর্শিক ভিন্নতা নাকি কৌশলগত রাজনীতি সেটি পরিস্কার বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। কারণ আ.লীগবিহীন রাজনৈতিক মাঠে মতদ্বৈততা বা বিরোধিতা না থাকলে গণতন্ত্র ঠিক জমবে না।
এ বিষয়ে দিল্লির বাংলাদেশ হাই কমিশনে নিযুক্ত প্রেস মিনিস্টার ফয়সাল মাহমুদের লেখা 'Bangladesh’s BNP seeks Hasina’s liberal mantle before elections' -শিরোনামে আজকে আল জাজিরায় একটি অ্যানালিসিস ছাপা হয়েছে।
বিশ্লেষণের শিরোনাম ও উপসংহারে লেখক বলেছেন, নির্বাচনের আগে হাসিনার ‘উদার’ রাজনৈতিক উত্তরাধিকার দখল করতে চাইছে বাংলাদেশের বিএনপি। তবে এই রূপান্তর ঝুঁকিমুক্ত নয়। এটি আদর্শগত নাকি কেবল নির্বাচনী কৌশল -সে বিষয়ে জনসাধারণের সংশয় কাটাতে হবে বিএনপিকে। দলের ভেতরেও উদার পরিচয়ের দিকে এই ঝোঁক নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে।
দলটি আর কেবল মধ্য-ডানপন্থী শক্তি হিসেবে আ.লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চাইছে না; বরং একটি বিস্তৃত গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মে রূপ নিতে চাচ্ছে -যেখানে সাবেক আ.লীগ সমর্থক, শহুরে উদারপন্থী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন তরুণরা নতুন ঠিকানা খুঁজে পেতে পারে।
লেখক বলেছেন, একটি বিষয় এখনই স্পষ্ট: ২০২৫ সালের বিএনপি আর আগের দশকের বিএনপি নয়। তাদের নেতারা এখন নতুন ভাষায় কথা বলছেন—অন্তর্ভুক্তিমূলক, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারভিত্তিক।
অ্যানালিসিসের শেষ লাইনগুলোতে এসে ফয়সাল মাহমুদ লিখেছেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং একসময় আওয়ামী লীগের দখলে থাকা আদর্শিক জমিতে পা রেখে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র নতুন করে আঁকছে। এই রূপান্তর যদি স্থায়ী হয়, তবে এটি হতে পারে ১৯৯০-এর দশকের শুরু পর দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পুনর্বিন্যাস—যেখানে একসময়কার মধ্য-ডানপন্থী দলটি হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান ধারক হয়ে উঠতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটের প্রশ্নে কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয় বিএনপি -এমনটা তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের বয়ান থেকেই অনুধাবন করা গেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ধর্মকে ভোটের স্বার্থে ব্যবহার না করবার দাবি জানিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন, জামায়াত একাত্তরে কী কী করেছে তা সবাইকে মনে রাখতে। এমনকি কোনো কোনো নেতা আরো এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ২৪ এর হত্যাযজ্ঞের জন্য আ.লীগের বিচার করা গেলে একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতের বিচারও জারি রাখা জরুরি। গত মাসে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একই সুরে কথা বলেন। তিনি “ধর্মের নামে দেশকে বিভক্ত করা” থেকে সতর্ক করেন এবং বলেন, বিএনপির রাজনীতি হওয়া উচিত জাতীয় ঐক্য, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ১৯৭১-এর চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
আল জাজিরার অ্যানালিসিস বলছে, বিএনপি ও জামায়াত দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিল মূলত আওয়ামী লীগের বিরোধিতার কারণে। তবে তাদের আদর্শগত পার্থক্য কখনোই গোপন ছিল না: বিএনপি ছিল জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার, আর জামায়াতের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইসলামী পরিচয়।
এখন সেই পার্থক্যই রূপ নিয়েছে পূর্ণাঙ্গ বিচ্ছেদে। ২০০১ থেকে ২০০৬—হাসিনাবিহীন সর্বশেষ নির্বাচিত সরকারের সময়ে—এই দুই দল একসঙ্গে ক্ষমতায় ছিল।
আল জাজিরা বলছে, বিএনপির সাম্প্রতিক বক্তব্যে ইঙ্গিত মিলছে, দলটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সেই নৈতিক ভাষাভাণ্ডার দখল করতে চাইছে, যা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে—অনেক সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতার পরপরই তিনি ১৯৭৫ সালে একদলীয় ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করে দেশকে কর্তৃত্ববাদের দিকে ঠেলে দেন। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সেই উত্তরাধিকারই এগিয়ে নেন। তিনি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেন এবং হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন—যাদের মধ্যে ছিলেন দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
বিএনপি আ.লীগের ফেলে যাওয়া ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ ধরতে চাইছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জোড়ালোভাবে সমুন্নত রাখতে চাইছে এর কারণ কী? দলটি ধরে নিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আ.লীগ নেতারা ভারতে নির্বাসনে গেলেও তাদের বিপুলসংখ্যক অনুসারী ও ভোটার দেশেই রয়েছে। এই ভূমিতে চাষবাস, চাকরিবাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাও করছে। তাহলে ওই ভোটারদের মন ছুঁতে চাইলে তাদের মতামতকে অসম্মান করবার জো নেই।
অপরদিকে জামায়াত কী করছে? আমরা মনে করি ঔদার্য চর্চায় রীতিমতো তারাও বিএনপির সাথে পাল্লা দিতে চাইছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তাদের দলের নিজস্ব গঠনতন্ত্রের বাইরে এসে ধর্মীয় শাসনের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বেশি উল্লেখ করছে। এমনকি ৮৩ বছরের ইতিহাস ব্রেক করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনায় হিন্দু প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে তারা। গেল দুর্গাপূজায় বিপুলসংখ্যক জামায়াত নেতা মণ্ডপগুলো পরিদর্শনে গিয়ে পূজারিদেরকে নির্বিঘ্ন পূজা উদযাপনে আশ্বস্ত করেছে। নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অপরাপর গণতান্ত্রিক দলের মতো মিউজিক সহযোগে গান বাজাচ্ছে। নিজেদের দলীয় লোগোতে ধর্মীয় চিহ্ন থাকা বা না থাকা নিয়েও নিরীক্ষা চালাচ্ছে দলটি।
জামায়াত ঘরাণার অ্যানালিটিকরা মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক বললেও দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে না, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে খাঁটো করে না। বরং ৪৭ থেকে ২৪ পর্যন্ত অতীতের সমস্ত ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা ও দুঃখপ্রকাশ করেছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান।
এমন এক বাস্তবতায় দেশের অধিকাংশ ভোটারেরা কোনদিকে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করবেন? এটি আগবাড়িয়ে বলা যায় না। তবে সম্প্রতি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর জরিপে জানানো হয়েছে এই মুহূর্তে দেশের ৬৫.৯ ভাগ মানুষ বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। অপরদিকে ২৫.৯ ভাগ জনমত জামায়াতের পক্ষে আছে। ব্যবধানটা বিস্তর হলেও -দুই দলই আশা প্রকাশ করছে ক্ষমতায় তারাই যাবে।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো জামায়াতও মাঠের বয়ানে বলছে তারা ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার গঠন করবে। অপরদিকে বিএনপির মাঠপর্যায়ের বয়ানও অনুরূপ। সবাই যদি জাতীয় সরকারের পথেই হাঁটে -তাহলে নির্বাচনের জরুরত কতটা এই প্রশ্নও আসে। হয়ত প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে কে এগিয়ে থাকবেন -এই ফয়সালাই বহুব্যয়ের নির্বাচনটার আসল জরুরত।
তবে আশার কথা এটাই দুই বড় দল ধর্মীয় কিংবা জাতীয়তাবাদী উগ্রতা বা কট্টরপন্থাকে নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে রাখতে চাইছে। যদিও জামায়াতের এই সময়ের কৌশলগত মিত্র ধর্মভিত্তিক ৭ দল পারলে এখনই গণতন্ত্র সমূলে উৎপাটন করে শরিয়া শাসন জারি করে ফেলে। কিন্তু তাদের আশার প্রতিফলন কতটা বাস্তবায়িত হবে সেটি দেখতে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিএনপি এখন যে পথে হাঁটছে -জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তাদের সেই বহুত্ববাদী উদারনৈতিক পথটা কন্টকিত করা অত সহজ নাও হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক
১৩ ডিসেম্বর ২০২৫