একটা ঘটনা আজকে মনে দাগ কাটলো খুব। এমনিতে ইদানিং তো আর কোনো কিছু তেমন দাগটাগ কাটে না মনে। দিন দিন কেমন রোবটিক হইয়া গেছি৷ কিন্তু আজকে মনে হইলো যে- দাগ কাটার মতো মনের অবস্থা এখনও আছে।
ঘটনাটা ঘটলো একটা সরকারি অফিসে৷ এমনিতে সরকারি অফিস ফেইস করতে সব সময় একটা অস্বস্তির মধ্যে থাকি। প্রতিমাসে রাজস্ব বোর্ডের সার্কেল অফিসে ভ্যাটের দাখিলপত্র জমা দিতে হয়। যাদের পার্সোনাল BIN (business Identification number) আছে তাদের জানার কথা, এই BIN রেজিস্ট্রেশান থেকে শুরু করে, প্রত্যেক মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে আগের মাসের ভ্যাট কার্যক্রমের দাখিলপত্র জমা দেওয়া কী বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা! তো, আমি যে সার্কেলে এই কাগজপত্র জমা দেই সেখানে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই প্রায়শই। একমাসে যার কাছে জমা দেই পরের মাসে গিয়ে দেখি সে ট্র্যান্সফার হয়ে চলে গেছে। ফলে ওই ব্যক্তিকে আবার নতুন করে বোঝাইতে হয় আমার পেশার ধরণ, এবং কেন আমি ‘চাকরি’ কইরাও ভ্যাট দিতাছি।
তাদের বোঝাইতে হয় যে- আমার ‘কাজ’কে সংস্থা নলেজ প্রোডাক্ট হিসেবে কিনে নেয় প্রোকিউরমেন্টের মাধ্যমে। ফলে আমি মূলত ‘জ্ঞানব্যবসায়ী’। ফলে, ওই সংস্থার চেয়ার, টেবিল, এসি সহ যাবতীয় পণ্য যে প্রক্রিয়ায় প্রোকিউর হয়, আমারটাও সেই প্রক্রিয়ায় যায়। ফলে এই জ্ঞানব্যবসা বাবদ আমারে ১৫% ভ্যাট দেওয়া লাগে আর ১০ % ট্যাক্স। সেইটা হিসেব করলে দেখা যায় ওই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, যে হয়তো সরকারের নবম বা দশম বা কোনো গ্রেডে চাকরি করে তার মূল স্কেলের কাছাকাছি চইলা যায়। সেইটা অন্য হিসেব।
তো, এই যে ভ্যাট অফিসে ঘুষটুষ চলে এইটা তো আগে মানুষের মুখে শুনতাম। যখন আমাকে তারা ডিল করে তারাও আশা করে আমি তাগো ট্যাকা পয়সা দিমু। কিন্তু এমনিতে-ই পয়সা উপার্জনের শ্রম আছে, তারপর মাসিক যে টাকা সরকারকে দেই তার বিনিময়ে সরকার ঘোড়ার আণ্ডা দেয়। তারপরও যখন দেখি ওরা পয়সা আশা করে তখন ইচ্ছা করে কানের ওপর চড় লাগাই। যেহেতু স্বচ্ছ কাগজপত্র আছে, উৎস থেকে ভ্যাট কর্তন করার স্টেটমেন্টও আছে ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওগো ভাবটাবরে পাত্তা দেওয়া হয় না।
একবার গিয়ে পরিচয় হইলো ভার্সিটির এক সিনিয়রের সাথে। সে খুব যত্ন খাতির করতো এবং বলতো আমি যে পেশায় আছি তারও এককালে ইচ্ছা করতো ওই রকম পেশায় যাইতে। অর্থাৎ গবেষণা করতে। আমি হাসতাম। সেই ভাই বেশিদিন আর ঐ অফিসে রইলো না। পরেরবার কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে দেখি তার জায়গায় এক আপা বইসা আছে। সেও ভার্সিটির সিনিয়র। আলাপচারিতায় জানতে পারলাম। তো গিয়ে দেখি ভ্যাট অফিসে বইসা সে শাহাদুজ্জামানের ‘ক্র্যাচের কর্নেল’ উপন্যাস পড়তেছে। দেখে ভালো লাগলো যে, যাক একজনরে পাইলাম যে বই-টই পড়ে।
আমি জিগাইলাম, ‘বইটা আপনার কেমন লাগতেছে?’ উনি উত্তর দিলেন, ‘সামনে উনার রিটেন আছে। এর জন্য এই বইটা সহায়ক বই হিসেবে পড়তেছে কারণ এইখানে নাকি ইতিহাসের অনেক বিষয় সহজ কইরা গুছাইয়া লেখা আছে।’ আমি কইলাম, ‘ওহ আচ্ছা।’ সেই আপাও বেশিদিন রইলো না।
পরেরবার গিয়ে পাইলাম আরেকজনরে। তারে যখন বুঝাইয়া কইলাম, ‘কী আমার পেশা, কেন আমি ভ্যাট দেই’ শুইনা উনিও আফসোস করলো আর কইলো, উনি লেখালেখি করে। আমি মানুষের এই আফসোস শুইনা হাসি, কারণ যে যার ভার বহন করে। ওইবার উনি আমারে চিনি ছাড়া গ্রিন টি দিয়া আপ্যায়ন করলো। আর আমারও মনে হইলো, যাক পাইলাম একজন লেখক। শুনলাম উনি আসলে ভূতটুত নিয়া লেখে। বাচ্চাদের জন্য। আমি মজা করে কইলাম, আমার বাচ্চা হইলে আপনার বই পড়তে দিমু। আজকে আবার যাইতে হইলো গতমাসের কাগজপত্র জমা দিতে।
গিয়া দেখি উনি স্বর্ণের দরদাম নিয়া আলাপ করতেছেন এক ব্যবসায়ীর লগে। ওই ব্যবসায়ী তারে ‘স্যার স্যার’ করতেছে। মানুষের ‘স্যার স্যার’ সম্বোধনের আড়ালে একটা ‘ছাড় ছাড়’ অনুভূতি টের পাই। আমারে দেইখা উনি বসতে কইলেন। বিরস মুখে বইসা শুনতেছিলাম সোনার দাম কইমা যাওয়ার কেচ্ছা। মানুষ সোনার অলংকার পড়ে না এইসব।
তো ওই ব্যবসায়ি আলাপ সাইড়া উনারে টেবিলের নিচ দিয়া টাকা দিলেন। উনি টাকা ছ্যাপ দিয়া গুনলেন মনে হয়। আমি দেইখা ফালানোয় কেমন যেন ফ্যাকাসে হইয়া গেলেন। কারণ, এর আগে নৈতিকতা দর্শন, সাহিত্য- নিয়া মেলা আলাপ করতেছিলেন। তো উনার ওই মুখ দেইখা আমার কেমন লজ্জা লাগতেছিল। কইলাম, একটা মূসক ৯.১ ফর্ম দেন। আজকে প্রিন্ট কইরা আনি নাই। ২০ মিনিট খুঁইজাও যখন কোনো ফর্ম পাওয়া গেলো না তখন উনি কইলেন, ‘মাসে ৪, ০০০ টাকার ফর্ম ফটোকপি করা হয় কিন্তু কাজের সময় কিছু পাওয়া যায় না। যে ফর্ম দেয় সে মনে হয় টাকা মারে।
আমি শুইনা কইলাম, হ। যে যেমনে পারে মারতেছে।
উনি কইলো, কী?
(মনে মনে) কইলাম, নৈতিকতার চাপা।