“সততার মসলা”
রাজশাহীর কোন এক বাজারে মসলার দোকান চালাত হাবিবুল্লাহ।
ছোট দোকান, পুরোনো কাঠের তাক, গ্রাহকদের বিশ্বাস আর আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস—এগুলোই ছিল তার পুঁজি। বাবার কাছ থেকে শেখা একটা নিয়ম তার জীবনের মূলমন্ত্র:
“ব্যবসায় ভেজাল চলবে না, আর মিথ্যা বলবে না।”
কয়েক বছর আগ পর্যন্ত সব ঠিকই চলছিল।
কিন্তু হঠাৎ এলাকায় কয়েকজন নতুন ব্যবসায়ী এল।
তারা ঢাকার বড় পাইকারি বাজার থেকে সস্তা আর ভেজাল মসলা এনে বিক্রি করতে লাগল।
মানুষ দাম কম দেখেই সেদিকে ঝুঁকে পড়ল।
একদিন হাবিবুল্লাহ তার ব্যবসার হিসাব করে দেখল—
“এই মাসে তো লাভের চেয়ে খরচই বেশি!”
সন্ধ্যায় দোকান গুটাতে গুটাতে পাশের দোকানের মালিক আজিজ বলল—
“হাবিব ভাই, এভাবে কিচ্ছু হবে না।
হলুদের সঙ্গে অল্প রং, ময়দা মিশাইলে মানুষ বুঝবে ?
সবাই তো দিচ্ছে। বাজারে টিকে থাকতে হলে একটু ‘এডজাস্ট’ করতেই হয়।”
হাবিবুল্লাহ কিছু বলল না। মুখ নীচু করে দোকান বন্ধ করল।
একদিন রাতে তার স্ত্রী রুনা মসলা বিক্রির বিল খাতায় চোখ রেখে বলল—
“এমাসে মেয়ের মেডিকেল ভর্তি কোচিং-এর টাকাকিভাবে দেব ?”
— “দোকানে বিক্রি কমে গেছে…” হাবিবুল্লাহ ধীরে বলল।
রুনা একটু থেমে বলল,
— “সবাই তো একটু-আধটু মিশায়…এদিক সেদিক করে, তুমি করলে কি হবে ?”
হাবিবুল্লাহর বুকটা কেঁপে উঠল। পরিবারও এখন তাকে ভেজালের দিকে ঠেলে দিচ্ছে!
সে ভাবল, আশেপাশের ব্যবসায়ীদের দ্রুত উন্নতি দেখে হয়তো স্ত্রীর মনের ভিতর বিভিন্ন রকম চিন্তা ঢুকেছে।
পরদিন জুমার নামাজে ইমাম সাহেব খুব বাস্তবধর্মী কথা বললেন—
“যে খাবারে ভেজাল দেয়, সে শুধু টাকা কামায় না, হাজার হাজার মানুষকে ধোঁকা দেয়,
মানুষের শরীরে রোগঢুকিয়ে দেয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’
মনে রাখবেন, হারাম আয় ঘরে ঢুকলে সেই ঘর থেকে শান্তি উঠে যায়, ববরকত উঠে যায়।”
হাবিবুল্লাহ মনে হলো যেন নিজের জন্যই খুতবাটি শুনছে। তার চোখ ভিজে উঠল।
নামাজ শেষে সে বাড়ি ফিরল, স্ত্রীকে বলল—
“রুনা, আমরা অভাবে থাকব, তবু কাউকে ধোঁকা দিয়ে,
ভেজাল খাবারখাইয়ে টাকা ইনকাম করব না।
মেয়েরপড়াশোনার টাকাটা আল্লাহই ব্যবস্থা করে দিবেন ইং শা আল্লাহ।”
রুনা চুপ করে রইল, পরে ধীরে বলল— “তুমিঠিকই বলেছ।
শেপাশের ব্যবসায়ীদের উন্নতি দেখে আমি ধৈর্যহারিয়ে ফেলেছিলাম।
চল, ধৈর্য ধরি।”
দু’সপ্তাহ পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক ডাক্তার তার দোকানে এলেন। তিনি বিশুদ্ধ মসলার নমুনা সংগ্রহ করছেন, স্থানীয়দেরও জানান দিচ্ছেন কোনটা ভেজাল আর কোনটা নয়। হাবিবুল্লাহর দোকানের নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেল—শতভাগ বিশুদ্ধ ।
ডাক্তার বললেন— “আপনার মতো সৎ ব্যবসায়ী ও এমন দোকান এখন বিরল।
আমি হাসপাতালে আপনার দোকানের নাম টাঙিয়ে দেব এবং
হাসপাতালে রুগির খাবারে ব্যবহারের জন্য আমরা আপনার দোকান হতে মসলা নিব।”
কয়েক দিনের মধ্যেই মানুষ হাবিবুল্লাহর দোকানে ভিড় করতে শুরু করল।
যারা আগে সস্তা জিনিস কিনত, এখন তারা বুঝতে পেরে বলছে— “হালাল আর বিশুদ্ধ জিনিসই টিকবে।
সুস্বাস্থ্যের জন্য ভালো জিনিসই লাগবে, দামে বেশি হলেও ভালো জিনিস খেতে হবে।”
একদিন আজিজ এসে একটু বিব্রত মুখে বলল—
— “হাবিব ভাই, আপনার দোকান তো আবার জমে গেছে।
দোস্ত, আমাকেও শেখান কিভাবে এসব ভেজালের ঝামেলা ছাড়তে পারি।”
হাবিবুল্লাহ হাসল।
— “ভেজাল ছাড়ার জন্য রাস্তা একটাই—আল্লাহকে ভয় করা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দয়া রাখা। তারপর দেখবেন, ব্যবসায় বরকত আসবেই।”
আজিজ চুপ করে মাথা নেড়ে চলে গেল।
দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন হাবিবুল্লাহর মসলার দোকানে মসলা নিতে আসতে লাগল।
সবাই বলতে লাগল ”হাবিবুল্লাহর সততার মসলা, সততার মসলা দোকান।”
শিক্ষাঃ
** সৎ পথে চলা খুবই কঠিন, কিন্তু সৎ পথ কখনো বন্ধ হয় না—কিছুদিন দেরি হলেও আল্লাহ বরকত দেন।
** ভেজাল দেওয়া শুধু আইনগত অপরাধ নয়;
এটি দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ।
** একটি ছোট সিদ্ধান্ত পুরো সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
বর্তমান সমাজে চারিদিকে ভেজাল ছড়িয়ে পড়েছে।
মানুষের মন থেকে আল্লাহর ভয় উঠে গেছে, আখিরাতের কথা ভুলে গেছে।
ভেজালমুক্ত খাবার পাওয়া এখন দুষ্কর।