শেষ হলেও গল্প
সব শেষ হয়ে গেলে মানুষ সাধারণত থেমে যায়। কথা থামে, ভাবনা থামে, বিশ্বাস থামে। কিন্তু আমি থামিনি। আমি বসে ছিলাম খালি ঘরের মাঝখানে, ঠিক যেমন মানুষ বসে থাকে নিজের ভেতরের শূন্যতার মাঝে। এই ঘরটা একসময় ভরা ছিল—শব্দে, আলোতে, অপেক্ষায়। এখন শুধু দেয়াল আছে, আর দেয়ালগুলো চুপ করে থেকেও সব মনে করিয়ে দেয়।
একদিন এখানে একজন মানুষ ছিল। খুব সাধারণ, তবু তার উপস্থিতিতে ঘরটা বড় মনে হতো। সে বলত, “সবকিছু শেষ হলেও গল্প শেষ হয় না।” আমি তখন কথাটার গভীরতা বুঝিনি। এখন বুঝি, দেরিতে বোঝা কথাগুলোই সবচেয়ে সত্য হয়।
আমার জীবনে আসা মানুষগুলো কেউই স্থায়ী ছিল না। কেউ এসেছিল প্রয়োজনে, কেউ ভালোবাসার নামে, কেউ আবার শুধু অভ্যাস হয়ে। তারা চলে যাওয়ার পর আমি নিজেকেই দোষ দিয়েছি। ভেবেছি, আমারই কিছু কম ছিল। পরে বুঝেছি, মানুষ থাকা আর মানুষ থেকে যাওয়া এক জিনিস নয়।
আমি বিশ্বাস করতাম ভালোবাসা থাকলে মানুষ থাকে। কিন্তু মানুষ থাকে না, স্মৃতি থাকে। একেকটা স্মৃতি একেক রকম—কিছু রাতে ঘুম ভাঙায়, কিছু দুপুরে হঠাৎ থামিয়ে দেয়, আর কিছু স্মৃতি এমন যেগুলো থাকলেও ছুঁতে নেই।
একদিন পুরোনো আলমারি খুলে পেলাম কিছু কাপড়, কিছু কাগজ, আর একটা ভাঙা ঘড়ি। ঘড়িটা আর চলে না, তবু তাকালে মনে হয় সময় থামেনি। তখন বুঝলাম—যা চলে না, সেটাও গল্প। যা ভেঙে যায়, সেটাও গল্প।
সবচেয়ে ভারী গল্পগুলো লেখা হয় না। সেগুলো কাউকে বলা যায় না। নীরবে বয়ে বেড়াতে হয়। এক রাতে আমি সেই পুরোনো খাতাটা খুললাম। পাতার পর পাতা ফাঁকা, তবু হাত কাঁপছিল। কারণ ফাঁকা পাতায়ই সবচেয়ে বেশি কথা জমে থাকে।
শেষ পাতায় এসে আমি থামলাম। কাঁদিনি, হাসিও না। শুধু বুঝলাম—শেষ মানে পরাজয় নয়, শেষ মানে মেনে নেওয়া। মানুষ চলে যায়, ভালোবাসা বদলে যায়, স্বপ্ন ছোট হয়ে যায়, কিন্তু যে মানুষটা এসব সহ্য করে বেঁচে থাকে, সে নিজেই একটা গল্প হয়ে ওঠে।
আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকালাম। মুখটা চেনা, মানুষটা বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়াটাই প্রমাণ—আমি শেষ হইনি। সব শেষ হয়ে গেলে মানুষ নতুন জীবন শুরু করে না, মানুষ শুধু আগের জীবনের মানে বুঝে।
আর তখনই বোঝা যায়—গল্প কখনো শেষ হয় না। শেষ হয় শুধু একটি অধ্যায়। তাই আজ আমি জানি, শেষ হলেও গল্প।
17
View