বৃষ্টির স্মৃতি
অনেক বছর আগের কথা। গ্রামের নদীর ধারে একটা ছোট্ট ঘরে থাকত রাহুল আর তার মা। বাবা ছিলেন না, শুধু মা-ছেলের সংসার। রাহুল তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। মা দিনরাত খেটে খাওয়াতেন তাকে—কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে, কখনো মাঠে ধান কেটে। কিন্তু রাহুলের জন্য মায়ের চোখে সবসময় একটা আলো জ্বলত।
এক বর্ষার দিনে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছিল। গ্রামে ডাক্তার ছিল না কাছে, শহরে নিয়ে যাওয়ার মতো টাকাও ছিল না। রাহুল রাতভর মায়ের কপালে ভেজা কাপড় বদলাতে লাগল। বাইরে বৃষ্টি ঝমঝম করে পড়ছে। মা দুর্বল গলায় বললেন, “রাহুল, ভয় পাস না। মা ঠিক হয়ে যাবে। তুই আমার জন্য পড়াশোনা করবি, বড় হবি।”
রাহুল কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মা, তুমি ছাড়া আমি কী করব?”
মা হাসলেন। একটা দুর্বল হাসি। বললেন, “আমি তো সবসময় তোর সাথে থাকব, বাবু। এই বৃষ্টির মতো। যখন বৃষ্টি পড়বে, তখন বুঝবি মা তোকে আদর করছে।”
সেই রাতেই মা চলে গেলেন। রাহুল একা হয়ে গেল। বৃষ্টি থামেনি সারারাত।
বছরগুলো কেটে গেল। রাহুল বড় হল। পড়াশোনা করে শহরে চাকরি পেল। ভালো জায়গায় উঠল। কিন্তু প্রতি বর্ষায়, যখন প্রথম বৃষ্টি পড়ে, রাহুল জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন মায়ের আঙ্গুলের ছোঁয়া। চোখ ভিজে যায় তার।
একদিন বর্ষায় শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রাহুল দেখল একটা ছোট ছেলে তার অসুস্থ মাকে কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে দুজনেই ভিজে চুপচুপ। রাহুল থমকে দাঁড়াল। তারপর দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার হাত থেকে মাকে নিল। অটো ডেকে হাসপাতালে পৌঁছে দিল। ডাক্তার দেখলেন, চিকিৎসা করলেন। মা বেঁচে গেলেন।
ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে রাহুলের পায়ে পড়ল। রাহুল তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভয় পাস না। তোর মা ঠিক হয়ে যাবে।”
বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। রাহুল আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসল। মনে মনে বলল, “মা, দেখো, আমি তোমার কথা রেখেছি।”
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন আরও নরম হয়ে পড়ল তার গালে।
12
View