বার বার মুখের ভেতরে দলায় দলায় আঠালো থুথু উঠে আসছে। এমন থুথু, নিজের থুথু নিজেরই ঢোক গিলতে রুচিতে কুলায় না আকমলের। তারপরও উঠে জানালার কাছে অথবা টয়লেটে যাওয়ার অলসতায় কয়েকবার গিলে ফেলেছে সেই আঠালো থুথু। বেশি বেশি রাগ উঠলে বা বিরক্তি আসলে এই ব্যাপারটা ঘটে তার। মুখের ভেতর যেন থুথুর জোয়ার নামে, ভাদ্র-আষাঢ়ের নতুন পানির মতো জোয়ার। থুথু ফেলতে ফেলতে রাগ আরও বাড়ে। রাগ বাড়তে থাকলে থুথু আরও বাড়ে। থুথু আর রাগ যখন সমানুপাতিক অবস্থায় আসে, থুথু ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হয় সে। আকমল যখন ক্লান্ত হয়, রাগ তখন কমতে থাকে। তবে আজ এই মুহূর্তে রাগ ও থুথু দুইটাই বাড়ার দিকে, শরীরে এখনও ক্লান্তি আসে নাই। ঘরের সব কিছু উলটপালট করতে করতে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ করে গজরায় আর নতুন শার্টটা খুঁজতে থাকে আকমল। গত বছর রোজার ঈদে কিনেছিল শার্টটা, এরপর আর কোনো শার্ট কেনা হয় নাই বলে প্রায় আট মাস যাবৎ এটাই তার নতুন শার্ট। সাধ্যের আড়ষ্টতায় আহ্লাদগুলো এভাবেই জড়িয়ে থাকে, লেপ্টে থাকে, আকমলের অথবা আকমলদের। এখনও তার মনে আছে, যে শার্টটা তখন থেকে খুঁজে খুঁজে সে হয়রান হচ্ছে অথবা হয়রান হয়ে যে শার্টটা সে খুঁজছে, সেই শার্টটার দাম দুই শ টাকা রাখছিল। ঈদের আগের চান রাতে কেনা, এক টাকাও কম রাখে নাই। তাও ফুটপাথের ভ্যানগাড়ির দোকান। ভিতরের কোনো দোকান থেকে কিনলে এই শার্টের দাম চার/পাঁচশ টাকা রাখতো, আকমল ও তার বন্ধু ফরিদের এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ হয় নাই। সাদার উপর ছোট ছোট নীল নীল ফুল, পরেও অনেক আরাম। এই শার্ট পরার পর ফরিদের বান্ধবী শিউলি হাত দিয়ে ধরে দেখছিল আর ফরিদকে এমন একটা শার্ট কিনে দিতে চাইছিল। ঈদের পর ওই দোকানে গিয়ে এমন শার্ট আর পাওয়া যায় নাই বলে অনেক আফসোস করছিল শিউলি। আজ শিউলির সাথে ফরিদের বিয়ে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই রিকশা গ্যারেজে জমা দিয়ে চলে এসেছে আকমল। আগে যাওয়ার জন্য বারবার করে বলে দিছিল ফরিদ। এখন শার্টটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও যাওয়ার মতো এই একটাই শার্ট। রাহেলা একবার বলছিল, এই শার্টটাও কাঁধের দিকে রঙ চটে গেছে। তারপরও এই শার্টটাই চলন সই। বাকি শার্টগুলো পরে রিকশা চালানো বাদে বড়জোর বাজার পর্যন্ত যাওন যায়, বিয়েতে যাওয়ার মতন অবস্থা কোনটারই নাই। রাহেলা এখনও কাজ থেকে ফিরে নাই। ‘এই মাগিডা ঘর গুছাইলে কুনুকিচ্চু ঠিক মতন পাওন যায় না’ বলতে বলতে রাহেলাকে উদ্দেশ করে আরও কিছু অশ্রাব্য গালি দেয় আকমল।
দলা পাকিয়ে মুখে জমা থুথুটা জানালা দিয়ে ফেলে একটা কম দামি সিগারেট ধরায়। এমনিতে সে বিড়ি খায়। আজ ফরিদের বিয়েতে যাবে বলে এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছিল। শত হলেও দোস্তের বিয়ে, মানুষের সামনে বিড়ি ধরানো একটা মান-ইজ্জতের ব্যাপার। শুধু নিজের ইজ্জত তো না, বিড়ির সাথে অথবা সিগারেটের সাথে ফরিদের ইজ্জতও লেগে থাকবে। বিড়ি পুড়লে ইজ্জত বেশি পুড়বে, সিগারেট পুড়লে ইজ্জত কম পুড়বে অথবা পুড়বেই না, বাড়বে। কিন্তু মুশকিল হলো সিগারেট দিয়ে ধোঁয়া আসছে না। তিতকুটে স্বাদ নিয়ে ঠোঁট থেকে সিগারেট হাতে নিতেই আকমলের রাগ আরও বেড়ে যায়। পাঁচটা টাকাই নষ্ট। সিগারেটের মুখে আগুন না দিয়ে মুথা নামে পরিচিত সিগারেটের ফিল্টারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে। একটা সিগারেট নষ্ট হওয়ার কষ্টও রাগ হয়ে রাহেলার উপর বর্তায়। তার এই শার্ট খুঁজে না পাওয়ার জন্য রাহেলা ছাড়া আর কাউকে দায়ী করতে পারে না আকমল। সংসারে সে আর রাহেলা ছাড়া তৃতীয় কোনো প্রাণী নাই। অসুস্থ বাবা, মা আর একটা ছোট ভাই আছে গ্রামের বাড়িতে। ছোট একটা বোন ছিল, গত বছর বাচ্চা ডেলিভারির সময় মারা গেছে। বিয়ের বছর ঘুরে প্রায় দুই বছর হতে চলেছে আকমল আর রাহেলার। কিন্তু সংসারের এমন দশায় বাচ্চা নিতে কিছুতেই রাজি হয় না রাহেলা। আকমল, অনেক বার চেয়েছে, চেষ্টা করেছে। কনডম শেষ হয়ে যাওয়ার ছুতো দিয়েছে, আনার সময় ইচ্ছে করে ভুলে যাওয়ার অজুহাত দিয়ে রাতে বিছানায় ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে। বারবার তাকে নির্দয়ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে রাহেলা। এই জন্য আকমল রাহেলাকে গালাগাল দিয়েছে, আজেবাজে কথা বলেছে, গায়ে হাত তুলেছে কয়েকবার। কিন্তু রাহেলা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে নাই। রাহেলা এখন নিজেই কনডম এনে রাখে। আকমলের এইসব ধানাইপানাই এখন আর ধোপে টিকে না। ফার্মেসীতে গিয়ে রাহেলা কী বলে এই জিনিস নিয়ে আসে আকমলের মাথায় কুলায় না। তার নিজেরই এখনও দোকানে গিয়ে এই জিনিসটা চাইতে লজ্জা লাগে, নাম বলতে গিয়ে জিহবায় গিট্টু লাগে। ইশারা-ইঙ্গিতে প্রয়োজন মেটায়।
পুড়ে যাওয়া ফিল্টার ছিঁড়ে ফেলে সিগারেটটা খাওয়ার চেষ্টা করে আকমল, পারে না। মুখের ভিতর তামাক ঢুকে যায়, কাশি হয়। আফসোস নিয়ে আরেকটা নতুন সিগারেট ধরাতে বাধ্য হয় সে। গভীরভাবে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। পাখিরা আকাশপথে বাড়ি ফেরে, কাজ শেষ করে রাহেলা ফিরে আসে না। আকমলের মুখে থুথু উঠে আসে, আকমলের রাগ বাড়তে থাকে। অথচ বিয়েতে যাওয়ার সাথে রাহেলার কোনো সংযোগ নাই। এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। আজ বরের সাথে আকমলই শুধু যাত্রী হওয়ার কথা। বিয়েতে যাওয়ার মতো রাহেলার ভালো কোনো শাড়ি নাই। আর এই সময়ে ফরিদের নতুন বউকে একটা শাড়ি তো দেওনই লাগে। শাড়ির প্যাকেটটা খাটের উপর শুয়ে আছে। আটশ টাকা নিছে শাড়িটার দাম। ফরিদের বউ শিউলিরে মানাইবো শাড়িটা। লাল সুতি কাপড়ের মধ্যে লাল সুতার কাজ করা। কিন্তু শাড়িটার নিচে দু একবার রাহেলার মুখটা ভেসে উঠছিল কেনার সময়। আকমল একটু পর পর জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। রাস্তাটা গড়িয়ে গড়িয়ে বড়ো রাস্তায় চলে যায়, তার উপর হেঁটে হেঁটে রাহেলাকে আসতে দেখা যায় না। মানুষের বাসায় কাজের এই একটা সমস্যা, ইচ্ছে হলেই চলে আসা যায় না। আকমলেরই সুবিধা, ইচ্ছা না হলে ভাড়া মারা বন্ধ করে চলে আসতে পারে, যখন-তখন। রাস্তায় থাকলেও, ভাড়া মারতে ইচ্ছা না হলে হুড তুলে প্যাসেঞ্জার সীটে বসে ড্রাইভিং সীটে পা মেলে আধ শোয়া হয়ে আরাম করে নিতে পারে। অনেক প্যাসেঞ্জার এমন সময় ভাড়ায় যাওয়ার জন্য বিরক্ত করে, রাগ দেখায়, হুমকি-ধমকি দেয়, আকমল টলে না। মর্জি ধরলে যায়, না ধরলে যায় না। স্বাধীন ব্যবসা, স্বাধীন কর্ম। নিজের মর্জি মাফিক চলে, নিজের মতন চলে। পরের অধীনে কাজ, সেটা বাসাতেই হোক অথবা বিমানেই হোক, নিজের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। নিজের কোনো মর্জি চলে না। সবসময় শুধু হুকুমজারি আর খবরদারি।
সিগারেটের ধোঁয়া ঘরের বাতাসে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যায়। কম আলোর ঘরে সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ করে ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস তার ঘাম শুকাতে পারে না। সম্ভাব্য সকল জায়গায় খুঁজতে খুঁজতে মেজাজ বিতৃষ্ণা হয়, রাগ শরীরে জ্বালা ধরায়। আশেপাশের কারও কাছ থেকে নিজের মাপের একটা শার্ট আনার কথা ভাবনায় আসে কিন্তু তেমন কারও নাম অথবা মুখ মনে পড়ে না আকমলের। শুধু রাহেলার মুখটা ভেসে উঠে। রাহেলার নাম নিয়ে, বাপ-মার নাম নিয়ে মনে মনে হাজার রকম গালাগাল দিয়ে মুখ থেকে আরও এক দলা থুথু জানালার বাইরে ফেলে সে। নিজের কাছে নিজেকে বড় অসহায় লাগতে থাকে। সামনের সপ্তায় আরেকটা শার্ট কেনার কথা ভাবে। তারপর হঠাৎ করেই মনে পড়ে, কয়েকদিন বা চার-পাঁচদিন আগে ঘরের কিছু পুরাতন কাপড়চোপড় দিয়ে একটা এ্যালুমিনিয়ামের ছোট পাতিল আর একটা সস্তা মেলামাইন বাটি কিনেছিল রাহেলা। সেসব পুরাতন কাপড়চোপড়ের সাথে নতুন শার্টটা দিয়ে দেয়ার আশঙ্কা মাথায় আসে তার। ঘুণে ধরা কাঠের আলনায়, গত কয়েকদিনে শার্টটা দেখেছে বলে তার মনে পড়ে না। আধা পাগলা বউয়ের দ্বারা এটা ঘটার আশঙ্কা তার কাছে প্রবল হয়ে ওঠে। এই আশঙ্কায় সব রাগ এবার নিশ্চিতভাবেই রাহেলার উপর গিয়ে পড়ে। ঘরের ভিতরের এক কোনায় সেই পাতিল আর বাটিটাকে দেখতে পায় আকমল। রাহেলার অনুপস্থিতিতে এবার রাগ গিয়ে সেই জড় বস্তু দুটোর উপর জড়ো হয়।
সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে সে পাতিল আর বাটির দিকে এগিয়ে যায়। সব আক্রোশ একসাথে করে প্রথমে বাটিটাকে মেঝেতে আছড়ে ফেলে। বাটিটা কয়েক টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একেকদিকে ছুটে যায়, শব্দ হয়। দূর থেকে সে বাটির কয়েকটা দৃশ্যমান টুকরো তার দিকে চেয়ে থাকে। আচম্বিত অবাক দৃষ্টি ঠিকরে বের হয় সেসব টকুরোর ভেঙে যাওয়া কিনার থেকে, আকমল সেসব গ্রাহ্য করে না। সে এবার পাতিলটা হাতে তুলে নেয়। ছুড়ে ফেলে, ধাতব শব্দ হয়। ঘুরেফিরে কয়েক জায়গায় ধাক্কা খায়, ট্যাপ খায়, স্থির হয়। অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল বাটির মতো সহজে হার মানে না। পাতিলের এই ত্যাড়ামো আকমলের অসহ্য লাগে। ঠোঁট থেকে সিগারেটটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে সে পাতিলটা কুড়িয়ে নেয়, মেঝেতে উপুড় করে রাখে। রাহেলার নিতম্বের মতো ফুলে থাকা পাতিলের পশ্চাৎদেশে একটা পা তুলে দেয়, ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, পিষে দেয়। আকমলের পুরুষালি শরীরের ভার সহ্য করতে না পেরে পাতিলের তলদেশ দেবে যায়, মুচড়ে যায়, বাঁকা হয়। রাহেলার নিতম্বে লাথি দেয়ার সুখ হয় আকমলের, কিন্তু রাগ তখনও কমে না। অসহায়, নির্বিবাদী ও আতঙ্কিত দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া পাতিলটা তুলে নিয়ে সে এবার জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে। বস্তির পাশের পানা ডোবায় অযতে ড়ব বেড়ে ওঠা কলমিলতার জমাট ভাসমান ভেলায় পড়ে থাকে পাতিলটা। তারপর পাতিলের বিস্মিত দৃষ্টি লক্ষ্য করে মুখে জমে ওঠা আঠালো এক দলা থু থু ছুড়ে দেয় আকমল। পাতিলটা আরও অবাক হয়। মানবের এই অহেতুক উগ্রতায় তার নির্বাক জড় জীবন কথা বলে উঠতে চায়, ভাষা চায়, দ্রোহের আরও শক্তি চায়। পারে কই, পাবে কই। যে পৃথিবী সামর্থ্য আর শক্তির পদভারে পিষ্ট হয়, ক্ষমতার রোলার কোস্টারে হয় জীবনের অদলবদল, সেখানে জড় ও জীবের কোনো তফাত নাই। ভাষার কোনো মূল্য নাই, দ্রোহের কোনো সংজ্ঞা নাই। স্বল্প আয়ু পাতিলের সে কথা হয়তো জানা হয় অথবা জানা হয় না।
জানালা দিয়ে পাতিলের দিকে থু থু ছুড়ে রাস্তায় চোখ যেতে অবাক হয় আকমলও। অথবা ঠিক অবাক হয় কি-না বলা মুশকিল হলেও তার চোখ যা দেখে তার মন তা বিশ্বাস করে না। তার মস্তিষ্ক সেটাকে এই গ্রহের ঘটমান কোনো ঘটনা বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না। কিন্তু আকমলের চোখ দেখে, দেখতে পায়, দেখে যায়। হাস্যোজ্জ্বল রাহেলা, খুশিতে ডগমগ রাহেলা, ঝলমল করতে করতে রাস্তার বুক জুড়ে অপার্থিব কোনো আনন্দ দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে ফিরছে। তার মলিন শাড়ির উপর আকমলের নতুন শার্ট। সাদার উপর ছোট ছোট নীল নীল ফুলের শার্ট। এতক্ষণ খুঁজে খুঁজে পেরেশান হওয়া অথবা পেরেশান হয়ে খুঁজে ফেরা শার্ট। বন্ধু ফরিদ ও শিউলির বিয়ের বরযাত্রী হওয়ার শার্ট। রাহেলা কাজ থেকে সে শার্ট গায়ে দিয়ে ফিরছে। শার্টের সব বোতাম এঁটে, সুডৌল স্তনের ভাঁজ স্পষ্ট করে বুক চিতিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছে। পথচারীদের গোপন চাহনি অথবা লোভাতুর লোলুপ দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে যখন আকমলের নতুন শার্ট গায়ে দিয়ে রাহেলা ফিরে আসে, তখন রাগে ক্ষোভে কষ্টে আকমল প্রথম কয়েক মুহূর্ত স্থাণুর মতো স্থির থাকে, নির্বাক থাকে, বিমূঢ় থাকে। রাহেলা, তার স্বভাবসুলভ চপলতা ধরে রেখে, ঠোঁটের কোণে দষ্টু একটা ক্রূর হাসি ঝুলিয়ে রেখে বিহ্বল আকমলকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। আকমল ক্ষণিকের জন্য দেখতে পায়, তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে রাহেলা তার দিকে তাকিয়ে ডান চোখের উপর বক্র তরবারির মতন বসে থাকা ভ্রুটা নাচিয়ে প্রশ্নবোধক একটা দুষ্টু কিন্তু টক-ঝাল-মিষ্টি আচারের মতো বিভ্রান্ত স্বাদের হাসি দেয় অথবা আকমলের ঘোরগ্রস্ত মস্তিষ্ক দৃশ্যটা কল্পনা করে নেয়। রাহেলার সাহস দেখে, রাহেলার স্পর্ধা দেখে আকমল আরও বিস্মিত হয়। রাহেলা হাতের ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে আকমলের শার্ট না খুলেই টয়লেটে যায়। টয়লেট থেকে ফিরে এসে কল ছেড়ে হাত ধোয়, পা ধোয়, ঘষে ঘষে মুখ ধোয়, মাথায় পানির ছিটা দেয়। ছিটকে ছিটকে উড়া পানিতে ভিজতে থাকে তার গায়ে থাকা আকমলের নতুন শার্ট। বিয়েতে যাওয়ার একমাত্র চলনসই শার্ট। গত রোজার ঈদের চান রাতে দু’শ টাকা দিয়ে কেনা শার্ট। তবু যেন কিছুই হয়নি, কিছুই সে করেনি, পৃথিবীতে আজ ভিন্ন কোনোকিছুই ঘটেনি। আকমলের এসময়ে ঘরে থাকা, এমন বিহ্বল দাঁড়িয়ে থাকা, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকা─সব যেন রোজকার মতন স্বাভাবিক, নিত্যদিনের মামুলি, চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্তের মতন ধ্রুব। তাতে রাহেলার কখনোই কিছু যায় আসেনি, আজও কিছু যায় আসে না, ভবিষ্যতেও কিছুই আসবে যাবে না। পৃথিবী এভাবেই কেটে যায়, যাচ্ছে, যাবে।
কিন্তু রাহেলা ভুলে যায়, পৃথিবীতেও কখনো কখনো গ্রহণের ছায়া লাগে, দুর্যোগ নামে, ছন্দপতন হয়। তাই কলতলা থেকে ঘরে ঢোকার পথে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা আকমলকে উদ্দেশ্য করে- ‘এনে এমুন ঠাডার মরার লাহান খাড়াই আচো ক্যান, রেডি হইয়া দোস্তের বিয়াত যাইতা না?’ প্রশ্নটা করতেই তার ভাবনার পৃথিবী লণ্ডভণ্ড হয়। একটা আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে, বিস্ফোরিত হয়। রাহেলার চুলের মুঠি আকমল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করে- ‘মাগি, তুই আমার লগে মশকরা করোছ? ওই মাগি, তুই আমার সাট পিদ্দা রঙগো করতে কুন ভাতারের কামে গেছিলি ক?’ উত্তরে রাহেলার মুখ থেকে আহঃ ওহঃ ধ্বনিযুক্ত বেদনাত্মক কিছু শব্দ ছিটকে বের হয়। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে সচেষ্ট রাহেলার নিতম্বকে এবার পাতিলার তলা বা পশ্চাৎদেশের মতন বানাতে চায় আকমল। তার মুখে শ্রীহীন শব্দের ফলু ঝুরি ফোটে, রাহেলার বিভিন্ন লজ্জাস্থান নিয়ে অশ্রাব্য গালাগাল ওঠে। তবু আকমলের আধাপাগল বউ রাহেলা খিলখিল করে হাসে। আঘাতে আঘাতে আহঃ ওহঃ চিৎকারের সাথে তার হাসির দমক ওঠে। ‘মাগি তরে জ্বিনে ভূতে ধরচেনি কুনু, তুই এমতি ভেটকাছ ক্যা!’ -মারতে মারতে, ধস্তাধস্তি করতে করতে, গালাগালি করতে করতে রাহেলার হাসি দেখে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে আকমল। ‘হ, আমাক ভূতেই ধরচে, হ্যাতাইনের নাম আকমইল্যা, আকমইল্যা ভূত, রিকশা চালায়’ -হাসতে হাসতেই উত্তর দেয় রাহেলা। তারপর আকমইল্যা ভূতকেসহ টেনেহিঁচড়ে সে নিজেকে বিছানার কাছে নিয়ে আসে। হাতড়ে হাতড়ে বিছানা থেকে ব্যাগটা নিয়ে আকমলের হাতে ধরিয়ে দেয়- ‘এই নেও তোমার নয়া শাট, তোমার এই শাটের মাপে বানাইছি। ডেলিভারি নিয়া ইস্তারি করাইতে করাইতে দেরি হই গেচে।’ আকমল তব্দা খায়, ভিরমি খায়, আহাম্মক হয়, লজ্জা পায়।
রাহেলা, নীলের মধ্যে গাঢ় নীল চিকন চিকন স্ট্রাইপ শার্টটার ইস্ত্রি ভেঙে হাস্যোজ্জ্বল মুখে আকমলের হাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে বলে। আকমল উঠে গিয়ে হাত-মুখ ধোয়, রেডি হয়। তারপর প্যাকেট থেকে ফরিদের বউকে দেয়ার জন্য কেনা শাড়িটা জোর করে রাহেলাকে পরিয়ে দেয়। ঘরের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাঙা বাটির টুকরোগুলো সব আগের মতোই অবাক হয়ে দেখে। মুচড়ে যাওয়া পাতিলটা জানালার ফাঁক গলে দেখে। পার্থক্য শুধু তাদের সে দেখায় তখন একটা মচুকি হাসিও লেপ্টে থাকে।
বরযাত্রী না হয়ে আকমল রাহেলাকে নিয়ে রিকশায় ঘোরে। ফুচকা-চটপটি খায়। ‘জীবন সংসার’ সিনেমা দেখে একটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দেয়। এই জীবনটাকে অথবা এই সংসারটাকে তখন একটা সিনেমা অথবা সিনেমার একটা দৃশ্য বলে মনে হয়, দুজনের।