বাংলা সাহিত্যের বহুমাত্রিকতার একটি রূপ হলো বিখ্যাত কবিদের কবিতাকে সঙ্গীতে রূপ দেওয়া। অনেক বিখ্যাত কবি চমৎকার সব গানও লিখেছেন। উপমহাদেশে হিন্দি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায়ও এই বিষয়টা দেখা গেলেও কবির নামে সঙ্গীত হিসেবে "রবীন্দ্র সঙ্গীত" ও " নজরুল সঙ্গীত" যেভাবে গৌরব অর্জন করেছে, তা অনন্য।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যেরই উজ্জলতম নক্ষত্র। নোবেল পুরস্কার দিয়ে শুধু তাঁর সাহিত্যকর্মকে মাপা যৌক্তিক হবে না। মহাকাব্য ছাড়া তিনি সাহিত্যের সব শাখায় নিজের অবদান রেখেছেন। কিন্তু, তিনি অমর হয়ে আছেন রবীন্দ্র সঙ্গীত দিয়ে। একজন মানুষের প্রয়াণের শত বছর পরেও মানুষ তাঁর সৃষ্টিকর্মে নিজেকে খোঁজে! কী দারুণ ব্যাপার! ব্যক্তিগতভাবে একজন গীতিকার হিসেবে তাঁকে আমার কবির চেয়েও বড় মনে হয়।
তেমনি আরেকজন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তাঁর কবিতায় বাংলা শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন আরবি, উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করে। তাঁর লেখা গানের কী অপার বৈচিত্র্য! যারা গান করেন তারাও বলেন যে নজরুল সঙ্গীত কঠিন।
প্রথাগত সাহিত্যিক না হলেও বাংলা সঙ্গীতের আরেক মহীরূহ লালন শাহ। সমসাময়িক এমনই আরেকজন ছিলেন বাউল আবদুল করিম। তাঁদের গানের একটা আলাদা দর্শন আছে; স্বকীয়তা আছে। আসলে সঙ্গীতকে সাহিত্য থেকে আলাদা করা উপায় কই? এমন হলে একজন সঙ্গীত শিল্পী হয়েও বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেতেন না।
কবিদের মধ্যে যাদের লেখা গান বিখ্যাত হয়েছে, তেমনই আরেকজন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডি. এল. রায়)। "ধন ধান্য পুষ্প ভরা - আমাদেরই বসুন্ধরা" তো আমাদের মুখে মুখেই বেঁচে আছে। ছোটবেলায় শুরুতে আমি এটাকে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে গুলিয়ে ফেলতাম।
সমসাময়িক কবিদের মধ্যে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর লেখা "ভালো আছি ভালো থেকো - আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো" জনপ্রিয় হলেও তাঁর লেখা আরো একটি চমৎকার গান আছে। "এখনো আলো আসে" শিরোনামে গানটি গেয়েছেন মেহেদী হাসান নীল। আর কবি শামসুর রাহমানের লেখা "উত্তর" কবিতার সঙ্গীতে রূপান্তর ঘটে গুরু জেমসের কন্ঠে "তারায় তারায় রটিয়ে দেবো - তুমি আমার" গান হয়ে। কী দুর্দান্ত সব!
আরেকজনের কথা মিস করে যাচ্ছি। কবি সৈয়দ শামসুল হকও গীতিকার হিসেবে চমৎকার সব গান লিখেছেন। "হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস", " যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে", "চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা"সহ বিখ্যাত অনেকগুলো গান লিখেছেন তিনি।
সবগুলো গানই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এসব সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা হবে, সমালোচনা হবে, বিতর্ক হবে - এটাইতো স্বাভাবিক বিষয়! কিন্তু, সাম্প্রতিককালে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছি সংস্কৃতিমনা বলে দাবিদার একটা শ্রেণি সাংস্কৃতিক মানদণ্ড নিজেদের মতো করে নির্ধারণ করে দিতে চাচ্ছে। এরা বিশেষ করে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ধর্মের পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেনো। "রবীন্দ্র সঙ্গীত" বিষয়ক বিন্দু পরিমাণ আলোচনা-সমালোচনাও মানতে এরা নারাজ। কয়েকদিন আগে আসলো লালন সঙ্গীত ইস্যু! এটা সাংস্কৃতিক মৌলবাদ ছাড়া আর কী?
সঙ্গীত মনের খোরাক। কারো পছন্দের গান অন্য কারো বেশ অপছন্দেরও হতে পারে। লিরিক্সের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ কোনো গানের কথা যদি আমার ধর্ম বিশ্বাস বা আবহমান সংস্কৃতির পরিপন্থি মনে হয়, সেটি জানানো দোষের কিছু না। আবার এর অর্থ এই নয় যে কেউ দু'টো লাইন শেয়ার দিলে তার নামে মামলা দিয়ে দিতে হবে।
একজনের লেখা গান আমার ভালো লাগার অর্থ এই নয় যে তাঁর লেখার কোনো অংশ নিয়ে আমি সমালোচনা করতে পারবো না। সাহিত্য সমালোচনা সহ্য করতে না পারা আধুনিকতার পরিপন্থী। এসব করে করে তারা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কবিগুরু কিংবা লালন সাঁইয়ের শিল্পকর্মকে সাম্প্রদায়িক রুপ দিয়ে ফেলছেন জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে। এই কাজগুলো সংস্কৃতির সর্বজনীন চরিত্রকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে মারাত্মকভাবে। বিষয়টি নি:সন্দেহে বেদনার।