পোস্টস

গল্প

মধুর প্রতিশোধ ( ছোটগল্প )

৭ জুন ২০২৪

পার্থসারথি

   মধুর প্রতিশোধ ( ছোটগল্প )

     ▪পার্থসারথি

     *   

২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ। ১১ নভেম্বর। অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের শীতের প্রকোপটা একটু বেশি। গতকালের চেয়ে আজ আরও একটু বেশি শীত শীত লাগছে। সারায়েভোর প্রাণকেন্দ্র টাউন হলের অদূরেই রোটকে মেলভিচ তার একমাত্র নাতনী সর্বাধিকারিনী ইরিনা মেলভিচকে নিয়ে আছেন। রোটকে মেলভিচ উত্তরাধিকার সূত্রেই বাড়িটি পেয়েছিলেন। বাড়ির সন্মুখ ভাগে সুদৃশ্য মনকাড়া বাগান। বাগানটি ইরিনা মেলভিচের পছন্দ অনুযায়ীই সাজানো। বাড়িটির চারদিক দেয়াল ঘেরা। প্রতি বিকেলে নাতনীকে নিয়ে বাগানময় পায়চারি করেন তিনি। আজও বসে আছেন নাতনীর অপেক্ষায়। বেলা ক্রমশঃ গড়িয়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই অথচ  ইরিনা এখনও আসছে না। দুঃশ্চিন্তা এসে বারবার ঘিরে ধরছে রোটকে মেলভিচকে। কোন অসুবিধা হয়নি তো!- মনে মনে বিড়বিড় করে ঘরময় পায়চারি করছেন আর ক্ষণে ক্ষণে জানালায় উঁকি দিচ্ছেন। ‰কোন কাজ থাকলে ইরিনা নিশ্চয়ই বলে যেত।আমাকে না বলে কোথাও তো যায় না।'- একা একা ভাবছেন আর পায়চারি করছেন রোটকে মেলভিচ। দুঃশ্চিন্তায় কপাল খানিকটা কুঁচকে যাচ্ছে। পায়চারি করতে করতে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। সোফায় বসে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টায় মগ্ন হলেন রোটকে মেলভিচ।

গোধূলি পেরিয়ে ইরিনা ফিরে এলো। দাদু রোটকে মেলভিচ কিছুটা অভিমান ফুটিয়ে মুখ গম্ভীর করে চুপচাপ বসে আছেন। অন্যান্যদিনের মতো আনন্দ আর উল্লাস প্রকাশ করছেন না। পাশাপাশি এটাও বুঝতে পারছেন, ইরিনা তার ব্যাপারে কোন মাথাই ঘামাচ্ছে না। আজ দাদু-নাতনীতে বাগানে যাওয়া হলো না; যেন এটাই স্বাভাবিক। অথচ রোটকে মেলভিচ যদি কোনদিন অসুস্থতার অজুহাতে বলেছেন বাগানে হাঁটতে যাবেন না। তবে ইরিনার অভিমান ভরা কথা; দাদু, তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না! তারপর বাধ্য হয়েই রোটকে মেলভিচ একবার হলেও বাগানময় পায়চারি করেন। কিন্তু আজ এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারে কোন কথাই বলেনি ইরিনা। সে জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আর চোখ জোড়া আকাশের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোটকে মেলভিচ ম্যাগাজিনের আঁড়াল থেকে আঁড় চোখে তাকালেন নাতনির দিকে। অসুখী নাতনীকে দেখে কষ্টের কুণ্ডলী পাঁকিয়ে ওঠল রোটকে মেলভিচের সারা দেহমনে। উঠে এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ালেন। অতঃপর ইরিনা ওর হাতের এক টুকরো কাগজ তুলে দিলো দাদুর হাতে। 

কাগজের লেখাটা পড়ে রোটকে মেলভিচ বললেন- মনে হয় সবই ঠিক আছে। কিন্তু পেলে কোথায়?

ইরিনা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল- হাসপাতালের রোগী। আজই আমার ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন।

রোটকে মেলভিচ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন টুকরো কাগজটির দিকে। ভাবছেন ইরিনার কথা, রাদোভান কারাদজিচের কথা আর স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ নামের মুসলিম রূপসী অসহায় এক মেয়ের কথা। ভাবছেন বিংশ শতাব্দীর নব্বুই দশকের গোড়ার দিকের বিভৎস দিনগুলোর কথা। মনের আয়নায় ভেসে ওঠছে যুদ্ধের স্মৃতি; হাত-পা হারিয়ে নির্বাক ছয় বছরের অবোধ শিশু, তেইশ বছরের যুবতীর যৌনাঙ্গে দগদগে দাগ, ঊনিশ বছরের টগবগে যুবকের চোখ জোড়া অন্ধকার আর মুখমণ্ডল বিকৃত, আড়াই বছরের শিশুর মুখমণ্ডল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না, একুশ বছরের যুবকের দুই পা আর লিঙ্গ চিরতরে বিচ্ছিন্ন, চব্বিশ বছরের অন্তঃসত্ত্বা যুবতী-মহিলাকে একাধিকবার ধর্ষণের পর স্তনযুগল কেটে ফেলা হয়েছে এবং পশ্চৎদেশের মাংস কেটে নেয়া হয়েছে।– না! আর ভাববার শক্তি নেই। অসহ্য যন্ত্রনার স্মৃতি! মানুষ হয়ে মানুষের এসব বিভৎস স্মৃতি ভাবা যায় না। রোটকে মেলভিচ ডুঁকড়ে কেঁদে ওঠলেন। ইরিনা এই রকম পরিস্থিতির কথা কল্পনাই করেনি। এতটুকু বয়সে সে দাদুকে কাঁদতে দেখেনি। ইরিনা দাদুকে ধরে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিল।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে রোটকে মেলভিচ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন ইরিনার দিকে। চাহনীতে ভীষণ দুঃখ আছে বুঝতে বাকি রইল না ইরিনার।চোখের কোণে শুকনো অশ্রু চিকচিক করছে। কষ্টে আর অভিমানে ঠোঁট মৃদু কেঁপে ওঠছে। এতদিনের ভালোবাসায় লালিতপালিত শেষ অবলম্বন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এমনই আশংকা রোটকে মেলভিচের শিরা-উপশিরায় আনাগোনা করছে। ইরিনা দাদুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল- দাদু, তুমি কখনও ভেবো না যে তোমাকে ছেড়ে আমি চলে যাবো। রোগীটি মুমূর্ষু অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়। ঘন্টাখানেক দেরি করে এলে হয়তো বাঁচতো না। রক্তশূন্যতায় উনার রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তের গ্রুপ O নিগেটিভ। যা কিনা সচরাচর পাওয়া দুষ্কর। তার ওপর আবার সময়ের স্বল্পতা। ভদ্রলোকের স্ত্রীর কথাবার্তায় ভীষণ ভালোবাসা জমে ওঠে আমার। রক্তের গ্রুপও একই তাই রোগীকে রক্ত দিলাম মানবতার খাতিরে। ভদ্রলোক নতুন জীবন পেয়েছেন। তারপর ভদ্রমহিলা আমাকে মেয়ে বলে সম্বোধন করলেন। উনার ব্যক্তি জীবনের নানান কথা বললেন। কোন সন্তান নেই। তাদের রয়েছে বিশাল সম্পদ। এবং উনার স্বামী খুব আদর্শবান লোক। কোন কিছুরই অভাব নেই। শুধু একটি সন্তান চেয়ে নাকি সারাজীবন কেঁদেছেন। আমি যেন মেয়ে হিসেবেই সম্পর্ক রাখি এই তার অনুরোধ। বাড়ির ঠিকানা লিখে আমার হাতে দিলেন।

ইরিনার সব কথা চুপচাপ শুয়ে শুয়ে শুনলেন রোটকে মেলভিচ। কোনরকম টু-টা শব্দ করেননি। ইরিনাও আর কোন কথা বাড়ায়নি। দাদুর মাথায় কিছুক্ষণ বিনুনি কেটে দিল। রোটকে মেলভিচ ঘুমিয়ে পড়েছেন। কপাল কুঁচকে আছে দুঃখের কুণ্ডলীতে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন বেশ ঘন ঘন। 

        *

রাতটা ভীষণ কষ্টে কেটেছে ইরিনার; তন্দ্রায় আর দুঃস্বপ্নে। সারারাত কেঁদেছে অশ্রুহীন কান্না। বুকের ভেতর দুঃখের রাজ্য। মনের দুঃখের কথা ইরিনা দাদুকে বলতে চায় না। দাদু ওকে ভীষণ ভালোবাসে; বাবার ভালোবাসা, মায়ের ভালোবাসা, ভাই-বোনের ভালোবাসা সবই দিয়েছে। দুঃখের কথা বলে ইরিনা দাদুকে দুঃখ দিতে চায় না। দাদুকে সুখী দেখলে নিজেকেও সুখী মনে ইরিনা।

হাসপাতালে ঢুকেই ইরিনা দেখতে পেল ভদ্রমহিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ইরিনাকে দেখতে পেয়েই চোখমুখ সুখানন্দের ধারায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠল। গেইটে এসেই ইরিনাকে ধরলেন। কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।– ভদ্রমহিলা অতি আপন কন্ঠে জিজ্ঞ্যেস করলেন।ইরিনা কোন কথা ব্যয় না করে নিজের রুমে এসে চেয়ার টেনে বসল। ভদ্রমহিলা পেছন পেছন এসে টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। অযথা ব্যস্ততা দেখাচ্ছে ইরিনা। খুব কষ্ট হচ্ছে এভাবে এড়িয়ে চলতে।   

ভদ্রমহিলা ভেবেছেন হয়তো চিনতে পারেনি। তাই নিজের পরিচয় দিলেন। এবং বললেন- রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। এখন সে বেশ সুস্থ।' তারপর একটু থেমে আবার ইরিনার দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমাকে দেখতে চেয়েছে।

কথা শোনার পরও ইরিনার মাঝে কোন ভাবান্তর নেই।

স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ ভালোবাসার পবিত্র মোহনায় ধর্মীয় অনুভূতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। জন্মদাতা পিতা, গর্ভধারিণী মা, শৈশব-কৈশোরের অকৃত্তিম বন্ধু, ভাই-বোনকে ছেড়ে ভালোবাসার মানুষটির কোলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভালোবাসা মুক্ত বিহঙ্গ, নীল আকাশের শুভ্র মেঘ, ভালোবাসা অকৃত্তিম সম্পর্ক, ভালোবাসার বসতভিটায় নেই কোন ছলনার কলঙ্ক, ভালোবাসা স্বর্গতুল্য; এই ছিল স্লাভেনকা আঙ্গেভিচের বিশ্বাস। বিয়ের পর নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। জীবনের টুকিটাকি সুখ-দুঃখের কথা জানিয়েছেন। রাদোভান তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন। মুক্ত বিহঙ্গের সুখানুভূতিতে স্লাভেনকা আঙ্গেভিচকে খোঁজে বেড়াতেন। প্রতিটি সুখের মুহূর্তের জন্য ধন্যবাদ জানাতেন স্লাভেনকা আঙ্গেভিচকে। এমন সুখের মুহূর্তেই বসনিয়া- হারজেগোভিনায় যুদ্ধ বেঁধে যায়। যুদ্ধের নিষ্পেষণে দলিত-মথিত হয় ভালোবাসার আঙিনা। ধূলিস্যাৎ করে মানবতার শুভ্র-শুভ দেয়ালকে। একদিকে সার্বীয় খ্রীষ্টান বাহিনী আর অন্যদিকে বসনিয় মুসলিম বাহিনী মাঝখানে বুলেটবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে সাধারণ জনগন যাদের কেউ যুদ্ধ চায় না। ওরা সবাই দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে চায়, আগের মতোই মিলেমিশে এক হয়ে থাকতে চায়। ওরা কখনও ভাবেনি কে খ্রীষ্টান আর কে মুসলমান। কিন্তু কতিপয় উচ্চাভিলাষী সৈনিক ও নেতার কারণেই এই যুদ্ধ। যুদ্ধের নির্মমতার আঁচে রাদোভানের ভালোবাসা নিঃশেষ হয়ে যায়। সে নিজেকে বাঁচাতে চায়, পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে নিরাপদে থাকতে চায় যুদ্ধের সময়ে প্রতিটি মুহূর্তে।স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ মুসলমান। তাকে আঁকড়ে ধরা মানেই মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরা; এই হলো রাদোভান কারাদজিচের ধারণা এবং ভাবনা। রাতের অন্ধকারে সমূহ বিপদ জেনেও স্লাভেনকা আঙ্গেভিচকে ভালোবাসার বসতভিটা থেকে বিতাড়িত করে দেন রাদোভান কারাদজিচ। স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ অশ্রুবিজড়িত কন্ঠের কম্পনে তুজলার বাতাসে বাতাসে কষ্ট সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রাদোভান কারাদজিচের ভালোবাসার আকাশে এতটুকুও স্পর্শ করতে পারেনি।

সারা শরীরে যৌবনের অবাধ-উত্তাল ঢেউ, রূপের লাবণ্যে পরীকেও হার মানাবে, হরিণী চোখের পাতায় যাদুর স্পর্শ এমনই রমণী চোখের সন্মুখে। ট্রিগার থেকে আঙুল নেমে আসে সার্বীয় বাহিনীর। বিষাক্ত চোখের তীক্ষ্ণ সাঁড়াশিতে বিদ্ধ হয় স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ। সার্বীয় বাহিনী একটানে স্লাভেনকা আঙ্গেভিচকে জীপে তুলে নেয়। মুহূর্তেই ধর্ষিতা হন। একসময় অচেতন হয়ে যান কষ্টের সীমানায় আহত হ'তে হ'তে। সার্বীয় বাহিনীর দলটি একে একে প্যান্টের চেইন টেনে টেনে অস্ত্র উঁচিয়ে বীরদর্পে এগিয়ে চলে সন্মুখ সমরে।

জ্ঞান ফিরলে স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ বুঝতে পারেন তার সারা শরীর যন্ত্রণার স্বর্গোদ্যান। হঠাৎ করে ঠাহর করতে পারেননি কোথায় আছেন, কীভাবে এখানে এলেন আর কেনই বা এলেন। ধীরে ধীরে যখন স্মৃতির জানালা প্রসারিত হয় তখন আর ভাবতে চান না। মুহূর্তেই অশ্রু শুকিয়ে বুকে হাহাকারের হামাগুড়ি শুরু হয়ে গেল। বুকের ভিতর-বাহির যন্ত্রণায় পুড়ে শূন্যোদ্যান। একটু নড়তেই শরীরের নিম্নাংশে যেন আগুন লেগে গেল। অতঃপর আর নড়াচড়া করার চেষ্টা করেননি।

এখন কেমন লাগছে?- কন্ঠ শুনেই চোখ মেলে তাকালেন স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ। কিন্তু কোন কথা বললেন না। ডাক্তার আবার জিজ্ঞ্যেস করলেন। স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ অনেক কষ্টে চোখের ভাষায় কথা বললেন। গর্ভবতী মহিলার এই অবস্থা দেখে ডাক্তারের মনে বেশ মহানুভবতা জেগে ওঠে। বিশেষ করে গর্ভের ভেতর নতুন মানুষটি এখনও বেঁচে আছে।

দীর্ঘদিন মৃত্যু যন্ত্রণার সাথে যুদ্ধ করে একটি কন্যাসন্তান রেখে স্লাভেনকা আঙ্গেভিচ চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন শান্ত হয়ে। ডাক্তারের কাছে গচ্ছিত রেখে গেলেন তার ভালোবাসার ব্যথিত ফসল এবং কিছু টুকরো স্মৃতি। যা আজও রোটকে মেলভিচ সযতনে লালন করে চলেছেন। ইরিনার জন্যে খুব কষ্ট হয় রোটকে মেলভিচের। এসব বলতে গেলে তাঁর কন্ঠনালী ভীষণ শুকিয়ে আসে। বুকের ভেতর কষ্টের দাপাদাপিতে কান্না উবে যায়। ইরিনা কাঁদেনি, নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কেবল দাদুকে আঁকড়ে ধরেছে। মনের গহীন কোঠরে শুধু গল্পের মতো গেঁথে রেখেছে।

ইরিনা চুপচাপ বসে আছে দেখে ভদ্রমহিলা আবার তাগাদা দিয়ে বলেন- ডাক্তার-মা, চল।

শান্ত স্বরে ইরিনা জবাব দেয়- আমাকে ক্ষমা করুন! এখন আমি আর যেতে পারছি না। আমার ডিউটি আজ অন্য ওয়ার্ডে।

ভদ্রমহিলা হকচকিয়ে যান। গতকাল যে মেয়ে-ডাক্তার তার স্বামীকে রক্ত দিয়ে, চিকিৎসা করে প্রাণ বাঁচিয়েছে এবং সুখ-দুঃখের মাঝে ক্ষণিকের জন্যে হলেও প্রবেশ করেছে। আর আজ একেবারে উল্টো। ভদ্রমহিলা ভেবেই কূল পাচ্ছেন না। যার দানে ভালোবাসার ছোঁয়া ছিল আজ তার ব্যবহারে সূক্ষতম ব্যথা পাচ্ছেন। যা সহ্য করা অতি দুরূহ ব্যাপার। হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা ভীষণ কষ্ট দেয়। বিমর্ষচিত্তে কষ্টের পাহাড় বেয়ে ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

     *

রাদোভান কারাদজিচের সুস্থ হতে প্রায় দু'সপ্তাহ লেগে গেল। তার সুস্থতার পেছনে যার অবদান তার খোঁজেই এলেন। ইরিনা একা বসেছিলেন রুমে। রাদোভান কারাদজিচ রুমে ঢুকেই একটু হকচকিয়ে গেলেন। মুহূর্তটি তাকে যেন চাবুক মেরে স্তব্ধ করে দিয়ে গেল। মনে হচ্ছে অনেক অনেক আগে ওর সাথে কথা হয়েছিল। খুবই পরিচিত লাগছে এই মুখাবয়ব। হঠাৎ স্মৃতির দুয়ারে এসে হঠাৎ হানা দিলো যুদ্ধের সেই ফেলে আসা দিনটি। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে রাদোভান কারাদজিচ বলেন- মা, আমাকে দেখতে গেলে না যে? 

ইরিনা না তাকিয়েই বলে- আমার অন্য ওয়ার্ডে ডিউটি ছিল।

না মানে, আপনিই আমাকে সুস্থ করে তুললেন। তাই!- বেশ আবদারের সুরে রাদোভান কারাদজিচ বললেন।

সেটা আমার মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই করেছি।– ইরিনার স্পষ্ট উচ্চারণ।

রাদোভান কারাদজিচ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললেন- একবার আমাদের এখানে আসুন না! এলে ভীষণ খুশী হবো। 

ইরিনা বেশ তাচ্ছ্যিলের সুরেই বলে- তা'তে আমার কী আসে যায়!

এতক্ষণে ভদ্রমহিলা কথা বললেন- আপনি আমাদের মেয়ের মতো। তাছাড়া আপনি যে উপকার করেছেন তা' আমরা কোনদিন ভুলবো না। 

উত্তরে ইরিনা কোন কথা বলল না। আগের দেয়া ঠিকানার কথা ভদ্রমহিলা যখন উত্থাপন করলেন আবার তখন ইরিনা চোখজোড়া বন্ধ করে অনুভব করলো বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথাটা। যে ব্যথা সে লালন করে চলছে দীর্ঘ তেত্রিশটি বৎসর। এবং মায়ের রেখে যাওয়া স্মৃতিটুকু; হীরা বসানো একটা নিঁখুত সুন্দর আংটি। আংটিটা রাদোভান কারাদজিচের হাতে তুলে দিয়ে ইরিনা বলল- নিন, এটা আমার মায়ের শেষ অনুরোধ; আপনার কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল কিন্তু দিতে পারিনি।

আংটিটা হাতে নিয়ে রাদোভান কারাদজিচ নির্বাক। হাতে তুলে নিয়ে আংটিটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে হাঁটতে হাঁটতে অনেক অনেক দূর অতীতে চলে গেলেন। চোখের পাতায় খেলে গেল সেই স্মৃতিময় মুহূর্তগুলোয়। 

তুমি কি...!- রাদোভান কারাদজিচ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ইরিনা পাশে নেই। এদিক-সেদিক খুঁজলেন কিন্তু কোথাও নেই। রাদোভান কারাদজিচ পাগলের মতো ছুটলেন। কিন্তু কোথাও দেখা পেলেন না। ভীষণ কষ্ট অনুভব করছেন রাদোভান কারাদজিচ। এমন কষ্ট নিষ্ঠুরতম আঘাতেও হয় না অথচ ভালোবাসায় এই প্রতিশোধ নিল ইরিনা।

          শেষ

 

রচনাকাল: ১১.১১.১৯৯৪ ইং

            ২৭.০৭. ১৪০১ বাং

গল্পটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা গল্পকার-এ নভেম্বর'২১ সংখ্যায় প্রকাশিত।